কাজের সময় ডিসটার্ব করবেন না, নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে চসিক মেয়র
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ও সাবেক নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন তাঁকে কাজের সময় ডিসটার্ব করার জন্য নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ সে রাজনীতি এ সিটি করপোরেশনের বাইরে। আমি আমার সমস্ত নেতাকর্মীদের বলতে চাই- আপনারা আমাকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করবেন না। আমি আপনাদের সাথে রাজনীতি করবো ৫টার পরে। ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এখানে কোন ধরনের রাজনীতির আলাপ নিয়ে কেউ আসবেন না।'
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর লালদিঘীর পাড়ে চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
মেয়র ডা. শাহাদাত বক্তব্যের শুরুতে বলেন, এমন একটি সময়ে আমি দায়িত্বভার নিয়েছি যখন দেশ একটি ক্রান্তিকাল পার করছে, একটা ক্রাইসিস মোমেন্টের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে, আমাদের মা-বোনেরা ইজ্জত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা এপথে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছি। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ ওয়াসিম, আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধের মতো হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েও আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। আমরা বারবার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পথে বাধাগ্রস্ত হয়েছি।
চসিকের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাড়ে তিন বছর আগে যে নির্বাচনটা হয়েছিল ইভিএমের মাধ্যমে, কিন্তু আমাকে ফলাফল দেয়া হয়েছিল হাতে লিখে। যেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ১০০ ভোট পেয়েছেন, সেটাকে ৩০০ বানিয়ে হাতে লেখা একটা ফলাফল দিয়ে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। তখন আমি আদালতের কাছে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমাকে ইভিএমের প্রিন্টেড কপি দেন, আমি গ্রহণ করবো, আমি হাতে লেখা কপি গ্রহণ করবো না। আমি আইনের পথে গিয়েছিলাম, রায় পেয়েছি এবং আজ আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি।
এরপর তিনি সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা শুরু করেন। ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি সম্প্রতি বেশ কিছু টকশোতে অংশ নিয়েছি। অনেক মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। সবখানে আমি একটি কথা তুলে ধরেছি, সেটি হলো নগর সরকার। নগর সরকার যদি প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে সমস্ত সেবাদানকারী সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনা যাবে। কাজেই সিটি করপোরেশন যেহেতু এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেটি জনপ্রতিনিধিদের অধীনে পরিচালিত হয়। তাই সমস্ত সেবাপ্রদানকারী সংস্থা যদি কাজ করে তাহলে পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নগর সরকার বাস্তবায়ন সময়সাধ্য ব্যাপার এটা যেহেতু সময়সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো যেসব সেবাপ্রদানকারী সংস্থা আছে তাদের সাথে সমন্বয় করার।
চট্টগ্রামে মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মশক নিধনে যে স্প্রে ব্যবহার করা হয় সেটি আমি পরীক্ষা করতে চাই। এমন কোন স্প্রে আমি চাইনা যে স্প্রে দিলে মশা লাফ দিয়ে ওড়ে যাবে। মশা মরছে কি না সেটা দেখতে হবে, না মরলে সে ওষুধ আমি গ্রহণ করবো না। ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেল সেন্টার চসিকের উদ্যোগে করতে এবং একটা হটলাইন দ্রুতই হবে। যেকোনো জায়গায় কোনো ডেঙ্গু রোগী যদি থাকে কোনো সমস্যায় পড়ে তিনি হটলাইনে কল করবে; আমরা যারা ডাক্তার আছি তারা কাউন্সিলিং করবো। এছাড়া, যদি কোনো জায়গায় ফগিং স্প্রে যদি কোথাও না হয় আমাদের সেখানে সরাসরি যেতে হবে কাজ করতে হবে। কেউ যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যায়, পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর যদি বুঝতে পারি যে তার বাজে অবস্থা তাহলে আমরা ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেল সেন্টারের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা নিব।
'আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই। অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৪১ ওয়ার্ডে আমি কর্মসূচি দেব। আমাদের প্রধান সমস্যা, ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লিফলেট বিলি করতে হবে। আরেকটি জিনিস চিন্তা করছি, ৪১ ওয়ার্ডে অভিযান চালাবো। সেখানে যে সচিবরা রয়েছে, তাদের উদ্যোগে সেখানে ডেঙ্গু হেল্প ম্যানেজমেন্ট সেন্টার থাকবে। আমাদের কার্যালয়ে এসে তারা কথা বলতে সেখান থেকে সিরিয়াস রোগীগুলো আমরা সুনির্দিষ্ট হাসপাতালে সেবার ব্যবস্থা করবো। আমাদের মনে রাখতে হবে, যখনই কোনো জরুরি আসে সেটার উপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এখন জরুরি হচ্ছে ডেঙ্গু এবং ক্লিনিং অ্যাকটিভিটিস। এদিক দিয়ে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ওটার ওপর কাজ করতে হবে।'
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হুশিয়ারি করে মেয়র ডা. শাহাদাত বলেন, আমি নিজে সব স্পটে যাব। সকালে বেশিক্ষণ অফিসে থাকবো না। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা। এরপর আমি নিজেই বেরিয়ে যাব। পরিচ্ছন্নতা বিভাগের লোকজন, মশক নিধনের দায়িত্বে যারা আছে তারা আমার সঙ্গে থাকবেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ২ হাজার কর্মী কাজ করছে। আমি প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে স্বশরীরে তাদের দেখতে চাই। যদি কাউকে আমি না দেখি, আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি, তাদের চাকরি হয়তো নাও থাকতে পারে। আমাকে অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কারণ আমি বারবার বলছি আমি এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য এ সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে এসেছি।
ভবন মালিক-ব্যবসায়ীদের পরিচ্ছন্নতায় জোর দিয়ে মেয়র বলেন, ‘যে দোকানগুলো আছে, আপনাদের দোকানের সামনে ডাস্টবিন বসিয়ে দেব। আপনাদের দোকানের সামনেও যদি কোন ময়লা পড়ে থাকে তাহলে বিনে ওঠাবেন। নয়তো আমি আইনগত ব্যবস্থাতে যাব। হোল্ডিং ট্যাক্স নয়তো ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অভিযান আমি নিজেই পরিচালনা করবো। আপনারা কর্মকর্তারা আমার সাথে থাকবেন। আমি রাজনীতি করেই বড় হয়েছি। আমাকে ভয় দেখাবেন না’
প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন বলে দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, আজকে টার্ফ হয়ে একটা শ্রেণি সেখানে তার বাচ্চাদের খেলতে দিতে পারছে না। এতে সমাজের মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। একটা নিম্নবিত্ত বা গরীব বাচ্চারা সেখানে খেলতে পারছে না। সাইকোলজিক্যালি তারা যে ডিমোটিভেট হচ্ছে এ কথাগুলো আমরা বুঝতে পারছি না। এ জিনিসগুলো কিন্তু আমাদের মানবিক হতে হবে। আমি অবশ্যই এসব বিষয়গুলোতে নজর দিব। ছোট একটা মোবাইলের মধ্যে আমাদের চোখ চলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ আমরা সেদিকে চোখ দিয়ে রাখছি। এটার কারণে আমাদের চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নার্ভের সমস্যা হচ্ছে; এক কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সোসাইটির সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। সুস্থ দেহে সুন্দর মন সেটা নেই একদম হারিয়ে গেছে। তাই প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটা একটা খেলার মাঠ চসিক থেকে এ উদ্যোগটি অবশ্যই নিব।
চসিকের প্রিমিয়ার উদ্ধারের কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় যেটা প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, এটি চসিকের টাকা দিয়ে কেনা। আজ এটা বেদখল হয়ে গেছে। আমরা যারা রাজনীতি করি, আমরা শুধু মুখে বড় বড় কথা বলি। যখন ক্ষমতা চলে যায় তখন ঘরে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। মানুষের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমরা নিজের নামে করে ফেলি। এটাই হচ্ছে আমাদের বড় রোগ। এ জায়গা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উদ্ধার করতে হবে। আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি, এটা আমি করবো ইনশাআল্লাহ।
বাড়তি হোল্ডিং ট্যাক্সের দরকার নেই জানিয়ে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমার হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। যেই হোল্ডিং ট্যাক্স আমরা আগে দিয়ে আসছি, সেই হোল্ডিং ট্যাক্স যদি আমরা ঠিকমতো পাই; ইনশাআল্লাহ চসিকে বেতন দেওয়ার জন্য আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।হোল্ডিং ট্যাক্সগুলো আমরা নিতে পারছি না বিভিন্ন কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। আগের যে হোল্ডিং ট্যাক্স দিত সেটাও এখন দিচ্ছে না। আমি জানি অনেকেই দিচ্ছে না। ৩০-৪০ শতাংশ দিচ্ছে না। তাই একটা জায়গায় এসে এগুলো আমাদের শেষ করতে হবে। শেষ করেই যেই জায়গায় হোল্ডিং ট্যাক্স আমরা দিতাম, আপনারা আগে যেটা দিতেন সেটাই একুরেট দেন।
এসময় চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। পরে সন্ধ্যায় মেয়র ডা. শাহাদাত নগরীর টাইগারপাসে চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে যান। সেখানে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পর তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেন।