ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনী-(শেষ পর্ব)
ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ শুরুর অন্যতম পীঠস্থান উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। নবজাগৃত বাংলায় সুরুচি, নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্য্যবোধের অনেকটাই ঠাকুরবাড়ির অবদান।
দ্বারকানাথের আমল থেকেই এ বাড়িতে নিজস্ব একটি সংস্কার গড়ে ওঠে। এই নব উত্তরণের পর্বে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও অন্দরমহলের আবছা পর্দার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন নি। নবযুগের ভিত গড়ার কাজে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাত লাগিয়েছেন।
প্রথমদিকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে এদের অনেকেই শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। নিজের চলার মসৃণ পথ তারা পাননি, পথ তৈরি করে নিতে হয়েছিল তাদের। তারা তৎকালীন নারীদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন সম্ভাবনার পথ। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি নারীর এগিয়ে যাওয়ার আদি প্রেরণা ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছ থেকেই। চলুন জেনে আসি ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনীদের সম্পর্কে-
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
'জ্ঞানদানন্দিনী বাংলার নারীদের পোশাকে এক বিশাল পরিবর্তন আনেন। বাঙালি নারীকে আধুনিকরূপে গড়ে তোলার এবং অন্তঃপুর থেকে বাইরে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি।
মাত্র আট বছর বয়সে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জ্ঞানদানন্দিনী অভিজাত ব্রিটিশদের শিষ্টাচার ও চালচলনের অনুরূপে একজন পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন নারীতে পরিণত হন এবং তৎকালীন শিক্ষিত অনেক মহিলার মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম আধুনিক নারী।
তিনিই ছিলেন প্রথম একজন, যিনি অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে অসামরিক ভোজসভায় যোগ দিয়ে অভিজাত ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচরে আসেন। তিনিই ঠাকুর পরিবারের প্রথম গৃহবধূ, যিনি নিয়ম ভঙ্গ করে তার স্বামীর সঙ্গে স্বামীর কর্তব্যস্থল বোম্বাইতে যান। তিনি পোশাক সংস্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন এনেছিলেন তা হলো ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’ পড়ার রীতি প্রবর্তন। এ শাড়ির সাথে রয়েছে বডিস, পেটিকোট, জুতা ও মোজা।'
ইন্দিরা দেবী
ইন্দিরা দেবী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কন্যা। তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, লেখক ও অনুবাদক।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে ইন্দিরা সর্বপ্রথম বি.এ পাশ করেন। তিনি ছিলেন মায়ের মতোই বিদুষী ও প্রগতিশীল। পড়াশোনা ছাড়াও শিখেছিলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ও সেতার।
খুব অল্প বয়সেই জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত 'বালক' পত্রিকায় তাঁর রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ পায়। পরে ফরাসি ভাষা শেখার পর রেনে গ্রুসের 'ভারতবর্ষ', পিয়ের লোতির 'কমল কুমারিকাশ্রম' এবং মাদাম লেভির 'ভারতভ্রমণ' কাহিনী অনুবাদ করেন ইন্দিরা দেবী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ জাপানযাত্রীর ডায়রী-র ইংরেজি অনুবাদও তিনি প্রকাশ করেন। এক সময় বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্য বিষয়ে তার বেশ কিছু মৌলিক রচনা প্রকাশ পায়।
সূত্র: চিত্রা দেবের ঠাকুরবাড়ি অন্দরমহল বই অবলম্বণে