হাইব্রিড ধানের দাপটে বিলুপ্তির পথে বরিশালের বালাম চাল
এক সময়ে ঐতিহ্যবাহী চিকন বালাম চালে বিখ্যাত ছিল বৃহত্তর বরিশাল। প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে নদীবিধৌত পলিসমৃদ্ধ জমিতে রোপা আমন মৌসুমে বালাম ধানের চাষ হতো। সুস্বাদু এই বালাম চালের ভাত খেয়ে তৃপ্ত হতেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
কথিত আছে, বালাম চাল দেখে অবাক হয়েছিলেন চীনের পর্যটক হিউয়েন সাং। এছাড়াও বাংলার চালের ভূয়সী প্রশংসা করেন মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা। সে সময়ে এলাকার কৃষকদের বালামি উপাধি দিয়েছিলেন খাদ্য রসিকরা। কিন্তু ২০/২৫ বছর আগেও বালাম ধান-চালের অস্তিত্ব মিললেও তা এখন বিলুপ্ত।
কম ফলন আর অধিক সময়ে উৎপাদিত বালাম ধানের জায়গায় দখল করে নিয়েছে কম সময়ে অধিকতর ফলনশীল উফশী ও হাইব্রিড জাতের ধান। বছরের তিন মৌসুমে হাইব্রিড জাতের ধানের অধিক ফলনে খুশি আর লাভবান হওয়ায় বালাম ধান আবাদে আগ্রহ নেই কৃষকদের। ফলে বরিশাল থেকে হারিয়ে গেছে বালাম ধানের অস্তিত্ব।
এছাড়াও এখন আর শোনা যায় না 'বাংলাদেশের অভাব কী ভাই বাংলাদেশের অভাব কী/বরিশালের বালাম চাল আর ঢাকার আছে গাওয়া ঘি।' বরিশালের ধান নিয়ে রচিত এই গানটি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বরিশাল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্যের জোগান দিতে বাড়তি চালের উৎপাদন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে আস্তে আস্তে কমতে থাকে বরিশালের স্থানীয় বালাম ধান। বাড়তে থাকে উচ্চ ফলনশীল উফশী ও হাইব্রিড ধানের চাষ। এ কারণে এ অঞ্চলের মাঝারি উঁচু জমিতে আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী বালাম ধানের জায়গা দখল করে নেয় এসব উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান।
আরো জানা গেছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা অনুযায়ী ধান উৎপাদনে বছরের তিন মৌসুমে ( রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ ) শতাধিক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে।
প্রতি বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ মাস পর্যন্ত রবি মৌসুম বোরো ধান, ১৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আউশ ধান এবং ১ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত আমন ধানসহ বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করছেন কৃষকরা।
জেলায় বর্তমানে বালাম ধানের পরিবর্ততে অল্প জমিতে বিআর-১৬ জাতের শাহী বালাম নামে আরেক ধানের চাষ করছে কৃষকরা। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ধান মৌসুমে শুধু উজিরপুরে ২০ হেক্টর ও গৌরনদী উপজেলায় ৫৫ হেক্টর জমিতে এ শাহী বালাম ধানের চাষ করেছে কৃষকরা।
এর আগে একটা সময় বানারীপাড়া উপজেলার নলেশ্রী, দিদিহার, দাণ্ডয়াট, বাইশারী, মসজিদ বাড়ী, আউয়ার কালি বাজার, খোদাবকশ, চাখার, বাকপুর, ঝিরাকাঠি, চালতাবাড়ী, চাউলাকাঠি, কাজলাহার, ব্রাহ্মণকাঠি, জম্বু দ্বীপসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের ৯৫ ভাগ কৃষক ঐতিহ্যবাহী সেই চিকন বালাম ধান-চালের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
বানারীপাড়ার আলী আজগর নামে ষাটোর্ধ বয়সী এক কৃষক বার্তা২৪.কমকে জানান, 'প্রায় ২০/২২ বছর আগে এক বিঘা জমির উপরে চিকন বালাম ধান চাষ করতাম। দিনে দিনে বালাম চাষ করে লোকসান আর কম ফলন হওয়ায় বালাম ধান চাষ করা বাদ দিয়ে দেই। এরপর সন্তানরা হাইব্রিড ধান চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করে কোনো রকম খরচ পুষিয়ে মোটামুটি ভালোই লাভ হচ্ছে।'
নগরীর ফরিয়াপট্টির মা বাণিজ্য ভাণ্ডারের আড়ৎদার লিটন সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'বরিশালের সেই আসল বালাম চাল এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সেই ঐতিহ্যবাহী বালাম চালের বদলে এখন আমন বালাম বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে।'
বরিশালের সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সুশান্ত ঘোষ বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্থানীয় মলঙ্গা বালাম চালে বিখ্যাত ছিল বরিশাল। কিন্তু দিনে দিনে কৃষকদের বালাম ধান চাষে আগ্রহ কমে যাওয়ায় এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই বালাম ধান এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় বালাম ধানের অস্তিত্ব পুনরায় ফিরে পেতে কৃষকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করছেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বরিশালের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, এক সময়ের স্থানীয় বালাম জাতের ধান চাষ হতো বরিশালে। কিন্তু বালাম ধান কম ফলনশীল আর অধিক সময় ধরে উৎপাদন হওয়ায় কৃষকের মাঝে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে বছরের তিন ধান মৌসুমে কম সময়ে উচ্চ ফলনশীল উফশী ও হাইব্রিড জাতের ধান উৎপাদন বাড়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়েই পুরানো ঐতিহ্য ভুলে নিজেদের অল্প জমিতে অধিক ফসল পেতে উফশী ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এসব কারণে বরিশাল থেকে বালাম ধান-চাল হারিয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, দেশের খাদ্য ঘাটতি কমাতে অল্প সময়ে উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন করার জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা৷