ময়মনসিংহ লাইনে চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়া যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে । সংশ্লিষ্টরা বলছে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণে চলাচলের সময় ত্রুটি দেখা দেওয়ায় এ বিপর্যয় শুরু হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে বিকল্প ইঞ্জিন দিয়েই ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনায় শিডিউল বিপর্যয় ও যাত্রী ভোগান্তি বাড়ছে। ইঞ্জিন সংকটে ইতিমধ্যে তিনটি ট্রেন বন্ধও হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে ময়মনসিংহ-ঢাকা-জামালপুর, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ ও জারিয়াগামী, এবং জামালপুর-চট্টগ্রামগামী ট্রেন চলাচল করে। ময়মনসিংহ জংশন হয়ে মোট ২৮ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। ট্রেনের ইঞ্জিন সংকটের কারণে ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী দুটি লোকাল ট্রেন ও ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরগামী ধলেশ্বরী নামে একটি ট্রেন চলাচল ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ লোকোসেডের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনে ব্যবহার হওয়া ২ হাজার থেকে ৩ হাজার সিরিজের ইঞ্জিনগুলো বহু আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০ সিরিজ, ২ হাজার ৫০০ সিরিজ ও ২ হাজার ৮০০ সিরিজের ইঞ্জিন রেলপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ইঞ্জিনগুলো দিয়ে চলছে ট্রেনগুলো। বিকল হওয়া ট্রেনের ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইঞ্জিনগুলোতে ইঞ্জিনের চাকা ঘুরানোর জন্য যে ট্রাকশন মোটর রয়েছে সেটির ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণেও বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ দুই ধরণের জটিলতা সবচেয়ে বেশি।
রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর থেকে মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) পর্যন্ত ৩৮ দিনে একটি লাইনচ্যুত ও ১২টি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মঙ্গলবার সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আউলিয়ানগর এলাকায় মোহনগঞ্জগামী বলাকা কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। পরে উদ্ধারকারী ট্রেনে এলে ২ ঘণ্টা পর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এ সময় ঘণ্টাখানেক ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এদিকে একই দিন সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিনও সকাল ৮টার দিকে বিকল হয়ে যায়। পরে বিলম্বিত সময়ে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
গত সোমবার সন্ধ্যায় মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ময়মনসিংহ নগরের শম্ভুগঞ্জ এলাকায় ইঞ্জিন বিকল হয়। গত রোববার রাতে জামালপুরের তারাকান্দি থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর অগ্নিবিনা এক্সপ্রেস ট্রেন ময়মনসিংহ জংশন এলাকায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে ২ ঘণ্টা বিলম্বে যাত্রা করে।
গত ২৯ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ১টার দিকে ত্রিশালে ধলা স্টেশনের আউটার এলাকায় মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পিয়ারপুর এলাকায় আটকা পড়ে। একই দিন ইঞ্জিন সমস্যার কারণে ময়মনসিংহ থেকে জারিয়াগামী লোক ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়।
গত ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল ও একটি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ময়মনসিংহ জংশন এলাকায় লাইনচ্যুত, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ভুয়াপুরগামী নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ময়মনসিংহ জংশনে ইঞ্জিন বিকল হয়। একই দিন ত্রিশালের আউলিয়ানগর এলাকায় ঢাকা থেকে দেওয়ানগঞ্জগামী দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ জংশনে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। গত ২ ডিসেম্বর সকালে গফরগাঁও উপজেলার মশাখালী রেলওয়ে স্টেশনে জামালপুর কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটে। পরে বিকল্প ইঞ্জিনে ৫ ঘণ্টা পর ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্য ছেড়ে যায়।
এদিকে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন। একটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে অন্য ট্রেনগুলোকেও আটকে থাকতে হয়। একটি ট্রেনের পাশাপাশি অন্য ট্রেনের যাত্রীদেরও ভোগান্তি হয়।
নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ ফোরামের কো-অর্ডিনেটর সাঈদ ইসলাম বলেন, পুরাতন ইঞ্জিনগুলো বিকল হবার পূর্বে কি কারণে রুটিন চেকাপের মাধ্যমে ইঞ্জিনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ম্যানেজমেন্ট আপডেটের ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা যথেষ্ট সন্দেহজনক। একদিকে অতিরিক্ত হারে বাসের ভাড়া বাড়ানো অন্যদিকে ট্রেনগুলোকে বিকল করে ফেলা যথেষ্ট সন্দেহজনক। স্বস্তিদায়ক যাত্রার জন্য ট্রেনগুলোকে উপযোগী করে তোলার দাবি জানাচ্ছি আমরা।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে লোকো সেডের ইনচার্জ মোহাম্মদ ফারুক হোসেন খান বলেন, চলাচলকারী ইঞ্জিনগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন থাকার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। মেরামতের পর্যাপ্ত মালামালের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয়ভাবে মেরামত করার পর পুনরায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ইঞ্জিনগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ায় মেরামত করার পরে টেকসই হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে রুগ্নতা দেখা দিয়েছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, লোকোসেড ও জংশন স্টেশনে দুটি বিকল্প হিসেবে দুটি ইঞ্জিন সার্বক্ষণিক থাকার কথা থাকলেও বিপর্যয়ের কারণে স্টকে আর কোনো ইঞ্জিন থাকছে না। আমাদের ৮১ জন জনবলের মাধ্যে কর্মরত আছে মাত্র ২৯ জন। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতেও সমস্যা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন সুপারিটেনডেন্ট নাজমুল হক খান বলেন, একেকদিন একেক জায়গায় একেক ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। এর কারণে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে, যাত্রী হয়রানি বাড়ছে এবং আমাদের জবাবদিহিতা বাড়ছে।