চট্টগ্রাম যেন ‘আন্দোলনের শহর’!

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

চট্টগ্রাম যেন ‘আন্দোলনের শহর/ছবি: বার্তা২৪.কম

চট্টগ্রাম যেন ‘আন্দোলনের শহর/ছবি: বার্তা২৪.কম

সকালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু), বেলা আরেকটু গড়াতেই চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে। বিকেলের সড়ক অবরুদ্ধ ছিল চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরোধে। আর সন্ধ্যার ষোলশহর স্টেশন থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দখলে। এভাবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সোমবার (৭ অক্টোবর) দিনভর চট্টগ্রাম শহর যেন ছিল আন্দোলনে মুখর।


অচল সিভাসু:

বিজ্ঞাপন

সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে সিভাসুতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে শামিল হন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তাঁরা যৌথভাবে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও টোটাল শাট ডাউন কর্মসূচি পালন করেন। এসব কর্মসূচির কারণে একেবারেই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে ক্যাম্পাসে। বন্ধ রয়েছে ক্লাস-পরীক্ষাসহ প্রায় সব দাপ্তরিক কার্যক্রম।

কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় সিভাসুর বয়স আজ ২৯ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পরে সিভাসুতে সকল বৈষম্য ও অপশক্তি দূর করে প্রতিষ্ঠানকে যখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে, তখন সেই প্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য উঠে পরে লেগেছে একটি চক্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রাযাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা। এটি কেবল অভ্যন্তরীণ একজন শিক্ষকের পক্ষেই জানা সম্ভব।'


শিক্ষাবোর্ডে অবরুদ্ধ চেয়ারম্যান:

দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। এবার দাবি আদায়ে আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা। সোমবার বেলা ১১টার দিকে বোর্ড চেয়ারম্যানের কক্ষ ঘেরাও করে আন্দোলন শুরু করেন পদোন্নতি বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী।

অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদ না থাকায় পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে শিক্ষাবোর্ডে। এর আগে ২০১৯ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ওই সময় সেকশন অফিসার পদ শূন্য না থাকলেও অর্গানোগ্রামের বাইরে গিয়ে ছয় কর্মচারীকে সেকশন অফিসার, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটরকে সহকারী প্রোগ্রামার পদে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া এসব পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ২০ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. মো. মোকছেদ আলীর সই করা এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব পদোন্নতির যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে লিখিতভাবে জানাতে বোর্ড চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যদিও পরে সেটি নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে পদোন্নতির বিষয় নিয়ে সরব হয় একটি বঞ্চিতরা। এ সময় বেশ কয়েকবার বোর্ড চেয়ারম্যানকে পদোন্নতির কার্যক্রমে গতি আনতে তাগাদা দেন তাঁরা। শেষে দাবি আদায় না হওয়ায় আন্দোলনে নামেন।

বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘১৯৯৫ সালে শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছি। আমাদের অনেকেই এক পদে ২১-২২ বছর ধরে একই পদে কর্মরত আছেন।অথচ ১৯৯৭ সালের প্রবিধানে স্পষ্ট বলা আছে ডেপুটি পর্যায়ের কর্মকর্তা পদে ৬০ শতাংশ স্থায়ী কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে পদোন্নতি দিতে হবে। আর সহকারী কর্মকর্তা পর্যায়ে শতভাগ পদোন্নতি দিতে হবে। কিন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ডেপুটি পর্যায়ের শতভাগ পদে বাইরে থেকে ডেপুটেশনে কর্মকর্তারা এসে বছরের পর বছর দখল করে আছেন। বোর্ডে তাঁদের অনেকের বয়স এক যুগ-দেড়যুগ হয়ে গেছে। তাঁদের মূল কর্মস্থল কোনটা সেটাও অনেকে ভুলে গেছেন। এমনকি অনেকে উপরের পদের কর্মকর্তা হয়েও পদ খালি না থাকায় নিচু পর্যায়ের পদগুলো দখল করে আছেন। কি মধু এই বোর্ডে।’

তবে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়েছেন পদোন্নতির বিষয়ে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আমরা এগোচ্ছি। সে অনুযায়ীই আমরা পদক্ষেপ নেব। পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আশা করি অচিরেই বাস্তবায়ন হবে।’


সড়কে ডায়াবেটিক হাসপাতালের কর্মকর্তারা:

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের বহিষ্কৃত সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদসহ নানা দাবিতে এবার সোমবার দুপুরে জাকির হোসেন সড়কে অবরোধ করেন হাসপাতালের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। তাঁদের বিক্ষোভের কারণে সড়কে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়।

আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন, নানা অনিয়মের অভিযোগে ২৫ জানুয়ারি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বাতিল করা হয়। এর পরও জাহাঙ্গীর চৌধুরী হাসপাতালটির কর্তৃত্ব ছাড়ছেন না। এ কারণে শনিবার দুপুর থেকে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ১৪ দফা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন।

বিক্ষোভরত কর্মচারীরা বলেন, ‘অবৈধভাবে সভাপতি পদে বসেছিলেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী। তিনি এখনো নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনকে ভালো ভালো পদে বসিয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর চৌধুরী প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৩১ কোটি টাকার হিসাব দেবেন না ততক্ষণ রোগীদের কষ্ট না দিয়েই আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।’

কর্মচারীদের দাবির মধ্যে রয়েছে, ২৪ বছরের প্রভিডেন্ট ফান্ডের হিসাব দেওয়া, কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি বন্ধ করা, স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা, দুর্নীতির তদন্ত করা, অবিলম্বে সমাজসেবা অধিদপ্তর জেলা প্রশাসকের অধীন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।


ষোলশহরে আবারও শিক্ষার্থীরা:

ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের পদচারণায় উত্তাল হয়ে উঠত ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও নানা দাবিতে শিক্ষার্থীরা এখানে মিছিল-সমাবেশ করেছেন। বেশ কিছুদিনের বিরতি শেষে আবারও মাঠে নামছেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার সাড়ে ৭টায় শুরু হবে তাঁদের কর্মসূচি। এর মধ্যেই শিক্ষার্থীরা ষোলশহরে জড়ো হচ্ছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রামের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ফেসুবকে এই আন্দোলনের ঘোষনা দেন। তিনি জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী বলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে চাকরিচ্যুত করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শহীদ আবরার ফাহাদের পঞ্চম শাহাদত-বার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভা করবেন তাঁরা।