আন্দোলনে আহত স্বামীর জন্য সন্তান বিক্রি, চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন ইউএনও

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, পঞ্চগড়
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গর্ভবর্তী স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন দিনমজুর আব্দুর রশিদ (২৮)৷

স্থানীয়দের সহায়তায় প্রাথমিক চিকিৎসায় বেঁচে ফিরলেও অর্থাভাবে থমকে যায় চিকিৎসা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্বামীর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য তার স্ত্রী তিন দিনের কন্যা শিশুকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেন। সন্তান বিক্রি করা টাকা দিয়ে পুনরায় শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু সেই টাকাও শেষ হয়ে যায় খুব দ্রুতই। একদিকে টাকার অভাব ও অন্যদিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব (জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র) না থাকায় মেলেনি কোন সাহায্য সংস্থা বা সরকারি আর্থিক সহায়তা। অবশেষে সেই গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি জানতে পেরে যথাযথ দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নাগরিকত্ব প্রদানপূর্বক চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিলেন তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

সোমবার দিবাগত রাতে আহত আব্দুর রশিদকে নিজেই তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো.ফজলে রাব্বি। আহতের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শে ঔষধপত্রসহ বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করেন। তিনি উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করেন টেস্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনে আরো উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং সকল ব্যয়ভার নিজেই বহন করবেন বলে ঘোষনা দেন।

জানা যায়, এর পূর্বে গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদের কোন জন্মসনদ বা নাগরিকত্ব সনদ না থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে তাৎক্ষণিকভাবে জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ইউএনও। গুলিবিদ্ধ, আহত ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়া দিনমজুর আব্দুর রশিদ এর স্থায়ী ঠিকানা উদ্ধারের জন্য তার সাথে একান্তে কথা বলেন তিনি। বিভিন্ন প্রচেষ্টায় জানা যায়, তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে এই গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদ । তবে গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ট্রাক্টর শ্রমিক হিসাবে কাজ করে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

তথ্য জানা মাত্রই শুরু হয় দাপ্তরিক কার্যক্রম। আব্দুর রশিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে উপস্থিত হন তিনি। অপর একটি দল চলে যায় আব্দুর রহমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের বাড়িতে। খবর পাওয়া মাত্রই আব্দুর রহমানের বাবা নজরুল ইসলাম, কয়েকজন নিকটাত্মীয় সহ স্থানীয় জনগণ উপস্থিত হন সেখানে। আর এ ঘটনায় সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলে উৎসুক জনতার ভিড়। সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয়দের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আব্দুর রশিদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি, মিসবাহ উল্লাহ, হযরত আলী, মোকাদ্দেসুর রহমানসহ কয়েকজনের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং আব্দুর রশিদের জটিলতা নিরসনে ইউএনও কে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে দেখা যায়।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আব্দুল রশিদের মা (রশিদা বেগম) গত প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান। বাবা নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিভিন্ন বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় একসময় ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আব্দুর রশিদ। পরবর্তীতে, দিনাজপুর জেলার রাজবাড়ী এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাতেন।

গত ৪ আগষ্ট দিনাজপুরে বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন আব্দুর রশিদ। তার বক্তব্য অনুযায়ী, হাসপাতালের গেটে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজনের সহায়তায় চিকিৎসা করা হয় তার, কোনরকমে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি। অর্থাভাব ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর বাচ্চা প্রসবের সময় যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থান অবনতি বাড়তে থাকে। ৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি এবং সেখানে পরদিন শুক্রবার তার অপারেশন হয়। অপরদিকে তার পরদিন (শনিবার) রাজবাড়ী এলাকার বাড়িতে আব্দুস রশিদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম নীরবে নির্ভৃতে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা বৈধ পরিচয় সম্পর্কিত কোন ধরনের কাগজপত্র না থাকায় এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। জটিল এবং মর্মান্তিক এই পরিস্থিতিতে অসহায় গরীব এই দিনমজুরের স্ত্রী স্বামীর জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে রংপুরের এক দম্পতির কাছে মাত্র ২৫ হাজার টাকায় শিশুকে বিক্রি করে দেন৷ সেই টাকায় আবার চিকিৎসা শুরু হলেও আবারও বৈধ পরিচয়হীনতার জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। ঘটনাটি জানাজানি হলে, দ্রুততার সাথে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিক্রি করে দেয়া সন্তান ফেরত পেয়েছেন আব্দুর রশিদের স্ত্রী।

এবিষয়ে আহত আব্দুর রশিদের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা বন্ধ, সে দেশের নাগরিক না হওয়ায় চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করছে না। আমি বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানাই। পরে আমার ছেলেকে জন্ম সনদ তৈরি করে দেন এবং তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমি ইউএনও মহোদয়কে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ তার ভাল করুক।

একই কথা বলেন, আহত আব্দুর রশিদের বড় ভাই আব্দুর রহমান। তিনি জানান, আমরা গরীব মানুষ, আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারছি না। বাধ্য হয়ে চিকিৎসা করার জন্য তাদের সন্তানকে বিক্রিও করে ছিলেন তার স্ত্রী । সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসাও করানো হয়েছে কিন্তু এখন আমরা নিরুপায়। আমার ভাই দেশের নাগরিক না হওয়ায় সে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল। অবশেষে আমাদের ইউএনও স্যার সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরও উন্নত চিকিৎসা করাবেন এমন আশ্বাস দেন ইউওএনও স্যার।

আব্দুর রশিদের প্রতিবেশী আব্দুল কাদের বলেন, রশিদ ছোটবেলায় তার মাকে হারিয়েছে। সৎ মায়ের কাছে বড় হয়েছে অনেক কষ্টে। কয়েক বছর আগে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে যায়, আর ফেরেনি। আমরা ফেসবুকে জানতে পারি রশিদ পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে, চিকিৎসার জন্য তা সন্তানকে বিক্রি করেছে। পরে বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানালে ইউএনও স্যার নিজে এসে সব ব্যবস্থা করেছেন, হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। আমাদের বলেছেন দুঃশ্চিন্তা না করতে।

এদিকে আহত আব্দুর রশিদ বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই মাকে হারিয়ে পারিবারিক ঝামেলা ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ নিতে পারি নি। আমার চিকিৎসার জন্য আমার স্ত্রী আমার কন্যা শিশুকেও বিক্রি করেছিলে। কিন্তু দেশের ভোটার বা নাগরিক না হওয়ায় কোন সহযোগিতা পাই না। আমার শরীরে এখনো চারটা গুলি রয়েছে। পরিচয় না থাকায় সবাই আমার চিকিৎসা করতে ভয় পায়। বিষয়টি ফোনে ইউএনও স্যারকে জানালে, নিজে পরিষদে এসে আমার সব কথা শুনেন। পরে তিনি আমার পরিচয় প্রদানের জন্য সকল ব্যবস্থা নিজে বসে থেকে করেন এবং আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি আমার পাশেই ছিলেন। এই বিপদে স্যার সাহায্য করেছেন, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারি নি। সেই সাথে নতুন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পেরে আমি অনেক আনন্দিত। যদিও দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি এখনো দেখতে পারিনি, হাসপাতালের চার দেয়ালের কারণে। আমি চাই দেশটা ভালো চলুক। দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক।

এদিকে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি জানান, গুলিবিদ্ধ ও গুরুতর আহত আব্দুর রশিদের পরিচয়হীনতা, স্বামীর চিকিৎসার জন্য তার স্ত্রীর সন্তান বিক্রির মত মর্মান্তিক এই ঘটনা জানার পর শ্রদ্ধেয় জেলা প্রশাসক জনাব মো. বাসেত আলী স্যারের নির্দেশনাক্রমে ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় ব্যাক্তিবর্গসহ সকলের সহযোগিতায় কাজটি সম্ভব হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সরেজমিনে সকল তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সকল বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করেছে কয়েকজন তরুণ উদ্দীপ্ত সমন্বয়ক। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। তার শরীরে এখনো গুলি রয়েছে , এছাড়াও পূর্বের অপারেশন থেকে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। শারীরিকভাবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন। যদি প্রয়োজন হয়, তবে ঊর্ধ্বতন নির্দেশনা মোতাবেক আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সবাই দোয়া করবেন।