পাবনা মানসিক হাসপাতাল এখন নিজেই রোগী
মানসিক রোগের চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র পাবনা মানসিক হাসপাতাল। দেশের মানুষের প্রত্যাশা, এখানে মিলবে মানসিক রোগের সর্বোচ্চ মানের সেবা। সুস্থ হয়ে উঠবেন রোগীরা। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও জনবল সংকটে দীর্ঘ সাড়ে ৬ দশকেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতাল এখন নিজেই যেনো রোগী।
প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এ সংকট ঘুচলে রোগীদের আধুনিক মানের সেবা দেওয়া সম্ভব বলছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই দ্রুত এসব সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, সরকারের মঞ্জুরিকৃত ৩১টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ১২ জন চিকিৎসক। এখনো পদ শূন্য রয়েছে ১৯টি। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ৭ জন কর্মকর্তার স্থলে রয়েছে ৩ জন। এখানেও শূন্য পদের সংখ্যা ৪টি। দ্বিতীয় শ্রেণির পদ সংখ্যা ৩১৬ জন বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ২৯৬ জন। এখনও পদ শূন্য ২০ জন। একইভাবে তৃতীয় শ্রেণির ১১৯টির বিপরীতে ৪২টি ও চতুর্থ শ্রেণির ১৭০টি পদের মধ্যে পদ শূন্য ১০৯টি। সর্বোপরি মোট ৬৪৩টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৪৪৯ জন। সবমিলিয়ে পদ শূন্য ১৯৪ জন। এছাড়াও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, সিনিয়র কনসালটেন্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট, ডেন্টাল সার্জন’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ এখনও শূন্য।
১৯৫৭ সালে ১১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই মানসিক হাসপাতাল। দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই এই হাসপাতালটি মানসিক চিকিৎসায় ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ৬০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানটি এখন ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রশাসনিক অবকাঠামো পরিচালনার জন্য রয়েছে ব্যাপক জনবল সংকট। এই হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি সেবার মান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আগের নিয়মেই দেওয়া হয় ব্যবস্থাপত্র। এখনোও পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনে চলে বহিবির্ভাগে আসা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৫০০ শয্যার এই মানসিক হাসপাতালে প্রধান ফটকের প্রবেশ মুখে সড়কের বেহাল দশা। ভর্তি হওয়া আবাসিক রোগীদের আবাসস্থলও বেশ পুরোনো। যার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের পড়তে হয় নানান সমস্যায়।
পাবনার ঈশ্বরদী মুলাডুলি থেকে আসা মানসিক রোগীর স্বজন মোজাম ও রংপুর থেকে আসা অনিক নামের এক ব্যক্তি জানান, বহিবির্ভাগে ডাক্তার দেখাতে ঈশ্বরদী ও রংপুর থেকে ভোরে এসেছেন তারা। তারা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসার মান ভালো হলেও বহিবির্ভাগে মাত্র দুই জন ডাক্তার ও অন্যান্য পদে জনবল সংকট থাকায় সিরিয়াল নিয়ে রোগী দেখাতে গিয়ে অনেক সময় লেগে যায়। এতে করে দূর থেকে আসা রোগীর স্বজনরা রোগী হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
কথা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আরেক মানসিক রোগীর স্বজন মো. গফুরের সঙ্গে। তিনি জানান, মানসিক সমস্যার জন্য ছোট ভাইকে বহিবির্ভাগে ডাক্তার দেখিয়েছেন তিনি। ভাইয়ের মানসিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার ভর্তি করার পরামর্শ দেন তাকে। তবে বহিবির্ভাগে সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তার দেখাতে দেরি হওয়ায় এবং হাসপাতালে স্বজনদের থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ.কে.এম শফিউল আযম জানান, পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৫০০ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসক অনেক কম। আমরা স্বল্প জনবল নিয়েই সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে মানসিক রোগী আসে। আমরা রোগীদের যদি কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে চাই। তাহলে আরও বেশি জনবল প্রয়োজন। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যারা আমাদের কাজে সহযোগিতা করে।
এবিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন, প্রতিদিন এই হাসপাতালে ২০০ থেকে ৩০০ রোগীকে বহিবির্ভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সবসময় হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন রোগী ভর্তি থাকে। মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতালে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছে মাত্র ৪ জন।
তিনি জানান, হাসপাতালে দীর্ঘদিন ডেন্টাল সার্জনের পদ শূন্য থাকায় দাঁতের বিভিন্ন রোগ ঝুঁকিতে আছে মানসিক রোগীরা। এছাড়াও হাসপাতালের অবকাঠামো বেশ পুরাতন হওয়ায় ঝুঁকির মধ্যেই চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। তিনি আরওবলেন, হাসপাতালে নারী নার্স পর্যাপ্ত থাকলেও পুরুষ নার্স সংকট থাকায় রাতের ডিউটি নিয়ে নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
ডা. মো. শাফকাত ওয়াহিদ জানান, রোগী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটি ধারণা শুধু এই হাসপাতালেই মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। বিষয়টি আসলে তা নয়। এখন প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই না জেনে কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসে।
তিনি বলেন, এখানে তো সব ধরনের রোগী ভর্তি করা হয় না। চিকিৎসকদের প্রাথমিক পরামর্শক্রমেই এখানে রোগী ভর্তি করা হয়।