হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মৃৎশিল্প
কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। প্রযুক্তির আর উন্নয়নের ছোঁয়ায় মাটির তৈরি এসব জিনিসের বদলে ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক-অ্যালুমিনিয়াম- স্টিল ও সিরামিকসহ অন্যান্য সামগ্রী। তাই আধুনিক প্রযুক্তির তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাটির তৈরি অনেক পণ্যই হারিয়ে যাচ্ছে । তবে মাটির তৈরি কিছু তৈজসপত্র এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। শহরবাসীর দালান-কোটা সাজাতে মাটির তৈরি নানা পট-পটারি সহ ফুলদানি ও বাহারি মাটির হাঁড়ির ব্যবহার রয়েছে এখনো।
এদিকে ৩০ বছর আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে মৃৎশিল্পের দাপট ও কদর দুটোই ছিল। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় দুই হাজারের অধিক পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে ব্যস্ত সময় পার করতেন। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হতো দেশের বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু বর্তমানে এ জেলায় প্রায় তিন শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। আগের মতো চাহিদা আর পারিশ্রমিকের ন্যায্যমূল্য না থাকায় এ পেশার লোকজন অত্যন্ত দুঃখ আর হতাশার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া গ্রামের কুমারপল্লীতে ঢুকলেই চোখে পড়বে তাদের কষ্টের জীবনযাত্রা। এ যেন গোটা পল্লীতেই লেগে আছে শত শত দঃখ, কষ্ট আর অভাবের ছোঁয়া।
কৃষ্ণপাল নামে মৃৎশিল্পী বলেন, আমি এ কাজ করি দশ বছর থেকে কিন্তু দশ বছর আগে যা চাহিদা ছিল এখন আর নেই। আমাদের সবকিছু কিনতে অনেক খরচ বেড়ে গেছে তাই আগে মতো আয় আসেনা। চাহিদা কমে গেছে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। আগের তুলনায় বেচাকেনা খুবই কম, তাই সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ।
স্থানীয় কুমাররা জানান, আগে যে মাটি এক থেকে দেড় হাজার টাকায় কিনতাম, এখন সেই মাটি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালানির দাম বেড়েছে । শুধু বাড়েনি মৃৎশিল্পদের পারিশ্রমিক। আমরা অনেক দিন থেকে এই ব্যবসা করি কিন্তু এখন আমাদের টিকে থাকার আর কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। এই কাজে অনেক পরিশ্রম করতে হয় অনেক সময় দিতে হয়। খরচ বাদ দিয়ে যে সামান্য আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকম খেয়েপড়ে বেঁচে আছি। পরবর্তী ছেলে মেয়েদের জন্য যে কিছু রেখে যাব, সে ব্যবস্থাও নেই আমাদের। আমরা চাইনা আমাদের ছেলে মেয়ে কাজ করুক, আমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করে অন্য কিছু করবে তবে এ কাজ করতে দিবো না। তবে সরকার যদি আমাদের কিছু সহায়তা করে আমরা এই মৃৎশিল্প কে ধরে রাখার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমরা সরকারের কাছে থেকে কোনো সুরাহা পায়না।
বাজারে এখন মৃৎশিল্প মাটির তৈরির পণ্যের কোনো কদর নেই। ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি ক্রমশই কমে যাচ্ছে। আগে মাটির তৈরি বাসন ছাড়া বাঙালি পরিবারগুলোর দিন চলত না। বিশেষ করে অনুষ্ঠানেও খাবার পরিবেশন হতো মাটির তৈরি বাসনে। এখন আর এমন চাহিদা না থাকায়, এই মৃৎশিল্পটি হারিয়ে যাবে।
স্থানীয়দের দাবি, সরকার যদি এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক। নাহলে একসময় মৃৎশিল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে।