নারী Not for sale

  • জান্নাতুন নাইম প্রীতি
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

জান্নাতুন নাইম প্রীতি এ সময়ের একজন স্বাধীনচেতা লেখক। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কাজ করছেন চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনায়। তিনি একাধারে কবিতা, ছোটগল্প ও সামাজিক নানা প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লেখেন। ছবি আঁকেন, বিতর্ক ও সংগীতসহ শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন।


নারী দিবসের দুইদিন আগে একটা মজার নিউজ পড়লাম, ৬মার্চ পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ-র চেয়ারম্যান রুবানা হক বলেছেন, মানুষ দিবস হওয়া উচিত, নারী না! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু তিনি কি জানেন সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতিত মেয়েদের তালিকায় তাঁর গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েরাই পড়ে? এই মেয়েদের সিংহভাগ ইউরিন ইনফেকশনে ভোগে কারণ মালিকরা বাথরুমে যাওয়ার সময়টা পর্যন্ত এই মেয়েগুলোকে দেয় না?

বিজ্ঞাপন

রুবানা হক বুকে হাত দিয়ে বলেন যে একটা গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়ে ইউরিন ইনফেকশনে ভুগবে না, মালিকের যৌন নির্যাতনের শিকার হবে না, নারী বলে কম বেতন পাবে না। তারপর নারী দিবস দরকার নাই—বলেন, কেমন?

‘থাপ্পড়’ নামের একটা সিনেমা রিলিজ পেয়েছে বলিউডে, অসম্ভব দারুণ এই সিনেমাটা দেখেই মনে পড়ল আমার সর্বশেষ এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপের অন্যতম কারণ ছিল—গায়ে হাত তোলা নিয়ে করা মন্তব্য। সে বলেছিল, প্রেম বা সংসারে সম্পর্কের মধ্যে একজন গায়ে হাত তুলতেই পারে, তুমি কেন বলছো গায়ে হাত তুললেই সেই সম্পর্ক ভেঙে দিতে হবে?

বিজ্ঞাপন

আমি বলেছিলাম কারণ চড়টা কেবল ব্যথা না, ওইটা সম্মানের গায়ে চোট লাগা। মানুষ তখনই কাউকে আঘাত করে যখন তাকে দুর্বল ভাবে, যখন তাকে অসম্মান করে, যেটা রেপিস্টরা করে! শুনে সে বলেছিল, আমার বাবা আমার মাকে চড় মেরেছিল, এখন কি ডিভোর্স দিতে বলব তাদের? আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ, যে লোক তার পার্টনারকে সম্মান করতে পারে না, তার সাথে সম্পর্ক রাখা উচিত না।

মূলত সেইদিন থেকেই আমার সাথে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার শুরু। কারণ যে ছেলে তার বাবার মায়ের গায়ে হাত তোলা ও মাইরকে সমর্থন করে, সে নিজেও একদিন পার্টনারকে মারবে অথবা আঘাত করবে এবং আঘাত করাটাকে বৈধ বলে ভাববে।

কাজেই এসিড নিক্ষেপ, বোমা হামলাকে যেমন আপনি দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে পারেন না, তেমন পারেন না পার্টনারের প্রতি অসম্মানকে।

জ্বি, একটা থাপ্পড়ের কারণে ডিভোর্স হয়ে যাওয়াকে আমি পূর্ণ সমর্থন করি, যেমন করি একজন নারী একজন পুরুষকে ঠিক একইভাবে আঘাত করলে সেই পুরুষের নেওয়া একই সিদ্ধান্তকেও!

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, নারীর সৌন্দর্যের স্কেলটি কার বানানো? কোমরের মাপ, বুকের মাপ, চোখের আকৃতি ঠিক কতটা কী হলে সুন্দর বলা হবে সেটা কার ঠিক করা? ব্যাপারটা একটু খোলাসা করি। লাস ভেগাসের বৈধ সেক্স বাণিজ্য নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের দুই পর্বের একটা ডকুমেন্টারি ‘সেক্স ফর সেল’ দেখেছিলাম। সেখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। এইসব প্রস্টিটিউট মেয়েরা অনেকেই মডেল হতে আসে, অনেকেই মডেলিং থেকেও আসে!

আমার একাধিক নাটক ও সিনেমার পরিচালক বন্ধু আছে। তাদের কাছে জেনেছি যেসব মেয়েরা মডেলিং করতে আসে, অভিনয়ে নাম লেখাতে চায় তারা অনেকেই ভালো নাটকে, ভালো বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজের বিনিময়ে যে কারো শয্যাসঙ্গী হতে রাজি থাকে। বিষয়টা আমি তেমন আমলে নিইনি। কিন্তু আমার পরিচিত এক মেয়েকে যখন ‘কাস্টিং কাউচ’ হতে রাজি আছো কিনা প্রশ্নটা করেছিলাম, তখন সে আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, রাজি আছি!

মেয়েটার উত্তর শুনে যে কেউই গালি দেবে, রাগ করবে, কড়া কথা শুনিয়ে দেবে। কিন্তু একবারও বলবে না, কে ওকে ভাবতে শেখাল যৌনতা যোগ্যতার পরিমাপ? কে ওকে নিজের দেহকে পণ্য বানাতে শেখাল?

মেয়েদের জন্য সুন্দরী প্রতিযোগিতা দেখি, রান্নার প্রতিযোগিতা দেখি, নানারকমের ফ্যাশন প্রতিযোগিতা দেখি, কিন্তু আইকিউয়ের, বুদ্ধিমত্তার আলাদা প্রতিযোগিতা দেখি না। কাগজজুড়ে ছাপানো হয় ঐশ্বরিয়া রায়ের ছবি, কিন্তু যে মেয়েটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, হার্ভার্ডে বা এমআইটিতে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখছে তাঁর খবর পড়ে থাকে খবরের কাগজের চিপায়। তাকে কেউ চেনে না, তাকে চেনানোর গুরুত্বও কম। তার ফুসফুসটিও হয়তো মেরি কুরীর মতন ঝাঁজরা হয়ে যাবে পোলেনিয়াম আর ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করতে করতেই। কিন্তু কেউ তাকে চিনবে না!

বলে রাখি, ইউরোপের মেয়েরা এককালে ভেবেছিল খুব নারী জাগরণ হচ্ছে খোলামেলা পোশাক পরে। কিন্তু তাঁরা যে পণ্য হচ্ছে, পণ্য হতে তাঁদের উৎসাহিত করা হচ্ছে সেটা বোঝা যায় সারা পৃথিবীতে নারী আর পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা হিসেব করলে। পুরুষের হাতে আছে ৯৯% আর নারীর আছে ১%! অথচ কোন বিজ্ঞাপনে নারী নেই? পুরুষের শেভিং ক্রিম, আফটার শেভ লোশান, পারফিউম... শুধু কি পুরুষের! নারীর লিপ্সটিক, ক্রিম, ফাউন্ডেশান সবখানে!

বিশ্বসুন্দরী খেতাব পাওয়া প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বলেছিলেন, এই প্রতিযোগিতা যা দিয়েছে তারচেয়ে আরো বেশি নিয়েছে! আসলে এটাই সত্য। তাদের শেখানো হয়—সুপারস্টার হওয়া মানে গায়ের ভাঁজ, বুকের খাঁজ, কোমরের মাপ। কেউ বলে না সুপারস্টার হওয়া মানে সুপার ট্যালেন্টেড হওয়া, আর্ট হিস্ট্রি নখের ডগায় রাখা, ইউরেনিয়ামের আনবিক ভর মুহূর্তে বলে দেওয়া, যুগান্তকারী কিছু মানব কল্যাণের জন্য আবিস্কার করা!

মধ্যযুগের হারেম, বাইজি, যৌনদাসী প্রথা কি সত্যিই পৃথিবী থেকে উঠে গেছে? আমার তো মনে হয় না! আমার মনে হয় হারেমগুলি এখন মডেল এজেন্সিতে রূপ নিয়েছে মাত্র! নারীকে পণ্যের মতো ভোগের প্রথা দূর হয়েছে, নাকি কেবল কৌশল বদলে গেছে মাত্র?

যোজিবিনি টুনজি নামের সাউথ আফ্রিকান কালো মেয়েটি এবারের মিস ইউনিভার্স হয়েছে। মেয়েটি কালো বলেই একটু বেশি হাততালি দিচ্ছেন কারণ আপনি অবাক হয়েছেন কেমনে একটা কালো মেয়ে চ্যালচ্যালাইয়া ‘বিউটিফুল’ হিসেবে তকমা পায়। আপনি অবাক হয়ে ভাবছেন—হাউ ক্যান ইট পসিবল?

স্কুলে থাকার সময় নাইজেরিয়ার একটা মেয়ে বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার পর আমার এক বান্ধবীও বলেছিল, জানো প্রীতি, কালো ভূত একটা মেয়ে বিশ্ব সুন্দরী হয়েছে? আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ভূত যে কালো এটা তোমাকে কে বলেছে?

ফেয়ার এন্ড লাভলির ফেয়ার অর্থাৎ ফর্সাটা যেহেতু লাভলি আর কালোরে আগলি বলার পর বছরের একদিন মা কালীর কেত্তন করায় বাহাদুরি নাই, আছে চূড়ান্ত হিপোক্রেসি। কারণ আপনি এখনো বুঝেই উঠতে পারলেন না কালারের প্রতি পক্ষপাতিত্বই রেসিজম। কালোকে মহিমান্বিত করতে সাদাকে খাটো করা আর সাদাকে মহিমান্বিত করতে কালোকে অসুন্দর বলা দুটোই আদতে এক জিনিস।

আর দ্বিতীয়ত ‘বিউটি উইথ ব্রেইন’ হইলো এই শতাব্দীর সেরা প্রপাগান্ডা। সুন্দরী প্রতিযোগিতা একটা জঘন্য জিনিস।

এই জিনিসের পাল্লায় পড়ে নির্দিষ্ট বুকের মাপ, কোমরের মাপকে আপনি আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। বার্বি ডলগুলো যেকারণে আমি ঘৃণা করি। কারণ শিশুকাল থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বার্বির মতো বুকের মাপ আর কোমরের মাপ না হলেই আপনি অসুন্দর!

অথচ গোলাপ কতটা লাল, আকাশ কতটা নীল হলে সুন্দর বলা যাবে সেটার কোনো স্কেল নাই, তাইলে আপনার শরীরের জন্য সেই স্কেলের কী প্রয়োজন? প্রয়োজন কারণ এই প্রতিষ্ঠিত স্কেলে আপনার সৌন্দর্য নিয়ে নানান ব্যবসা ফাঁদা যায়, যেন আপনি ব্যবসার উছিলায় নিজেরে নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন। যেন আপনি দিনের নির্দিষ্ট অথবা সিংহভাগ অংশই ব্যয় করেন দীপিকা বা ক্যাটরিনা হতে।

আমি বলছি না দীপিকা বা ক্যাটরিনা অযোগ্য, আমি বলছি তারাও দাবার গুটি। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাগুলো সেই দাবার গুটি হওয়াকে প্রোমোট করে। যে কারণে পর্ন ইন্ড্রাস্ট্রির বছরের আয় আর পর্নস্টারদের নিট ইনকামের হিসাব, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পুরো বছরের আয় আর ফ্যাশন মডেলদের আয়ের হিসাব মেলে না। কারণ এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোও চলে দাবার গুটি হওয়াকে কেন্দ্র করে!

নারী আপনি বরং মহাকাশে ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা হন, বিজ্ঞানে মেরি কুরি আর হাইপেশিয়া হন, লেখায় পার্ল এস বাক হন, মমতায় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হন। দাবার গুটি হওয়ার জন্য আপনার জন্ম না। সাজতে ইচ্ছা করলে সাজেন, কিন্তু বাধ্য হয়ে যেয়েন না। ধরে নিয়েন না এই সাজগোজই নারী জীবনের একমাত্র অবলম্বন।

নারী সৌন্দর্য একটা বোধ, যা আমার কাছে সুন্দর তা আপনার কাছে বিশ্রী—এও হতে পারে! আপনার যোগ্যতা আপনার কর্মে, কর্মের মর্মে। কোনো কোম্পানির ব্যাবসার ছুঁতোয় সৌন্দর্যের বানানো ফর্মে না! বুঝলেন?

নারী, আমি বলছি না আপনি বিজ্ঞাপনে মডেল হবেন না। আমি বলছি আপনি বরং নিজের বিজ্ঞাপন এভাবেই করুন, যেভাবে আপনি বিক্রি হবেন না, যেভাবে আপনি স্বাধীন ইচ্ছেয় চলবেন, যেভাবে হাসিমুখে বলবেন, আমি বিক্রির জন্য নই!

দুনিয়ার সব ফিচারই বিক্রির জন্য, কেবল আত্মসম্মান—not for sale!