আমি মহিলা নই, আমি নারী: শিপ্রা গোস্বামী
আমি মহিলা নই, আমি নারী। যারা নিজেকে একটি মহলের চার দেওয়ালে বন্দী করে রাখে তারাই মহিলা। আর মহিলা কিন্তু মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার সাধ পায় না। তাই মহিলা নয় নিজেকে নারী হিসেবে পরিচিত করতে হবে সমাজের কাছে।
আর তার জন্য সবার আগে নারীকে নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি করতে হবে। ফরিদপুরের অধিকার বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করেন যিনি, নিজেকে ২৪ ঘণ্টা একজন মানবাধিকার কর্মী ভাবেন তিনি অ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী।
পঞ্চাশোর্ধ সদালাপী হাস্যোজ্জ্বল রঙিন এই নারী ফরিদপুরের নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত। শিপ্রা সকল শৃঙ্খলা ভেঙে নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এর ফরিদপুরের কো-অর্ডিনেটর।
তিনি বলেন, আজও সমাজ তো দূরের কথা আপন পরিবার নারীকে দায় হিসেবে দেখে। আর পুরুষকে সম্পদ মনে করে। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিতে যেভাবে নারীকে ঘর থেকে বের করা দরকার তা এখনো করা যায়নি।
নারীর এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি বাল্য বিয়েকে দায়ী করে বলেন, মেয়েকে পরিবারের বোঝা হিসেবে দেখা হয় বলেই তাকে বাল্য বিয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এতে হঠাৎ করে স্কুলছাত্রী পরিবারের ছোট্ট মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যে পরের ঘরে বউ এবং একটি বিশাল সংসারের বোঝা অপ্রাপ্ত বয়সে দেওয়া হচ্ছে। তাতেই নারী নুইয়ে পড়ছে। আর এর জন্য পরিবারই দায়ী সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, বাল্য বিয়ের কারণে স্বামীর সংসারের জোয়াল ঘাড়ে পড়ায় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ মেয়ের। তাই তারা একটি বন্দী জীবন-যাপন করছে। শারীরিক মানসিকসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অশিক্ষিত অক্ষম নারী বোঝা হয়ে থাকছে সারাটি জীবন।
পরিবারের সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত নারী বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সমাজে মুসলিম পরিবারে একই পিতার ছেলে সন্তান তার পিতার যে সম্পদ পাবে এখনোও মেয়ে সেই পিতার সন্তান হয়েও তার অর্ধেক সম্পদ পায়। আর হিন্দু সমাজে তো আরও সমস্যা। বিয়ের পরে পিতার বাড়িতে তার আর যেন কোনো অধিকার নেই। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করার দাবি করেন তিনি।
নারীবান্ধব পরিবেশও এখনো তৈরি হয়নি। আজও নারী চরমভাবে নির্যাতনের শিকার। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। নারীকে অবহেলা আর অবজ্ঞার চোখেই দেখা সমাজ তো দূরের কথা আপন পরিবারেও। তবে এজন্য ঘরে বসে থাকলে চলবে না, নারীকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে নিজের অবস্থান তৈরি করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী, ছড়াকার, গায়িকা বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যেভাবেই বলি না কেন কোনোটাই ভুল হবে না শিপ্রার বেলায়। ১৯৬৬ সালে চাঁদপুর জেলায় জন্ম। পিতা জগদীশ চন্দ্র গোস্বামী মাতা গায়ত্রী গোস্বামী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় শিপ্রা বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়।
তিনি ঢাকার মানিকগঞ্জের শিবালয় পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি, ফরিদপুর আইন কলেজ থেকে এলএলবি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি থেকে এলএমএমএস সম্পন্ন করেছেন।
বৈবাহিক সূত্রে ফরিদপুরের বধূ শিপ্রা গোস্বামী প্রথমে মাদারীপুর পরে ১৯৮৯ সাল থেকে ফরিদপুরে বসবাস করে আসছেন। চিকিৎসক স্বামী সুনীল কুামার চক্রবর্তী তার জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বলে জানালেন শিপ্রা।
তিনি দুই সন্তানের জননী। বড় ছেলে সুদীপ্ত চক্রবর্তী শুভ্র দন্ত চিকিৎসক আর ছোট ছেলে সৌমিত্র চক্রবর্তী সৌম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। স্বামী সন্তান নিয়ে বর্তমানে তিনি ফরিদপুর শহরের লক্ষীপুরে বসবাস করছেন।
তার জীবনের অন্যতম মজার গল্প হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৮৬ সালের ৮মে বিয়ের দুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম। আর তা বিয়ের আগের দিন দৈনিক বাংলার বাণীতে ছাপা হয়ে ছিল। আর বিয়ের দিন পত্রিকা বর পক্ষের চোখে পড়ায় বেশ মজা হয়েছিল।
এছাড়াও তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেন। দেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকাগুলোসহ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনে তার কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত ৭টি গ্রন্থ। ২০১৩ সালে বইমেলা ৬টি- আমার স্মৃতিতে আমার সত্তায়, দুই সুন্দরী রূপ কথা, ছন্দ ছড়ায় বছর গড়ায়, শীতের পিঠা দারুন মিঠা, সৌমিক ও মুনিয়া পাখি, রোমিও ও বিড়াল ছানা এবং ২০১৬ সালের বইমেলায় ভাষার জন্ম দিন প্রকাশিত হয়।
গ্রাম থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। সংগীত, আবৃত্তি, উপস্থাপনায় কৃতিত্ব রয়েছে। ফরিদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা, উদীচী, খেলাঘর, সচেতন নাগরিক কমিটি, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সদস্য। কর্মজীবনে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত প্রকাশ হয়েছে তার লেখা। ‘সাভার ট্রাজেডি’ শিরোনামের তার লেখা একটি গান গেয়েছেন সংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর।
সংকলনগ্রন্থের রচনা প্রকাশ: জসিমউদ্দীন, নাসির আলী মামুন সম্পাদিত “জসিমউদ্দীন স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা ২০১৩, হুমায়ূন আহমেদ, মফিজ ইমাম মিলন সম্পাদিত, হুমায়ুন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ ২০১৩ ঢাকা, হোচিমিন, কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত, সাংস্কৃতিক খবর হোচিমিন সংখ্যা, কলকাতা, ২০১৩ ইত্যাদি সংকলন গ্রন্থে তার রচনা প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ: রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে বাফা পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮৬ সালে । ২০১৪ সালে দ্য ডেইলি স্টার ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আয়োজিত ‘সেলিব্রেটিং লাইফ অ্যাওয়ার্ড’ প্রতিযোগীতায় শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার পান।