চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১ হাজার ৯৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। এই অর্থ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্সের এমন বিপ্লব দেশের এমন এক মুহূর্তে এসেছে, যখন বাংলাদেশ এখন বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি, সার এবং অন্যান্য পণ্য আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে।
রেমিট্যান্সের এ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির পেছনে কী ভূমিকা রয়েছে? আর্থিক বিশেষজ্ঞ এবং ব্যাংকারদের মতে এখানে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে দুটি বিষয় কাজ করেছে।
প্রথমত, আমদানি বিলের ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েসিং (পণ্য বা পরিষেবার দাম ন্যায্য বাজার মূল্যের নিচে থাকে এবং বিক্রেতা ক্রেতার কাছে মূল্য হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়) উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে আগে বড় একটা টাকার অংশ সরিয়ে নিলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, হুন্ডির মতো অবৈধ পথে অর্থ পাচার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কার্যকলাপ ধীর হয়ে পরেছে এবং অর্থপাচার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনানুষ্ঠানিক হুন্ডি মতো অবৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে সরকারি চ্যানেলে প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, "আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং সাধারণত হুন্ডির চাহিদা বাড়ায় কিন্তু সম্প্রতি আমদানি কমে যাওয়ায় এর চাহিদাও কমে গেছে। এতে ডলার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে।"
সৈয়দ মাহবুব আরও বলেছেন, আগস্টে সরকার পতনের পর থেকে প্রবাসী যোদ্ধারা দেশপ্রেমের টানে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলকে রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
এদিকে হুন্ডির চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকার এবং বিদেশি রেমিট্যান্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া হুণ্ডির চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি হেড বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর "বিদেশে অর্থ পাচার" স্থবির হয়ে পড়েছে। বিদেশি শাখাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, অর্থ পাচার কমে যাওয়ার সাথে সাথে, হুন্ডি ডলারের চাহিদাও ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে কমে গেছে। তাই আগে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো ডলার এখন বৈধপথে আসতে শুরু করেছে।
এমটিবি'র সিইও সৈয়দ মাহবুব বলেন, মানি লন্ডারিং ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় হুন্ডির চাহিদা কমে গেছে। আমরা অতীতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখেছি। কোভিড-১৯'র সময় যখন হুন্ডি কার্যক্রম কমে গিয়েছিল তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। ওই মাসেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ৩৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৪১ শতাংশ বেড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৬২ মিলিয়ন। সৌদি আরব থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে ৩৪৫ মিলিয়ন, মালয়েশিয়া থেকে ২৭৫ শতাংশ বেড়ে ২৩৭ মিলিয়ন ও যুক্তরাজ্য থেকে ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২০৬ মিলিয়ন হয়েছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ডলারের হার রেমিট্যান্স প্রবণতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান গত দুই বছরে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের উচ্চ সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এছাড়া, দেশের সরকারের প্রতি আস্থা থাকলে প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হন উল্লেখ করে মারুফ বলেন, এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে সামনের দিনগুলোতে রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রবাহ রাখা সম্ভব হবে।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগ কমার কারণে ঋণপত্র (LC) খোলা এবং নিষ্পত্তি প্রায় ১৩ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-আগস্টের মধ্যে ১০ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মূল্যের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন হ্রাস পেয়েছে।
একটি বেসরকারী ব্যাংকের এক সিনিয়র ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকি, বিশেষ করে ঋণপত্র খোলায় নজরদারি এবং আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের তদারকি হুন্ডি বাজারে হ্রাসের জন্য অবদান রেখেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, "ব্যাংকাররা আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে- তারা আমদানিকৃত পণ্যের দাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করছেন।"
একটি মানি এক্সচেঞ্জের প্রধান গণমাধ্যমকে বলেন, গত দুই সপ্তাহে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মধ্যে হারের ব্যবধানকে কমিয়ে, রেমিটেন্স বাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "বর্তমানে, বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ডলার প্রতি ১২৫ টাকা থেকে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা পাওয়া যায়। এর মধ্যে সরকারের প্রণোদনা রয়েছে আড়াই শতাংশ। অন্যদিকে অবৈধ হুন্ডি চ্যানেলগুলোতে ডলার প্রতি দেওয়া হয় ১২৬ টাকা থেকে ১২৭ টাকা পর্যন্ত।
এই দুটি চ্যানেলের মধ্যে ১ থেকে ২ টাকা পার্থক্যের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। অথচ দুই চ্যানেলের মধ্যে ২০২২ ও ২০২৩ সালে পার্থক্য কখনো কখনো ৭ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
ওভারডিউ পেমেন্টের চাপে গত দুই সপ্তাহে ডলারের দাম ২ টাকা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে।
দেশের আর্থিক ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ডলারের অর্থ পরিশোধ করতে শুরু করেছে।
তারা ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রেমিট্যান্স ডলার সংগ্রহ করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও প্রতিযোগিতায় থাকার জন্য অংশগ্রহণ করছে।
রেমিট্যান্স সংগ্রহের এই প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, ব্যাংকগুলো ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব দিতে পারবে।
সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম মানিগ্রাম গত রোববার (৬ অক্টোবর) প্রতি ডলারে ১২৪ দশমিক ০৬ টাকা অফার করেছিল বিপরীতে ট্যাপট্যাপ সেন্ড অফার করেছল ১২০ দশমিক ৫০ টাকা।
এগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটি বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থা উচ্চ হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। যেখানে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সর্বোচ্চ ক্রয়ের হার ছিল ১২০ থেকে ১২১ টাকা।
বেশি রেমিট্যান্স নিয়ে আসা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর মধ্যে অন্যতম ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ২ অক্টোবর রেমিটরদের ১২১.১৮ টাকা দাম অফার করেছিল। প্রতিযোগিতায় টিকতে মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের ডলার রেট ১ টাকার বেশি বাড়িয়ে ১২২.২১ টাকা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ডলারের দাম বাড়ল কীভাবে?
সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১৮ আগস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তারল্য বাড়ানোর জন্য আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য অনুমোদিত ব্যান্ডকে ১% থেকে ২.৫% পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়। বর্তমান ক্রলিং পেগ ব্যবস্থার অধীনে ডলারের মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলো এখন ২.৫% যোগ করে ডলারের রেট ১২০ টাকা পর্যন্ত বাড়াতে পারে। এই সমন্বয়ের ফলে ব্যাংকগুলো কিছুটা উচ্চ রেট অফার করার সুযোগ পায়।
পরদিন এক সভায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের ওভারডিউ বিদেশি পেমেন্ট নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন এবং এসব পেমেন্টের জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রি করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
ডলারের দাম বৃদ্ধি রোধে গত ২৯ আগস্ট ৪৭টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানরা ক্রয়-বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকা নির্ধারণে সম্মত হন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর উচ্চ হারের প্রস্তাব অব্যাহত থাকায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোও একই কাজ শুরু করে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, বেশিরভাগ ব্যাংক উচ্চ হারের প্রস্তাব শুরু করে, এতে ডলারের দাম ১২২ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ডলারের দাম ১২০ টাকায় রাখার লক্ষ্য রেখেছেন। যদি তিনি এটা না করতে পারেন তবে তিনি এ চেষ্টায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন সেটা বলাই যায়।
তবুও তার এমন সিদ্ধান্ত বাজারে ডলারের অস্থিরতা কমাতে কিছুটা হলেও কাজ করেছে। কিন্তু, যতক্ষণ না এই বাজার পুরোপুরি স্থিতিশীল হয় ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্য বাস্তবায়িত নাও হতে পারে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, একবার দেশের রিজার্ভের উপর চাপ কমলে, বিনিময় হারের চাপও হ্রাস পাবে।