বিশ্বকাপে তামিম নেই, মানতে পারছে না বন্দরনগরীর মানুষ

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তামিম ইকবাল। ছবি : সংগৃহীত

তামিম ইকবাল। ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম শহরের কাজির দেউড়ি মোড় থেকে এক মিনিট দক্ষিণে হাঁটলেই পশ্চিমে মুখ করে থাকা ছোট্ট গলিপথ। সেই গলি ধরে দুই পা সামনে বাড়ালেই চোখের সামনে ধরা দেবে চট্টগ্রামের ক্রিকেট আবেগের সবচেয়ে বড় ঠিকানাটি!

লাল রঙের টাইলসে মোড়ানো পাঁচতলা ভবনটিই যে শহরের বিখ্যাত বাসিন্দা আকরাম খান, নাফিস ইকবাল আর তামিম ইকবালের বাড়ি। দুই যুগ ধরে ওয়ানডে বিশ্বকাপ মানেই ছিল এই ভবনের কারও না কারও উপস্থিতি।

বিজ্ঞাপন

আসন্ন বিশ্বকাপের দল থেকে তামিম ইকবাল বাদ পড়ায় আপাতত সেই বহুদিনের চেনা দৃশ্যের যবনিকা ঘটল। আকরাম-নাফিসের নাম তো বহু আগেই অতীতের ধুলোজমা পাতায়। এবার তাদের পথ ধরে কি স্মৃতি হয়ে গেলেন তামিমও।

মনে আছে নিশ্চয়ই, ২৬ বছর আগে পুরো দেশ প্রথম আইসিসি ট্রফি জয়ের আনন্দ ভেসেছিল এই বাড়ির প্রথম প্রতিনিধি আকরাম খানের হাত ধরেই। ১৯৯৭ সালের সেই ট্রফি জয়ই তো বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে।

আর ১৯৯৯ সালের সেই বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশ।

একবছর আগে নিঃশব্দে সরে দাঁড়িয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি থেকে। ফেসবুকে ছোট্ট বার্তা দিয়ে বিদায় বলেছিলেন ক্রিকেটের ছোট সংস্করণকে।

বছর পেরিয়ে আরেকটা জুলাই আসতেই নিজস্ব সেই ‘তামিম ভঙ্গিতেই' আচমকা সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়ে দেন, জাতীয় দলের জার্সিতে আর দেখা যাবে না তাকে। অবশ্য গত ৬ জুলাই নেওয়া অবসরের সেই সিদ্ধান্ত থেকে তামিম পরদিন ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে। কথা ছিল বিশ্বকাপে খেলবেন। কিন্তু, সেটি আর হলো কই!

পুরো নাম তামিম ইকবাল খান হলেও চট্টগ্রামের মানুষ তাদের গর্বিত সন্তানকে ভালোবেসে ডাকেন ‘খান সাহেব!’ নিজেদের শহরে আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এমন এক কিংবদন্তীকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলা তাই মানতে পারছে না বন্দরনগরীর মানুষ।

তামিমকে রাখা হবে না বিশ্বকাপের স্কোয়াডে-এমন শঙ্কার মেঘটা চট্টগ্রামের মানুষদের মনে উড়াউড়ি করছিল মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই। সেই শঙ্কার মেঘটা যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরল-রাত ৮টা ১৬ মিনিটে।

বিসিবির ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেলো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জার্সি উন্মোচন করছেন দলে সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়েরা। জার্সি হাতে খেলোয়াড়েরা ভিডিওতে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। সেই ভিডিওটা যখন প্রকাশ হচ্ছিল তখন তামিমের ক্রিকেটার হওয়ার আঁতুড়ঘর নগরীর কাজির দেউড়ির আউটার স্টেডিয়ামে তার ভক্তদের থিকথিকে ভিড়। কারো চোখ স্যাঁতসেঁতে, কারও মুখ বিষণ্ন।

সেই দলে ছিলেন জসিম উদ্দিনও। ত্রিশ ছুঁইছুঁই বছরের এই চা দোকানি বলেন, ‘কৈশোরে আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নুকে দেখে দেখে আমার মতো অনেকের ক্রিকেটপ্রেমের শুরু। সেই প্রেম গভীর হয়েছে তামিম ইকবালের ব্যাটে চড়ে। বাংলাদেশকে কি-ই না দিয়েছেন এই বাঁহাতি ব্যাটার। তবুও কেন তাকে এভাবে বাদ দেওয়া হলো? অর্ধেক ফিটের তামিমও তো বাকি ওপেনারদের চেয়ে দুর্দান্ত। আজ থেকে ঠিকই বাংলাদেশ দলকে সমর্থন করে যাবো, কিন্তু দেশের জার্সিতে তামিমকে দেখার যে সুখ সেটি তো ফাঁকাই থাকবে।’

তামিমের বাড়ির পাশের কাজির দেউড়ি এলাকার নিয়মিত রিকশা চালানো আল আমিনের কণ্ঠও বুজে আসছে। চট্টগ্রামের ভাষায় তিনি বলছিলেন, ‘আঁরার খান সাহেবরে বিশ্বকাপত ন দেইক্কম, মানিত ন পারির। ক্রিকেটপাগল চট্টগ্রামের মানুষের জীবনত এর চেয়ে বড় দুঃখের দিন আর ন আইয়্যে!’

অবশ্য কেউ কেউ তামিমকে বাদ দেয়ার পেছনে ‘ষড়যন্ত্র তত্বও’ সামনে আনছেন।

কলেজ শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তামিমকে বাদ দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। আগের রাতে বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হোসেন পাপনের সঙ্গে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের গোপন সভাতেই মূলত তামিমকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হয়। শোনা যাচ্ছে, তামিমের চোট নিয়ে সাকিবের পাশাপাশি কোচ হাথুরুসিংহেও ক্ষুব্ধ ছিলেন বাঁহাতি ওপেনারের ওপর। এই শ্রীলঙ্কান কোচ তার চাকরির প্রথম দফায় মুমিনুল হককে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন পুনরায় ফিরে এসে তিনি সেই পুরনো খেলা আবার শুরু করেছেন কিনা সেটা দেখার বিষয়।’

সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজের শিক্ষার্থী মাইমুন উদ্দিনও মনে করেন তেমন কিছুই। তিনি বলেন, ‘তামিম ইকবালকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ দল কোনোভাবেই মানতে পারছি না। তাকে দলে না রাখতে চাইছিল একটা পক্ষ। এখন ইনজুরি ইস্যু সামনে এনে ছুঁড়ে ফেলল তারা।’

তামিমকে চট্টগ্রামের মানুষের মিস করার কারণ একটু বেশিই। কেননা, নান্নু, আকরামের পর বলতে গেলে চট্টগ্রামের ক্রিকেট পতাকাটা পনেরো বছর ধরে একাই উড়িয়ে যাচ্ছেন তামিম। অবশ্য তার আগে আফতাব আহমেদ, নাফিস ইকবাল, নাজিম উদ্দিনের ব্যাটের ফল্গুধারায় অনেকবারই হাসি ফুটেছে চট্টগ্রামের মানুষদের মুখে। কিন্তু, সেই হাসির স্থায়ীত্ব ক্ষণস্থায়ীই ছিল। সেই দিক দিয়ে লম্বা সময় তামিমের ব্যাটিংয়েই ধন্য হয়েছেন বন্দরনগরীর মানুষ।

তামিমের পর এই শহরের নাঈম হাসান, ইয়াসির আলী রাব্বীরা জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও এখনো পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে পারেনি কেউই। সেজন্য তামিমকে বিশ্বকাপের দলে না রাখায় শহরের মানুষের মন খারাপটা একটু বেশিই হচ্ছে।

ভক্তদের শঙ্কার মেঘটা আরও ডালপালা ছড়াচ্ছে এখন। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন-চট্টগ্রামের কৃতী সন্তানকে কি আর দেখা যাবে বাইশগজে? নাকি এখানেই শেষ, সব শেষ!