সোনম কালরা: প্রেম, মানবতা, আধ্যাত্মের প্রতিধ্বনি
সোনম কালরা নামের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় থাকলেও তাঁকে প্রথম ভার্চুয়ালি দেখার অভিজ্ঞতাটি বেশ চমকপ্রদ। 'দ্য পার্টিশান ১৯৪৭ আর্কাইভ' নামের একটি গবেষণা সংস্থার পক্ষে প্রতি রোববার তিনি হাজির হন দেশভাগ নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনায়। সঙ্গে থাকেন কোনও শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, শিল্পী, লেখক, যারা দেশভাগ নিয়ে কাজ করছেন।
জুলাই মাসের প্রথম রোববার সোমন কালরা নিয়ে আসেন হারুন খালিদকে। 'ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান' বইয়ের লেখক পাকিস্তানি অ্যাকাডেমিশিয়ান আনাম জাকারিয়ার সুবাদে হারুন খালিদ আমার পরিচিত। গবেষণার কাজে বাংলাদেশও ঘুরে গেছেন তাঁরা।
ফলে আমি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনাটি শুনি। এবং 'দ্য পার্টিশান ১৯৪৭ আর্কাইভ' দেশভাগ নিয়ে যে ব্যাপক ভিত্তিক ইতিহাসচর্চা ও তথ্য সংরক্ষণ করছে, তা জানতে পারি। তবে, পার্টিশন নিয়ে আলোচনায় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও পাঞ্জাবের বিষয়াবলী যত প্রাধান্য পায়, পূর্বাঞ্চল তথা বাংলার বিভাজন ততটা পায় না। দেশভাগের আন্তর্জাতিক গবেষণা ও লেখালেখিতে পাঞ্জাবের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, অমৃতা প্রীতম, কৃষণ চন্দর এবং কমলা ভাসিন, ঊর্বশী বুটালিয়া এসব কাজকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
এসব প্রসঙ্গে সোনম কালরার সঙ্গে আলাপ করার শুরুতেই তিনি আমাকে ভীষণভাবে চমকে দিলেন। বললেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে আমার ঐতিহাতিক নিবিড় সম্পর্ক আছে। মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনির সেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরা-এর আমি গ্র্যান্ডডটার। শিখ ইতিহাসে বীরোচিত নারীর অভাব নেই, যারা যুদ্ধে, রাজনীতিতে, শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে প্রভূত অবদান রেখেছেন। সোনম সেই উত্তরাধিকারের আধুনিককালের অনন্য দৃষ্টান্ত। যিনি পরিণত হয়েছেন প্রেম, মানবতা, আধ্যাত্মের প্রতিধ্বনিতে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের সুপ্রাচীন জনপদগুলোর অন্যতম পাঞ্জাব শুধু পঞ্চনদীর দেশই নয়, মহাভারতের ঘটনাবলীর স্বাক্ষী এবং সিন্ধু সভ্যতার লীলাভূমিও। বাংলার মতো পাঞ্জাবের ললাটেও রয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ক্ষত। বাংলায় রাজনৈতিক ও সশস্ত্রভাবে হিন্দু ও মুসলমানগণ মুখোমুখি হলেও পাঞ্জাবে তা ছিল ত্রিমুখী: হিন্দু, শিখ, মুসলমানদের মধ্যে আবর্তিত। এক পর্যায়ে হিন্দু-শিখ জোট বনাম মুসলিমদের সেই ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংঘাত ১৯৪৭ সালের দিনগুলোকে লাশ, রক্ত, আগুনের বিভীষিকায় দগ্ধ করেছিল। খুশবন্ত সিং, সাদাত হাসান মান্টো, কৃষাণ চন্দর প্রমুখ সেসবের অনবদ্য সাহিত্যিক ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন।
পরের ঘটনা সবার জানা। আশি দশকে স্বাধীন খালিস্থান আন্দোলন চরমভাবে দমন করা হয় শিখদের ধর্মস্থান ‘স্বর্ণ মন্দির’-এ 'অপারেশন ব্লু স্টার' নামক নির্মম সামরিক অভিযান চালিয়ে। তখন মুখোমুখি হয় একদার মিত্র শিখ ও হিন্দুরা। সংঘাত ও পাল্টা-সংঘাতময় ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় নিহত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং এরই ধারাবাহিকতায় হাজার হাজার শিখ মারা যান। বিশ্বে তিন কোটির বেশি জনগোষ্ঠীর শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান।
যদিও এখনো পাঞ্জাবই ভারতের একমাত্র শিখ-প্রধান প্রদেশ, তথাপি বৃহত্তর পাঞ্জাবের বড় অংশ ভাগাভাগির সময় পড়েছে পাকিস্তানে। এমনকি, যে লাহোরকে রাজধানী করে বিশাল শিখ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল পেশোয়ার পর্যন্ত, তা-ও এখন পাকিস্তানভুক্ত। অথচ এই শিখ ধর্ম ও সম্প্রদায় অত্যন্ত নবীন। মাত্র পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক কর্তৃত প্রবর্তিত, যাতে হিন্দু ভক্তিবাদ ও মুসলিম সুফিবাদের মিশেল আছে।
রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত শক, দল, হুন, মুঘল, পাঠান ইত্যাদি যে ভারতের একদেহে লীন হয়েছে, সেখানে পাঞ্জাবি জাতিসত্তা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ ধর্মের লোক রয়েছে। দেশভাগের পর মুসলিম পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানের পাঞ্জাব অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পাকিস্তানের রাজনীতি, সামরিক বাহিনী ও অর্থনীতিতে প্রবলভাবে বিরাজমান। আর ভারতের পাঞ্জাব মূলত শিখ প্রধান। পাঞ্জাবি হিন্দুরা পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি ইত্যাদি স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করেন।
নতুন ধর্ম সম্প্রদায় হলেও উনবিংশ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে শিখ সাম্রাজ্য প্রবলভাবে বিস্তার লাভ করে রনজিৎ সিং-এর নেতৃত্বে, যা পশ্চিমে আফগানিস্তানের কাছাকাছি পেশোয়ার পেরিয়ে খায়বার পাস এবং কাশ্মীর পেরিয়ে চীন-তিব্বত সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত চলে যায়। তিনি গুজরানওয়ালা থেকে রাজধানী সরিয়ে লাহোরে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এবং ব্রিটিশ আক্রমণের মুখে ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিখ সাম্রাজ্য পুরোপুরি ভেঙে যায়। তথাপি পাঞ্জাবি ও শিখরা ইংরেজদের সঙ্গেই সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেতৃত্বের আসন লাভ করে।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন বাবর যখন ভারতে আসেন, তখন গুরু নানক শিখ ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে বাবরের সদ্ভাব ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শিখরা বার বার দিল্লির মুঘল রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে এবং ১৭০৭ সালে শক্তিশালী মুঘল নৃপতি আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শিখ সম্প্রদায় সংগঠিত হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। শিখদের একাধিক আক্রমণকেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়।
নবাগত ধর্ম ও নবীন সম্প্রদায় হয়েও দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ জুড়ে শিখগণ যে রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক-প্রত্নতাত্ত্বিক ছাপ রেখেছেন, সোনম কালরা সেসবই আত্মস্থ করেছেন গভীর মমতায় এবং নবতর বিন্যাসে, আন্তর্জাতিক অভিব্যক্তিতে। এবং প্রেমময়তায় বিনির্মাণ করেছেন তিনি ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে।
তিনি শুধু শিখ বা পাঞ্জাব নয়, ব্যাপকভাবে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্রোতের সমুদ্র-সমান অস্থিরতায় মরমীবাদের আধ্যাত্মিক চৈতন্যে জারিত করেছেন, যা তিনি আহরণ করেছেন জন্ম থেকে। পারিবারিক বলয়ে তিনি বড় হয়েছেন 'মালেকা-ই-গজল' বেগম আখতারের ধ্রুপদী গান শুনে আর এটা জেনে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও উচ্চনীচ ভেদ নেই।
সোনমের জীবনধারায় যে সঙ্গীতময়তা আর মানবিকতার ছাপ অঙ্কিত হয়েছে, তা তাঁকে সুফি মিউজিকের ঘরানায় নিয়ে আসে। তিনি গায়ক ও গীত রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'দ্যা সুফি গসপেল প্রজেক্ট'। মানবতা, শান্তি, মৈত্রী, আধ্যাত্মের চিরায়ত ধ্বনিপুঞ্জকে আধুনিক প্রকরণগত আঙিকে উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাপী। নিজে গ্রাফিক্স ডিজাইনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও মনোনিবেশ করেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সন্মিলনে।
দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসার পাশাপাশি সোনম ভূষিত হয়েছেন বহু সম্মাননায়। বিশ্বের ৩০টি দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন, যার মধ্যে আছে সিডনি অপেরা হাউস এবং এমটিভি'র কোক স্টুডিও। তিনি মঞ্চে একত্রে গান গেয়েছেন কিংবদন্তি শিল্পী স্যার বব গ্যালডফ ও সুফি গায়িকা আবিদা পারভিনের সঙ্গে। তিনি সাইফ আলী খান, কারিনা কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাথে গান করেছেন। গেয়েছেন নিক জেনাসের বিয়ের অনুষ্ঠানেও।
সোনমের জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অনুষ্ঠান ছিল মিশরের পিরামিডের সামনে 'বিশ্ব সুফি শান্তি সন্মেলন'-এ সঙ্গীত পরিবেশনা। গেয়েছেন ইন্দো-আফ্রিকান মিউজিক ভ্যাস্টিভেলে এবং ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের নানা দেশের মরমী সঙ্গীত সন্মেলনে।
গানের মধ্য দিয়ে সোনম তুলে ধরেন সত্য, সুন্দর ও শান্তির বার্তা। মানবতার বুননকে মজবুত করতে জাগ্রত করেন মরমী আবহ এবং আধ্যাত্মিক চৈতন্য। সোনম কালরা পরিণত হয়েছেন প্রেম, মানবতা, আধ্যাত্মের প্রতিধ্বনির ধারাবাহিক প্রবহমান এক শৈল্পিক প্রতীক আর সাঙ্গীতিক দ্যোতনায়।