মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে শয্যা ২০, রোগী ভর্তি ৭৫
মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়রা রোড এলাকায় প্রায় দুই বছর আগে একটি ভাড়া ভবনে যাত্রা শুরু করে ‘মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতাল’ নামে একটি বেসরকারি শিশু হাসপাতাল। সরকারিভাবে অনুমোদন প্রাপ্তির আগেই শিশু রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ১০ জন শেয়ার হোল্ডার মিলে পরিচালনা হয়ে আসছে হাসপাতালটি।
এই হাসপাতাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে নামি-দামি শিশু চিকিৎসকেরা। যে কারণে শুরু থেকেই জমজমাট এই হাসপাতাল। অন্যান্য হাসপাতালে রোগী না থাকলেও এই ২০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৭৫ জন রোগী। সাধারণ রোগীদেরকে জিম্মি করে পর্দার অন্তরালে থেকে দেদারছে ব্যবসা করে যাচ্ছে শিশু চিকিৎসকেরা। তবে রোগীর তুলনায় হাসপাতালটিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স।
হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে রোগীদের মাঝে রয়েছে নানা ক্ষোভ। দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চললেও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মানিকগঞ্জ শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল নামে অনুমোদন পেলেও হাসপাতালের সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে ‘মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতাল’ নামে।
সরেজমিনে যা পাওয়া যায় হাসপাতালে
জয়রা এলাকার একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় রয়েছে হাসপাতালটির রিসিপশন ডেস্ক। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালের ডেস্কের সামনে শিশু রোগীর স্বজনদের প্রচন্ড ভিড় দেখা যায়। শিশুদের ভর্তি করানোর জন্য স্বজনদের দীর্ঘ সারি। নিচতলায় ঢুকতেই ডানপাশে রয়েছে একটি ফার্মেসি। তার ঠিক পরের কক্ষটিই আবাসিক চিকিৎসকের জন্য। ছোট্ট কক্ষটি দুটি চেয়ার ও একটি টেবিল নিয়ে কোনরকমে বসে রয়েছেন দু’জন চিকিৎসক। নিচতলাতেই রয়েছে প্যাথলজি সেন্টার।
দু’তলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত ভর্তি রোগীর শয্যা করা হয়েছে। চারতলায় পাশের একটি বিল্ডিংয়ের একটি ফ্লোর নিয়ে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে হাসপাতালটিতে বেড রয়েছে ৭৫টি। এর মধ্যে সাধারণ শয্যা ৩১টি আর কেবিন সংখ্যা ২২টি। প্রতিটি কেবিনে আবার দুটি করে শয্যা রয়েছে। ৬ষ্ঠ তলার ক্যান্টিনের ফ্লোরেও দেওয়া হয়েছে বেড।
নিয়ম অনুযায়ী, ২০ শয্যার একটি হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসক ও ১২ জন ডিপ্লোমা নার্স থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু শনিবার দুপুরে ওই হাসপাতালে সরেজমিনে পাওয়া যায় মাত্র দুই জন চিকিৎসক। তাদের একজন ফাহিম আবরার মবিন। যিনি ঢাকা থেকে আসেন। সপ্তাহে ডিউটি করেন ৬০ ঘণ্টা। অন্যজন হচ্ছেন ডা. তানজিলা ইসলাম। তিনিও প্রতি শিফটে অর্থাৎ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করেন।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী সর্ম্পকে জানতে চাইলে ডা. ফাহিম আবরার মবিন বলেন, শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৫৫ জন রোগী। এসব বিষয় নিয়ে তিনি আর বেশি কিছু বলতে অনিহা প্রকাশ করেন।
যে কারণে রোগীদের ভিড় হাসপাতালে
মানিকগঞ্জ জেলা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রধান গেট ঘেষে গড়ে উঠেছে ‘পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’। সেখানকার দু’তলায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিয়মিত রোগী দেখেন প্রফেসর ডা. মো. নাছির হোসেন। পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কিছু লোক নিয়মিতভাবে অবস্থান করেন মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে রোগীর স্বজনদেরকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসেন নিয়মিত।
এছাড়াও ডা. মো. নাছির হোসেনের রয়েছে আলাদা নাম-ডাক। প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক রোগী দেখেন তিনি। এসব রোগীদের বড় একটা অংশকে ভর্তির সুপারিশ করেন মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে। যে কারণে ওই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ভিড় লেগে থাকে সবর্ত্র। শনিবার ওই হাসপাতালের ভর্তি হওয়া প্রায় ২৩ জন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা প্রত্যেকেই নাছির ডাক্তারের পরামর্শে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
ভর্তি রোগী সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইলে নিজেকে কর্তৃপক্ষের একজন দাবি করে মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালের ম্যানেজার কাইয়ুম আলী ফাহাদ বলেন, পুরো হাসপাতাল ঘুরে দেখার কোন প্রয়োজন নাই। হাসপাতালের মালিক ইসমাঈল খন্দকারের সঙ্গে আলাপ করেন। তাহলেই সব সমাধান হয়ে যাবে।
ইসমাঈল খন্দকার বলেন, হাসপাতালটি ৩০ শয্যার অনুমোদন নিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে শিশু ভর্তির ক্যাপাসিটি কম। তাই অনেকেই এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগী ডা. নাছির হোসেনের পাঠানো বলে স্বীকার করে নেন তিনি।
এদিকে হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সেলিম মিয়া বলেন, হাসপাতালটি ২০ শয্যার অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি রোগী আজ ভর্তি রয়েছে, যা ঠিক হয়নি। তাই নিউজটি না করার অনুরোধ করেন তিনি।
তবে হাসপাতালটির সার্বিক বিষয়ে পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অবস্থানরত প্রফেসর ডা. নাছির হোসেনের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করলেও তিনি সাক্ষাৎ করেননি। তার কক্ষ থেকে ডা. সোহেল রানা নামের এক ব্যক্তি বের হয়ে বলেন, আপনাদের যা বলার আছে আমাকে বলতে বলেছে স্যার। এছাড়া আপনাদের কার্ড দিয়ে যান। পরে ফ্রি হয়ে স্যার যোগাযোগ করবেন। কিন্তু শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত ডা. নাছির হোসেন কোন যোগাযোগ করেননি এবং তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে মূল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে ডা. নাছির এবং কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের ডা. হুমায়ন কবির। তারাই এই হাসপাতালে পর্দার অন্তরাল থেকে পরিচালনা করে আসছেন। আর বিভিন্ন সমস্যায় সামনে আসেন সেলিম মিয়া। যে কারণে হাসপাতালের রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। ওই হাসপাতালে সব অনিয়মই নিয়ম।
এসব বিষয় জানতে যোগাযোগ করা হলে ডা. হুমায়ন কবির বলেন, ডা. নাছির হোসেন এবং তিনি এই হাসপাতাল ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। ডা. নাছিরই মূলত হাসপাতালের মালিক। বাকি মালিকদের কিছু শেয়ার রয়েছে।
মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মোকছেদুল মোমিন বলেন, রোববার আমার একটা ট্রেনিং আছে। সোমবার হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে। কোন অসঙ্গতি পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।