আনন্দ-বেদনার শাটল ট্রেন ও পা-হারা রবিউল
চট্টগ্রাম: ছবিতে লাল বৃত্তের তরতাজা তরুণ বাস্তবে আর কোনদিন এমন ঋজু ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াতে পারবে না ক্যামেরার সামনে। রবিউল নামের ছেলেটি শ্যামলিম চট্টগ্রাম ভার্সিটি ক্যাম্পাস মুখরিত করে হেঁটে যেতেও পারবে না। একা কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে আর কোনদিন পড়বে না তার পদচিহ্ণ প্রিয় ক্যাম্পাসের কালো রাস্তায় কিংবা সবুজ ঘাসে অথবা শাটল ট্রেনের কু ঝিক ঝিক চলন্ত কলরোলে।
আরো অন্য অনেকের মত ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে রবিউলও অজস্র স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে এসে অবশেষে শাটল ট্রেনের চাপায় পা হারালো।
মারাত্মক দুর্ঘটনা রবিউলের সম্ভাবনাময় জীবনকে থমকে দিল। রবিউলের মত এমন হাজারো রবিউলরা প্রতিনিয়তই ঝড়ে যাচ্ছে সড়কে, রেলপথে। রবিউলদের চলে যাওয়ায় দেশ নড়ে উঠেছিল। ঢাকায় ইতিহাসের বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন হয়েছে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে। আন্দোলনের ফলে আইন হয়েছে এবং নিরাপদ সড়কের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তার মতো রেল নিরাপত্তাও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। দেশের বহু জায়গায় রেল লাইনের উপরেই বাজার বসে, রেল গেইটে লাইনম্যান থাকে না। আকসার ঘটে নানা রকমের দুর্ঘটনা। বিশেষত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেন একটি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত শাটল ট্রেন ব্যবস্থা বাংলাদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বের মধ্যেই একটি অভিনব যোগাযোগ মাধ্যম। প্রতিদিনই বিভিন্ন শিডিউল অনুযায়ী হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী শাটল ট্রেনে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করে। আনন্দ-বেদনা-স্মৃতির শাটল ট্রেন নিয়ে গল্প, কবিতা রচিত হয়েছে প্রচুর। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ক্যাম্পাস নস্টালজিয়ায় ভরপুর শাটল ট্রেন নিয়ে কাজ করছেন কেউ কেউ। রবিউলের দুর্ঘটনা পুরো শাটল ট্রেনের মতো হৃদয়গ্রাহী বিষয়ের উপর লেপ্টে দিল বেদনার ছোপ ছোপ নীল রঙ।
বলা বাহুল্য, রবিউলের পা হারানোর মর্মান্তিক ঘটনার ফলে শাটল ট্রেনে যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বগি বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
বগিবৃদ্ধি ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছে চট্টগ্রাম ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলোর মধ্যে নতুন বগি সংযোজন, পুরোনো শাটল ট্রেন সংস্কার,, ডেমু ট্রেনের জানালাগুলো সংস্কার, রাতের শাটল ট্রেনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শাটল ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো, নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম সংস্থাপন ও জরুরি চিকিৎসার বন্দোবস্ত রাখার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে।
রবিউলের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত শিক্ষার্থীরা বলেছে, আমরা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের প্রশাসনকে সম্মান দিয়ে আমাদের দাবি উত্থাপন করবো এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাবো।
শিক্ষার্থীরা আরো জানিয়েছে যে, দীর্ঘদিনের চলে আসা পরিবহণ সংকট ও কাঠামোগত সমস্যার কারণে আমাদের রবিউল আজ পা হারা। আমরা আর কোন সহপাঠীর পা হারাতে দিতে চাই না।
অতএব দ্রুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার পর বিশাল ছাত্র বিক্ষোভের মতো চূড়ান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই বহু প্রাচীন ও বহু ব্যবহৃত, জরাজীর্ণ শাটল ট্রেন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে শিক্ষার্থীদের বিপদমুক্ত করা সকলেরই কর্তব্য।
রবিউলের মতো পা হারানোর তীব্র যন্ত্রণা যেন আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবন ও ভবিষ্যতকে গ্রাস করতে না পারে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে হবে।