মাঝরাতে জয়পুরের পথে
কলকাতা থেকে ইনডিগো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট জমজমাট জয়পুর বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালো রাত প্রায় ২টায়। টের পেলাম, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহণ ব্যবস্থা চরম ভাবে বিকশিত হয়েছে। অনেকগুলো কোম্পানি সকাল, দুপুর, সন্ধা, রাতে বহু ফ্লাইট পরিচালনা করছে ভারতের বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে। দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতার মতো আঞ্চলিক বড় শহর ছাড়াও ফ্লাইট চলছে ইন্দোর, ভূপাল, বেঙ্গালুরু, হায়দারাবাদ, আগরতলা ইত্যাদি প্রায় সকল শহরেই। কোনও কোনও রাজ্যের রাজধানী ছাড়াও বড় শহরে বিমানবন্দর আছে। সেখানেও অনায়াসে যাতায়াত করা যাচ্ছে।
কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে মাঝরাতেও বিরাট ভিড় দেখেছি। স্বল্প ব্যয়ে ভ্রমণের জন্য উপযোগী বিমান কোম্পানিগুলো বাজেট ক্যারিয়ার নামে পরিচিতি, যাদের মধ্যে ইনডিগো, স্পাইস জেট ইত্যাদি অন্যতম। এসব বিমানের টিকেট আগেভাগে কাটলে মোটামুটি কম খরচে দূরদূরান্তে যাওয়া যায়। ফলে ট্রেনের লম্বা সময়ের সফরের ধকল এড়িয়ে সামান্য কিছু টাকা বাড়িয়ে লোকজন প্লেনেই চলাচল করছেন আজকাল। তবে, এসব প্লেনে খাবার কিনে খেতে হয়, এটাই নিয়ম। এক-দুই বার পানি ছাড়া আর কোনও সার্ভিস নেই।
ইনডিগোর বিমান বেশ ঝকঝকে। ১৮০ আসনের এ-৩২০ এয়ারবাসটি বাজেট ক্যারিয়ার হলেও মোটামুটি সুপরিসর। মজার ব্যাপার হলো বিমানে কোনও এক্সিকিউটিভ ক্লাস নেই। টানা ইকোনমি ক্লাসের সিট দিয়ে বিমানটি সাজানো হয়েছে। ভেতরে স্টাফও কম। মাত্র চার জন পুরো বিমান সামলাচ্ছে। আমাদের দেশের বিমান সেবক-সেবিকার চেয়ে আচরণে, দক্ষতায়, পরিশ্রমে এরা বেশ এগিয়ে।
ঘোষণা থেকে জানলাম, যে পাইলট বিমান চালাচ্ছেন, তিনি জয়পুরবাসী। দিল্লি থেকে কলকাতায় ফেরার পথেও জানানো হয়েছিল, পাইলট কলকাতার বাঙালি। সম্ভবত বিমানের রুট অনুযায়ী পাইলট, স্টাফ নিয়োগ করা বিসনেস পলিসির অংশ।
বিমানে বসেই ভাষা বদলে যাওয়ার ধ্বনি-তরঙ্গের আঁচ স্পষ্ট হলো। যাত্রীদের মধ্যে অবাঙালির প্রাধান্যও পরিষ্কার দেখা গেলো। সহযাত্রী তম্বী তরুণী এক মনে একটি ইংরেজি বই পড়ছে। বইটির শিরোনাম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। চমৎকার নাম বইটির: Don’t Make Me Think: A Common Sense Approach to Web and Mobile Usability লেখক Steve Krug.
আগ্রহী হয়ে এক সময় বইটি চেয়ে নিলাম। আমি ভেবেছিলাম, বইটি বিসনেস বা হিউম্যান রিসোর্সের হবে। কিন্তু সূচিপত্র ও ভূমিকায় চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপন বিষয়ের বই। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ওয়েবসাইট ও মোবাইলের কত রকমের বাণিজ্যিক, গণযোগাযোগ ও বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ব্যবহার করা যায়, সেসবই বইটি আলোচ্য বিষয়।
এমন বই তো সবার পড়ার কথা নয়! আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তরুণীর দিকে তাকাই। যার কাছ থেকে বইটি নিয়েছি, তাকে নিরীক্ষণ করতে আগ্রহী হলাম। কথা বলে জানলাম, তার নাম ভাবনা মোদি। কলকাতার বাসিন্দা। নিউ আলিপুরে বসবাস করে। কলকাতায় তাদের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা আছে। তার স্বামী কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনিও একই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আছেন।
আমার আগ্রহ আরও বাড়লো। আমি তার সঙ্গে আলাপে জড়িয়ে পড়ি:
-আপনি কি রাজস্থানী? রাজপুত জাতির সদস্য?
মিষ্টি হেসে উত্তর দিল মেয়েটি:
-না, আমি মাড়োয়ারি।
চট আমার করে মনে পড়লো কলকাতায় মাড়োয়ারিদের একটি শক্ত অবস্থান আছে। মুঘল আমল থেকেই বাংলায় মাড়োয়ারিদের দাপট। ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতায় কয়েক’শ বছর ধরেই তাদের শক্ত ঘাঁটি আছে। জগৎ শেঠের আমলে মাড়োয়ারিরা তো রাজনীতি ও ক্ষমতা বদলের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালেও ভারত বিভাগের সময় তাদের ভূমিকা অজানা নয়। বাংলাকে ভাগ করা ও কলকাতাকে ভারতের অংশ করার ক্ষেত্রে এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। ভাবনা মোদির সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ধর্মে সে জৈন। রাজস্থানের মাড়োয়ারের যোধপুরে তার আদিবাস। সেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি জীবনে কোনও জৈনকে এতো কাছ থেকে দেখিনি। তার কাছ থেকেই জানলাম, জৈন ধর্মের প্রধান স্থান রাজস্থান। জৈনদের দশটি প্রধান তীর্থের পাঁচটিই রাজস্থানে। রাজস্থানের গুজরাত ও পাকিস্তান সীমান্তের মাড়োয়ারে জৈনদের প্রাধান্য রয়েছে।
রাজস্থান রাজপুতদের রাজ্য হলেও তা আসলে অনেকগুলো রাজ্যের মিলিত রূপ। ভারত বিভাগের সময় উপমহাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ’শ দেশীয় রাজ্য ছিল। এদের কয়েকটি মিলে হয়েছে রাজস্থান। সাধারণত দেশীয় রাজ্যের মধ্যে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, জুনাগড়ের নাম রাজনৈতিক সংঘাত ও সঙ্কটের কারণে অধিক প্রচারিত হলেও অন্য রাজ্যগুলোর কথা প্রায় জানাই যায় না। ভারত বিভক্ত হলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল রাজ্যগুলোকে শক্তি, বুদ্ধি ও কৌশলে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেন।
রাজস্থানের রাজপুতদের রাজপুতানা রাজ্য ছাড়াও মেবার, আজমির, মাড়োয়ার ইত্যাদি রাজ্য একাকার হয়ে বর্তমান কাঠামো পেয়েছে। ফলে রাজ্যটি বহু সংস্কৃতি ও ধর্মের উজ্জ্বল নিদর্শন। জয়পুরে রাজস্থানী বিষয়গুলো প্রাধান্য পেলেও যোধপুরে মাড়োয়ারি আর উদয়পুরে মিশ্র সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যায়। ভাষা, ধর্ম, আচার-আচরণেও রাজস্থানের এলাকা বিশেষে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে।
ভাবনা মোদির কাছ থেকে রাজস্থানের আগাম তথ্য পেয়ে ভালো হলো। ভাবনা কলকাতার বৌ, সে পড়াশোনা করেছে পুনেতে। নিউ আলীপুর ছাড়াও কলকাতার অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত এলাকাগুলো মূলত মাড়োয়ারিদের দখলে। বড়বাজারের ব্যবসার মতো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, যোধপুর পার্ক, গার্ডেন রিচ, আলীপুর এবং অধুনা নিউ টাউন, সল্টলেকে মাড়োয়ারিদের মজবুত বসতি রয়েছে। মধ্য কলকাতার ইংলিশ মিডিয়াম নামী স্কুলগুলোও চলে প্রধানত মাড়োয়ারি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। শিক্ষা ও আর্থিক দিক থেকে মাড়োয়ারি জৈনরা যে কত এগিয়ে তা পরে চাক্ষুষ করেছি রাজস্থানের নানা স্থানে।
কলকাতাতে নানা কোম্পানি আর বড়বাজার, চৌরঙ্গীর ব্যবসাগুলো মাড়োয়ারিদের দখলে। কলকাতায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা প্রধানত চাকরিজীবী, পেশাজীবী। কিছু কিছু উদ্যোক্তা বাঙালি হলেও ক্ষমতা ও অর্থের মূল শক্তি মাড়োয়ারিদের দখলে। টালিগঞ্জের সিনেমা ব্যবসার প্রধান লগ্নীও মাড়োয়ারিদের। এই গোষ্ঠী যে এখনো কত পাওয়ারফুল তার প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। সিনেমা ছাড়াও ক্রিকেট, মিডিয়া ওদের করায়ত্ত।
কলকাতার বাঙালি মুসলমান নায়িকা নুসরাত জাহান রুহির কথাই বলা যাক। অভিনেতা থেকে রাজনীতিতে এসে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেসের এই অভিনেত্রী-রাজনীতিবিদ বিয়ে করেছেন একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী নিখিল জৈনকে। বিরাট আয়োজনের জমকালো বিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতিতে মাড়োয়ারিদের প্রভাব এ থেকেই আঁচ করা যায়।
কথায় কথায় বিমান জয়পুরের মাটি স্পর্শ করলো। আকাশ থেকে নগরের বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটা ছাড়া বিশেষ কোনও দ্রষ্টব্য চোখে পড়ল না। জয়পুরের সংঘানার বিমান বন্দরটি ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মর্যাদা পেয়েছে। দুটি রানওয়ে নিয়ে বিমান বন্দরটি মূল শহরে ১৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে দুটি বিমান সংস্থার মূল অফিস। একটি সুপ্রিম এয়ার লাইন্স ও আরেকটি এলায়েন্স এয়ার।
বিমান বন্দরটির ভেতরের ডেকোরেশন সাজানো হয়েছে রাজস্থানী ইমেজে। গম্বুজ, অশ্বারোহী সৈনিক, হাতি, উট, ময়ূরের ছবি ও স্ট্যাচু লাউঞ্জের আনাচে কানাচে ছড়ানো। পুরো আবহকে রাজস্থানী আঙকে নিয়ে আসা হয়েছে চমৎকার ভাবে।
অল্প সময়ের মধ্যে বিমান বন্দরের বাইরে বেড়িয়ে আসা গেল। আবহাওয়ার পরতে পরতে শরতের হাল্কা শীত মেশানো। ড্রাইভার জানালেন, দিনে কিছুটা গরম থাকলেও পরিস্থিতি নাতিশীতোষ্ণ। ‘আপ লোক সহিহ মৌসুম ম্যা আয়া’। ড্রাইভারের হিন্দি শুনে ভারতের সবচেয়ে বড় অংশ হিন্দি বলয়ে অবস্থানের রেশ টের পেলাম। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার মিলে যে হিন্দি বলয়, তা ভোটের বিচারে ভারতের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। এখানে যারা সুবিধা করে, ক্ষমতার দৌঁড়ে তারাই এগিয়ে যায়।
রাতের বিমান বন্দর থেকে বাগান ও বৃক্ষ শোভিত নগরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কানে বাজলো মধ্যযুগের অশ্বধ্বনি। দূরে দেখা গেলো আলোক শোভিত প্রাসাদ। ঐতিহাসিক রাজস্থানের প্রাচীন রাজধানী শহরের পথ ডানে রেখে আমরা চলে এলাম রাজধানীর নতুন অংশের টঙ্ক রোডের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়।
আরও পড়ুন