ঢালাও মামলা, ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হতাহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা করে বাছবিচার ছাড়াই আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে কয়েকটি চক্র মেতেছে মামলাবাণিজ্যে।

রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এতে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে আহত ও নিহতদের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর থেকে ১৩ অক্টোবর (রোববার) পর্যন্ত সারা দেশে দায়ের হওয়া প্রায় ১২ হাজার মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৩২ হাজার জনের বেশি। যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলা।

সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে গঠিত স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। প্রাথমিক তালিকায় মোট এক হাজার ৫৮১ জন নিহতের তথ্য জানিয়েছে তারা। তবে সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৭১৭ জন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ এবং অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, নিহতদের অধিকাংশেরই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়নি। যে অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে আলামত হিসেবে সেগুলোও উদ্ধার বা শনাক্ত নেই। উদ্ধার হয়নি হত্যায় হত্যায় ব্যবহৃত বা গুলির খোসা। আবার অনেক আগেই মারা গেছে- এমন ব্যক্তিদের অনেককে এজাহারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যাকাণ্ড চালানোর কথা উল্লেখ করে আসামি করা হচ্ছে।

অধিকাংশ মামলাতেই দেখা গেছে, বাদী সব আসামি বা সাক্ষীকে চেনেন না। মামলায় অপরাধ প্রমাণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন দুর্বল দিকগুলো ভাবিয়ে তুলেছে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের। অনেকেই মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে আলোচিত এসব মামলা তদন্তের জন্য পুলিশ ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীকে আসামি করে ঢালাও মামলা হয়েছিল। যে ঘটনা ঘটেনি, সেই অভিযোগে করা এসব মামলা গায়েবি মামলা নামে পরিচিতি পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা এবং দলটির সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলায় তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।

বাছবিচারহীন মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বিএনপিও। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মামলা নথিভুক্ত করার আগে প্রাথমিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশের প্রতি। সম্প্রতি তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খাগড়াছড়িতে ঘটনা ঘটলে, মামলা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এমন কোনো মামলা দেবেন না, যার সারবস্তু থাকবে না।

আইন ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার লক্ষ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। জেলা পর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে কমিটির সভাপতি, পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটরকে (মহানগর এলাকার মামলাসমূহের জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর) সদস্য এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু তদন্তের জন্যও একটি পৃথক সেল করা দরকার। এতে করে মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতা থেকে রেহাই পাবে। ক্ষতিগ্রস্তরাও সঠিক বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন না।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর শুরু হয়েছে ভিন্নধারার গ্রেফতার অভিযান। আগস্টে গ্রেফতার হয় ৮ হাজার ৫৫৯ জন। সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ১৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী। অক্টোবরে এসে গত শনিবার পর্যন্ত ৯ হাজার ৪৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আরও জানা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা-হত্যার ঘটনায় গত ৬ আগস্ট থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সাবেক ও বর্তমান ৪৫১ পুলিশ কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ২০ জন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, ১১ জন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ৪২ জন পুলিশ সুপার এবং ২৬ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার। সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হকসহ ১৭ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এদের প্রায় সবাই হত্যা মামলার আসামি।

ঢালাও মামলার বিষয়ে অপরাধবিষয়ক সিনিয়র আইজীবী ব্যারিস্টার খালিদ আদনান বলেন, ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ফৌজদারি আইনে অধিকাংশ মামলা হয়েছে থানায় বা আদালতে। এসব মামলায় হুকুমের আসামিও রয়েছেন। ফৌজদারি আইনে একটি হত্যা মামলার অপরাধ তদন্তে এবং বিচারে কিছু আলামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। যেমন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। এতে করে আঘাত এবং মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যায়।আরেকটি হচ্ছে, হত্যার ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হলে ব্যবহৃত অস্ত্র ও বুলেট শনাক্ত এবং সেগুলো উদ্ধার করা। সেগুলো কি সম্ভব হয়েছে? আমার জানা মতে, সিংহভাগ ঘটনাতেই হয়নি। সংঘর্ষে মারা গেলেও কার গুলিতে বা কোন অস্ত্রের গুলিতে মৃত্যু ঘটেছে তাও নির্ণয় করা জরুরি। এখানে সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না? হুকুমদাতার নাম আছে, কিন্তু হুকুম পালন করে কে হত্যা করল সেটা তদন্তে বের হয়ে আসতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এই ধরনের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা হলে ভালো হতো। এখনও সেটা করা সম্ভব। এমনও ব্যক্তি আছেন যার বিরুদ্ধে দেড় থেকে দুইশ মামলা হয়েছে। এখন বিচ্ছিন্নভাবে এসব মামলার তদন্ত করতে গেলে এবং আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে কত বছর লেগে যাবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। এতে তদন্ত ও বিচার শেষ করতে অনেক সময় পার হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।