বাংলার মুসলিম মেয়েদের কণ্ঠস্বর
'উসনে বাত কি কুছ অ্যায়সে ঢং সে
স্বপ্নে দে গ্যায়ে ওহ হাজারো রং কে'
'পহেলা নেশা' নামে যে গান তার এই লাইনগুলো, আজ থেকে তিরিশ বছর আগের সুপারহিট ছবি 'জো জিতা ওহি সিকান্দর' ছবির| আমির খান, আয়েষা জুলেখা এবং পুজা বেদির উপর চিত্রায়িত গানটির কোরিওগ্রাফ করেছিলেন ফারহা খান| পরবর্তী কালে বলিউডের বহু ব্লকবাস্টার ছবির পরিচালক ফারহা খান প্রথম প্রচারের আলোয় এসেছিলেন ওই অসামান্য রোম্যান্টিক গানের কোরিওগ্রাফি করে| কিন্তু আসলে গানের পুরো আকর্ষণটাই ছিল অন্য কারণে, চিত্রায়িত হয়েছিল স্লো মোশনে, মায়াবী আবহে, স্বপ্নের মতো।
আমি যে দুটো লাইন দিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছি, সেটা আসে নায়িকার গলায়, বা যখন নায়িকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গানটি পর্দায় আসে| বিশিষ্ট উর্দু কবি মজরুহ সুলতানপুরীর লেখা লাইনগুলো এক ভীরু, নিজেকে প্রকাশ করতে না পারা নারীর কথা|
তিরিশ বছর বাদে মুসলিম মহিলাদের লেখার সংকলন 'কণ্ঠস্বর'-এর ঈদ সংখ্যা নিয়ে লিখতে বসে আমার ওই দুটি লাইনই মাথায় এল| এবং মনে পড়ল স্লো মোশনে কি ভাবে অনুভূতির প্রকাশ দেখানো হয়েছিল| 'কণ্ঠস্বর'-এর পাতা উল্টে গেলেও আপনার একই অনুভূতি হতে পারে, একটু ধীর লয়ে কারা যেন হৃদয়ের ঝাঁপি খুলে ধরছে|
বইয়ের একেবারে শেষ থেকে, শালিমা হালদার, আনজুমান আরা কিংবা কাজী লাবণ্যর গল্পগুলো পড়তে শুরু করলেই এই অনুভূতিটা তীব্র হতে থাকে| চার বছরে পা দেওয়া 'কন্ঠস্বর'-এর এবারের সংকলনে দুই বাংলার প্রায় ৮০ জন মুসলিম মহিলা লিখেছেন, তার মধ্যে বাংলাদেশেরও অনেকে আছেন| যেমন আমি যে গল্পলেখিকাদের তালিকা দিয়ে শুরু করলাম, তার মধ্যে বড় অংশই বাংলাদেশের| ময়মনসিংহের আনজুমান আরা, রংপুরের কাজী লাবণ্য, ঢাকার রোকেয়া ইসলাম, মাদারীপুরে তাহমিনা শিল্পী বা ঢাকারই নুর কামরুন নাহার|
পশ্চিম বাংলার রেজিনা খাতুন, লায়লা নাজনীন, নাদিয়া হোসেন,শাহমিদা সুলতানা, কাজী আমরীণ কবীর কিংবা সাবিয়া খাতুনের পাশাপাশি এই বাংলাদেশের লেখিকাদের লেখাও আস্তে আস্তেই আমাদের মুসলিম মেয়েদের মন এবং মননের সঙ্গে পরিচয় করায়| আমরা বুঝতে থাকি অনেক লেখাতেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বা উপলব্ধির ছাপটা কতটা প্রগাঢ়| শাহমিদা সুলতানার গল্পের নায়িকার মতোই সেই উপলব্ধিও আসলে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ছুঁয়ে কলকাতার গঙ্গার পাড়ে গিয়ে জল স্পর্শ করার মতো, এক অবশ ভালোলাগায় মন ভরে যায়।
যে সংকলনে ৮০ জনের লেখা রয়েছে, সেই সংকলন সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে আলাদা করে প্রতিটি লেখা সম্পর্কে উল্লেখ করা খুব কঠিন কাজ| বিশেষ করে যেহেতু গল্প, কবিতা বা নিবন্ধের পাশাপাশি স্মৃতিকথা, গবেষণার দলিলও 'কন্ঠস্বর'-এর এই সংকলনে জায়গা করে নিয়েছে| এবং সব লেখাই আমার কাছে এক অর্থে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ এর মতো, একটা নবীন, সতেজ অনুভূতির কথা বলে| জীবনকে অন্য আঙ্গিকে দেখার সোচ্চার ঘোষণা| সেটা ঢাকার শিক্ষিকা সাহিন আরা সুলতানার কাঙ্খিত পুরুষকে চিঠি লেখাতেই হোক বা সেই শহরেরই সামাজিক আন্দোলনের নেত্রী রোখসানা ফেরদৌস রাখীর অতিমারির সময়ে দাঁড়িয়ে উৎসবকে দেখার চেষ্টা, সবেতেই স্পষ্ট|
আমি যদি পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে 'কন্ঠস্বর' নামে একটি পত্রিকার চারবছর ধরে শুধু মুসলিম মহিলাদের লেখা নিয়ে ঈদ সংকলন প্রকাশের ধারাবাহিকতাকে বিচার করি, তাহলে সেটাকে মাইলফলকই বলব| এবং সব ব্যক্তিগত ভাল লাগা না লাগাকে সরিয়ে রেখেই বলব| কারণ যে সমাজে একটা দলিত সাহিত্য একাডেমি তৈরি করলে এবং সেই একাডেমির শীর্ষে মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে বসালে হুলুস্থুলু লেগে যায়, সাহিত্য জগতের ব্রাহ্মণরা সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে দেন, সেই সমাজ এবং দেশে চারবছর ধরে শুধু মুসলিম মহিলাদের লেখাই ছাপব বলাটা সাহসের পরিচয়| সেটাই আদতে মনুবাদী সমাজের চোখে চোখ রেখে কথা বলার চেষ্টা|
এবং মনোরঞ্জন ব্যাপারীর যা সমস্যা, 'কন্ঠস্বর'-এর ঈদ সংখ্যারও সেই প্রতিবন্ধকতা| কলকাতার সাহিত্য সমাজের কেষ্টবিষ্টুরা, যাঁরা নিজেদের নিয়ে বেশি আপ্লুত, তাঁরা যেমন দলিত সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামান না, তেমনই মুসলিম মহিলাদের লেখালেখি নিয়েও উদাসীন|
কলকাতা শহরের এই সেলিব্রিটি ম্যানেজমেন্ট-এর বাইরে পা রাখলে, কোন মুসলিম হিরোইনের ব্যক্তিগত জীবনের কেচ্ছাকে অতিক্রম করে জীবনের হাজারো হাসি-কান্নার প্রিজমে 'কন্ঠস্বর'-এর লেখিকাদের সৃজনকে বিচার করলে অবাক হতে হয়| মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের এই লেখিকাদের লেখাই সমাজের আয়না হতে পারে, রাজনীতি বোঝার মানদন্ড হতে পারে| কিন্তু যেহেতু শহুরে এলিট মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে চেনে না, কন্ঠস্বর এর মুসলিম মহিলা লেখিকারা কি বলতে চাইছেন,তা জানেন না, তাই নির্বাচনের ফলাফলই হোক কিংবা কনজ্যুমারের প্রেফারেন্স বদলে যাওয়া তাঁদেরকে একেবারে রানআউট করে দেয়|
জো জিতা ওহি সিকান্দর, পপুলার কালচার-এর একটা ব্লকবাস্টার সিনেমা এবং সাধারণের পছন্দের একটা গান দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি| স্লো মোশনে ছবির নায়িকাকে দিয়ে যা বলানো হয়েছিল, সেটাই সিনেমার শেষে গিয়ে জেতে| সফল হয়| সমস্ত চাকচিক্যকে পিছনে ফেলে নিজের পতাকাকে গেঁথে দেয়| হয়তো ধীরে, হয়তো ভীরু স্বরে মুসলিম মহিলারা যে কথাগুলো বলছেন, প্রকাশ করতে চাইছেন,সেইগুলো যে কাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে না, তা কে জানে?
কণ্ঠস্বর
প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক: সৈয়দ তানভীর নাসরীন
সম্পাদক: সৈয়দ কীর্তিকা তাবাসসুম
প্রচ্ছদ: কৌশিক মিত্র
প্রকাশকাল: ২০২১