ভুট্টা আর মরিচের জন্য উর্বর গাইবান্ধা জেলার ব্রান্ডিং পণ্য রসমন্জুরী। ৭৮ বছর ধরে স্বাদে অতুলনীয় এই মিষ্টির সুখ্যাতি এখন দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায়। এছাড়াও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরেও। তবে সুনামের পরও এত বছরেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় ওঠেনি এই পণ্যটি। দ্রুতই স্বীকৃতির দাবি ভোক্তা, ব্যবসায়ীসহ এই অঞ্চলের সচেতন নাগরিক সমাজের।
তৈরির ইতিহাস: ইতিহাসের পাতায় সুস্বাদু এই রসমঞ্জুরির যাত্রা ১৯৪৮ সালে। গাইবান্ধা শহরের সার্কুলার রোডে 'রমেশ সুইটস' এর কর্ণধার সর্গীয় রমেশ চন্দ্র ঘোষ
ভারতের উরিষ্যা থেকে, কারিগর নিয়ে এসে, তিনিই প্রথম রসমঞ্জুরি তৈরি করেন। ধীরে ধীরে এর বিশেষ স্বাদে মুগ্ধ হতে শুরু করে গাইবান্ধার মানুষ। দ্রুতই যার পরিচিতি লাভ করে গোটা বাংলাদেশে। এক পর্যায়ে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে।
তৈরি পদ্ধতি: গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি তৈরির কারিগর নূরে আলম বার্তা২৪.কমকে জানান, রসমঞ্জুরী তৈরী করতে প্রথমে ফুটন্ত দুধ হালকা গরম রেখে ছানা বের করতে হয়। পরে দুধের ছানা, ময়দা, চিনি ও সুজি আঠালো করে তাতে সাদা এলাচের গুড়া মিশ্রিত করে হাতের সাহায্যে ফ্যাটাতে হয়।
এরপর ছানা ও ময়দা মিশ্রিত এই উপকরণ ছোট ছোট গুটি করে নেওয়া হয়। কিছুদিন আগেও কারিগররা এই গুটি হাতে তৈরী করলেও আধুনিকতার এই যুগে এখন তৈরি করা হচ্ছে অটোমেটিক মেশিনে। পরে ওইসব গুটি উত্তপ্ত আগুনে চিনির সিরার সাথে বেশ কিছু সময় ধরে জাল দিয়ে সিদ্ধ হলে, আবারও সিরায় নামানো হয়।
অন্যদিকে উত্তপ্ত আগুনে বড় বড় কড়াইয়ে দুধ ঘন এবং হালকা লালচে করতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ধরে জাল দিয়ে ক্ষীর তৈরী করা হয়। দুধ এতটাই জাল দেওয়া হয় যে, ১০০ কেজি দুধ জাল করতে করতে ক্ষীর হয়ে নেমে আসে ৩০ থেকে ৩৭ কেজিতে। পরে সিদ্ধ করে নেওয়া এই সব গুটি ঘন ক্ষীরে ডোবালেই ক্ষীর-গুটি মিলে তৈরি হয় রসে টইটুম্বুর রসমঞ্জুরী।
স্বাদ এবং মানে অতুলনীয়: "রসমঞ্জুরী, একটি বিশেষ মিষ্টান্ন, যা শুধু গাইবান্ধার নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভালোবাসার আরেক নাম। এর কোমল, রসালো স্বাদ সবাইকে মুগ্ধ করে। বিয়ে, আতিথেয়তাসহ ছোট বড় যে কোনো আয়োজনে রসমঞ্জুরির জুরি নেই। প্রবাসীদের কাছে শীতকালীন উপহার হিসেবে অত্যন্ত প্রিয় এই রসমঞ্জুরি। বর্তমানে প্রতিকেজি রসমঞ্জুরীর মূল্য ৩৮০ টাকা।
গাইবান্ধা রমেস সুইটসে মিষ্টি কিনতে আসা শহরের আরিফা আক্তার যুঁথি নামের এক মাস্টার্স পড়ুয়া পরিক্ষার্থী জানান, স্বাদে অতুলনীয় আমাদের গাইবান্ধার রসমঞ্জুরী। আসলে রসমঞ্জুরী না খেলে আমাদের মিষ্টি খাওয়াই অসুম্পূর্ণ থেকে যায়। রসমঞ্জুরী খেলাম। আর মামা ঢাকায় থাকেন। পাঁচ কেজি রসমঞ্জুরী কিনেছি সেখানে পাঠাবো।
জেলার ব্রান্ডিং পন্য: স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, এটি শুধু মিষ্টি নয়; এটি তাদের সংস্কৃতির অংশ।" স্বাদে ও মানে অতুলনীয় রসমঞ্জুরী, এর নিজস্ব স্বকীয়তায় স্থান করে নিয়েছে জেলার ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে। এতটাই প্রভাব পড়েছে যে জেলার স্লোগানেও স্থান পেয়েছে ঐতিহ্যের এই মিষ্টান্ন। তাইতো গাইবান্ধাকে বলা হয়-স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরীর ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ।
গাইবান্ধার নাট্যজন আলমগীর কবীর বাদল বলেন," এটি শুধু একটি মিষ্টি নয় এটি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব। এটি দেশের ভৌগলিক পণ্যের স্বীকৃতির যৌক্তিক দাবিদার। আমরা চাই এবছরেই আমাদের রসমঞ্জুরীকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
ব্যবসায়িক সাফল্য: ভোক্তাদদের চাহিদাকে প্রধান্য দিয়ে জেলা শহরেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ২৫ টি রসমঞ্জুরীর দোকান। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা শহর এবং বড় বড় হাট-বাজারেও অন্তত অর্ধশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তামনে প্রতিদিন এক একটি বড় মিষ্টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি রসমঞ্জরী। এর একটি অংশ ব্যক্তি পর্যায়ে রপ্তানি হচ্ছে সারাদেশসহ বিদেশেও।
রমেস সুইটসের স্বত্বাধীকারী এবং হোটেল ও মিষ্টি-রেস্তোরা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র ঘোষ বার্তা২৪.কমকে বলেন,"গাইবান্ধার রসমঞ্জরী দেশের বাহিরেও সুনাম কুড়িয়েছে। এই মিষ্টি খেতে কিংবা কিনতে এসেও মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস-আনন্দ দেখা যায়। এটাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুস্বাদু এই খাদ্য পণ্যটি জেলার ব্যান্ডিং এ স্থান পাওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। তবে, এতো স্বাদ, মান এবং দেশে প্রভাব পড়া সত্বেও এটি আজও দেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি। প্রায় সময়ই জেলা প্রশাসনের মিটিং এ এসব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু জিআই পণ্যের তালিকায় উঠবে কবে?
ব্যবসায়ীদের দাবি: ব্যবসায়ীরা বলছেন রসমঞ্জুরী একটি দ্রুত পচনশীল মিষ্টান্ন। এটি গরমকালে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ভালো থাকে। তারপর নষ্ট হয়ে যায়। দেশে বড় বড় দুগ্ধজাত পণ্যের ফার্ম আছে তাদের প্যাকেট জাত দুগ্ধপণ্য মাসের পর মাস থাকলেও নষ্ট হয়না। ওই বিষয়টি ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। তাই পণ্যটির (রসমঞ্জুরীর) স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে সরকার যদি বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা করতো তাহলে এখান থেকে সরকারও প্রচুর রাজস্ব আহরণ করতে পারতো। ভোক্তারাও সন্তুষ্ট থাকতো এবং ব্যবসায়ীরাও লাভবান হতে পারতো।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, "গাইবান্ধার একটি সুস্বাদু মিষ্টান্ন রসমঞ্জুরী। এটি অসাধারণ স্বাদের। ইতিমধ্যে পণ্যটি জেলার ব্রান্ডিং এ স্থান পেয়েছে। এটাকে জিআই পণ্যের তালিকাভুক্ত করতে সব ধরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ৪টি পণ্যকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। পণ্য ৪টি হলো- রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মুক্তগাছার মণ্ডা, মৌলভীবাজরের আগর ও মৌলভীবাজারের আগর আতর। যা নিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮টি তে।