নিয়োগ পেয়েও দায়িত্বে বসতে পারছেন না চাঁদনী চকের প্রশাসক
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার সবচেয়ে বড় মার্কেট ’চাদনী চক’। একাধিক ভবনে শতশত দোকান নিয়ে গঠিত মার্কেটটিতে দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রের শেখ ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে মার্কেটটি উদ্ধার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সমাজ সেবা অধিদফতরের অভিযোগ দিলে তদন্তে নামে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
তদন্তে নির্বাচনে কারচুপি ও সদস্যদের হয়রানি নির্যাতনসহ নানা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে কমিটি বিলুপ্ত করে একজন প্রশাসক নিয়োগ করে সমাজ সেবা অধিদফতর। তবে নিয়োগ পাওয়ার পর মাসখানিক সময় কেটে গেলেও মার্কেটে প্রবেশ করতে পারেন নি এই কর্মকর্তা। বরং অভিযোগ উঠেছে মার্কেটটির সাবেক কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বারবার প্রশাসককে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কার্যালয়ে প্রবেশে বাঁধা দেন। সাধারণ ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রশাসক নিয়োগ হলেও পুলিশের নীরব ভূমিকার কারণে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারছেন না এই কর্মকর্তা।
চাঁদনী চক মার্কেট সূত্রে জানা গেছে, চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ায় মার্কেটটির পুরনো ব্যবসীয় হাফেজ মো. ইসরাইলকে অন্যায়ভাবে সদস্য পদ বাতিল করেন সাবেক কমিটির সভপতি ও সাধারণ সম্পাদক। নিজের সদস্য পদ ফিরে পেতে সমাজসেবা অধিদফতরের সাভার উপজেলা কার্যালয়ে আবেদন করেন ইসরাইল। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি বাতিল ও প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা কে এম শহীদুজ্জামান। পরবর্তীতে সমাজসেবা অধিদফতর কমিটি বাতিল করে শহর সমাজসেবা কার্যালয়-১ এর কর্মকর্তা মো. নুর ইসলামকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নিয়োগ পাওয়ার পরে গত ২৩ অক্টোবর মার্কেটের বিজনেস ফোরামের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গেলে বাঁধা দেয় সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন হাওলাদারের সহযোগীরা। দুই বার একই ভাবে কার্যালয়ে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন প্রশাসক নুর ইসলাম।
এদিকে প্রশাসক নিয়োগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ২৭ অক্টোবর রিট করেন সাধারণ সম্পাদক মনির। শুনানি শেষে আদালত একই দিনে খারিজ করে দেয়। পরবর্তীতে ৪ নভেম্বর চেম্বার আদালতে গেলে আদালত আপিল বিভাগে পাঠায়। এই আবেদনের শুনানি হওয়ার আগে রিটের তথ্য গোপন করে উচ্চ আদালতের ২৪ নম্বর কোর্টে আবারও রিট করেন মনির। বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে আদালত রিট খারিজ করে দিয়ে আবেদনকারীকে প্রতারক উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকা আবেদনটিও খারিজ হয়ে যায়।
অভিযোগ আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাপসের অঘোষিত পিএস ছিলেন চাঁদনী চকের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন। মেয়র তাপসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন নিজাম। আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য নিজাম এখনো নিউ মার্কেট এলাকায় নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে তৎপর রয়েছেন। আদালত পাড়ায় তাপসের কিছু সহযোগীদের সহায়তায় আদালতে বারবার রিট করে যাচ্ছেন নিজাম ও মনির।
এছাড়া নিজামের অন্যতম সহযোগী মনিরও তাপসের প্রভাব বিস্তার করে চলতেন। তিনি মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার যশলং ইউনিয়নের নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছিলেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটা সময়ে চাঁদনী চক মার্কেটের কর্মচারী ছিলেন নিজাম। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয় ও সাবেক মেয়র তাপসের প্রভাব খাটিয়ে চাঁদনী চক মার্কেটে দোকান মালিক বনে যান। ভোট কারচুপির মাধ্যমে সভাপতি হয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছেন নিজাম উদ্দিন। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। দোকানে তালা লাগিয়ে চাঁদা আদায়, দোকান দখলেরও বহু অভিযোগ রয়েছে। নিজামের দৌড়াত্ব চাঁদনি চক ছাড়িয়ে আশেপাশের মার্কেটেও পৌঁছে গিয়েছিলো। পার্শ্ববর্তী বলাকা মার্কেটসহ আশেপাশের অনেক মার্কেটের ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীদের নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে তাপসের এই অন্যতম সহযোগীর বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, নিজাম উদ্দিন ও মনির চাঁদনী চক মার্কেটের সকল বিশৃঙ্খলা ও বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত। তাদের মাধ্যমে নির্যাতিতদের মধ্যে অন্যতম সভপতি প্রার্থী ইসরাইল। ইসরাইল ছাড়াও শত শত ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। চাপে রাখতে ব্যবসায়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে নানা অভিযোগ তোলা হতো।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি হামলায় জড়িত থাকলেও অদৃশ্য কারণে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে নিজামের। নিজামের নাম বাদ দেওয়া মামলার আবেদন ও এজাহার কপি বার্তা২৪.কমের হাতে এসেছে। মামলার আগে ও পরের দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু নিজাম উদ্দিন না আর একাধিক ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এমন কি নিজামের নাম বাদ দিয়ে সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নাম যুক্ত করা হয়েছে।
মামলার আবেদনে নাম থাকলেও স্বাক্ষর হওয়া এজাহারে নাম না থাকার বিষয়ে অবৈধ লেনদেনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মামলা থেকে তাপসের অন্যতম সহযোগী ও আওয়ামী লীগ নেতা নিজামসহ একাধিক ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে মামলার বাদীও জড়িত।
এ দিকে মামলা থেকে তাপসের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলন বলেন, মামলা থেকে কারো নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বাদী যদি কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে নাম বাদ দেয় তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। তবে এই ঘটনায় যদি কেউ লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্ত করে দেখবো।
তিনি আরও বলেন, মার্কেটের প্রশাসককে আমরা বলেছি মামলা করেন। যারা বাঁধা দেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাঁদনী চক মার্কেটের কমিটি বাতিল করে প্রসাশক নিয়োগ হলেও তাকে প্রবেশে বাঁধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীন উদ্দিন বলেন, প্রশাসককে বসতে বাঁধা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের না। আদালত আমাদের কোনো নির্দেশনা দেয় নি। তারা কীভাবে কার্যক্রম চালাবে সেটা তাদের বিষয়।
হত্যা চেষ্টা মামলা থেকে চাঁদনী চক মার্কেটের সভাপতির নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। বাদী যে এজাহার দিয়েছে আমরা সেই মামলা নিয়েছি। মামলা হওয়ার আগে যদি বাদী নাম বাদ দেয় তাহলে সেখানে আমার কিছু করার নেই।
সমাজ সেবা অধিদফতরের নিয়োগকৃত প্রশাসককে কার্যালয়ে প্রবেশে বাঁধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের সভাপতি নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সমাজ সেবা অধিদফতর আমাদের কমিটি বাতিল করার অধিকার রাখে না। তারা অন্যায়ভাবে কমিটি বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। মার্কেটের স্বার্থবিরোধী কাজ করায় একজনের সদস্য বাতিল করা হয়েছিলো। তার আবেদনের তদন্তের নামে টাকা খেয়ে এই কাজ করেছে।
উচ্চ আদালত রিট খারিজ করে দিলেও তথ্য গোপন করে আবারও রিটের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন নিজাম। ধমকের সূরে বলেন, এই তথ্য আপনাকে কে দিলো। আপনি এই বিষয়ে প্রশ্ন করছেন কেনো। এই বলে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন। পরবর্তীতে আবারও ফোন করা হলে তিনি কল কেটে দেন।