পরিবেশকন্যা কাশ্মীরের জান্নাত 'ভারতের গ্রেটা থানবার্গ'
সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ পৃথিবীর কাছে নিজেকে পরিচিত করেছেন পরিবেশের সুরক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নামে পরিচিত তার প্রচেষ্টার কথা এখন বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষের মুখে মুখে। চলতি বছরের শুরুতে সুইডেনের দুই সংসদ সদস্য গ্রেটা থানবার্গের পরিবেশবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য তার নাম প্রস্তাব করেছেন। ২০১৯ সালেও গ্রেটার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
সুইডেনের কিশোরী গ্রেটার মতই ভারতের কাশ্মীরের জান্নাত নামের এক পরিবেশবান্ধব কিশোরী তার কাজের মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছেন। তার বয়সে গ্রেটার চাইতেও কম। তাদের কাজের ধরণটা আলাদা। উদ্দেশ্যে একই। দুইজনেই পরিবেশের সুরক্ষায় কাজ করছেন।
জান্নাতের বাড়ি কাশ্মীরের শ্রীনগরে। বয়স মাত্র সাত বছর। গত দুইবছর ধরে নিয়মিতভাবে শ্রীনগরের প্রসিদ্ধ ‘ডাল’লেককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন এই কিশোরী। তার কাজের স্বীকৃতিতে পরিবেশকন্যা কাশ্মীরবাসী জান্নাতের নাম এখন দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে। আর গণমাধ্যম তাকে 'ভারতের গ্রেটা থুনবার্গ' বলে অবিহিত করছে।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরের শ্রীনগরের নয়নাভিরাম ডাল লেক ছবির মতো সুন্দর একটি জলাভূমি। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই লেকের বাণিজ্যিক ও নৈসর্গিক গুরুত্ব অপরিসীম। কাশ্মীর ভ্রমণে ডাল লেকের নীলাভ স্নিগ্ধ পানিতে 'শিকারা' নামক দেশী বোটে জলভ্রমণ হবে না, তা অকল্পনীয়। কাশ্মীর ভ্রমণের প্রধান আকর্ষণই হলো ডাল লেকে 'শিকারা' বা হাউসবোটে ঘুরে বেড়ানো, রাত্রিযাপন এবং জলে বিম্বিত প্রকৃতি ও নিসর্গের অবলোকন।
দিনে ও রাতের পালাবদলে ডাল লেকের পানিতে ভাসমান বাড়ি-সদৃশ্য দেশী হাউসবোট 'শিকারা' থেকে অনিন্দ্য কাশ্মীরকে দেখা যায় অনেক মোহনীয় ও বহুমাত্রিক দ্যোতনায়। ডাল লেকে সাতশোর বেশী হাউসবোট আছে। এসবের ভিতরে অত্যাধুনিক হোটেলের মত থাকা-খাওয়ার নানা ধরণের সুবিধাজনক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। প্রতিটি বোটই সুসজ্জিত, আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন।
কিন্তু এসব বোট ব্যবহারকারীদের নানা রকমের বর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট ডাল লেককে নিত্যই দুষিত ও আবর্জনাময় করছে। জান্নাত সেইসব ময়লা সাফ করে ডাল লেককে নির্মল করতে সচেষ্ট। মায়ের দরদী হাতে ছোট্ট কিশোরী জান্নাত ডাল লেককে পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিয়োজিত।
জান্নাতকে অনুপ্রেরণা দানকারী বাবা তারিক আহমেদ পাটলু মিডিয়াকে বলেছেন যে, হায়দারাবাদে বসবাসকারী তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন কল পেয়ে তিনি জানতে পারেন যে, তার মেয়ের নাম ও পরিবেশবাদী কর্মকাণ্ড সেখানকার স্কুল পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তখন তিনি তার বন্ধুকে কপিটি পাঠাতে বলেন। তিনি আরো বলেছেন যে, সংবাদটি শোনা তার জন্য একটি গর্বের বিষয় ছিল।
খুদে কাশ্মীরকন্যা জান্নাত জানিয়েছেন, 'লেক পরিস্কার করার জন্য আমি আমার বাবার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই। আমি যে স্বীকৃতি পেয়েছি তা শুধু আমার বাবার কারণে।'
শ্রীনগরের লিন্টন হল স্কুলের ছাত্রী জান্নাত দুইবছর আগে ২০১৮ সালে প্রথম আলোচনায় আসেন। তখন তার বাবা তারিক আহমেদ পাটলু সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। তাতে দেখা যায়, শ্রীনগরের দূষিত ডাল লেককে দেশী নৌকায় চেপে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করার কাজ করছেন কিশোরী জান্নাত।
মর্মস্পর্শী বক্তব্যে সেই ভিডিওতে জান্নাত বলেছিলেন, 'আমি আর বাবা লেককে পরিষ্কার রাখার একটু প্রচেষ্টা করলাম। আমরা সেখান থেকে প্রচুর নোংরা আবর্জনা উদ্ধার করেছি। কিন্তু এইটুকুতেই ডাল লেক পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। ডাল লেক আমাদের সম্পদ। আর এই কাজে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং লেকের সৌন্দর্য যাতে ফিকে না হয়ে যায় সেজন্য সবটাই উজাড় করে দিতে হবে।’
জান্নাতের পরিবেশবাদী কাজের সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। জান্নাত তার কথা ও কাজ দিয়ে মন জয় করে নেন দেশবাসীর। অভিভূত হন দেশটির প্রধানমন্ত্রীও। তিনি নিজে তাঁর টুইটার একাউন্টে সেই ভিডিও শেয়ার করে দেশটির নাগরিকদের আহবান জানিয়ে এই মর্মে মন্তব্য করেন, ‘এই ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনুন, দেখবেন সকালবেলাটা দারুণ কাটবে আপনার। স্বচ্ছ অভিযানে একটি দুর্দান্ত আবেগ জড়িয়ে রইল।’
জান্নাত যখনই পেরেছেন তার বাবা তারিক আহমেদ পাটলুর সাথে কিংবা নিজে একা একাই লেক পরিষ্কারের কাজ করেছেন। লেকের পানিতে ভাসমান ও ডুবন্ত প্লাস্টিক, অ্যালকোহল বোতল এবং পলিথিন বর্জ্য খুঁজে বের করে ফেলেছেন আবর্জনার জন্য নির্ধারিত ডাস্টবিনে। লেক পরিস্কারে তারিক আহমেদ আবার একজন বিদেশি লোকের দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যাকে তিনি কয়েক বছর আগে সিগারেটের ছাই পানিতে ফেলে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে দেখেছিলেন।
জান্নাতের লেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এই কাজ এখন তার স্কুলের বন্ধুদের কাছেও দারুণ সমাদৃত ও পরিচিত। জান্নাত তার বন্ধুদেরও পরিবেশ সচেতন হতে আহবান করছেন। জোর দিয়ে বলছেন, বর্জ্য পদার্থ খোলা জায়গায় নয়, ডাস্টবিনে ফেলার জন্য। এছাড়াও তিনি স্থানীয় মানুষ এবং সেখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে লেকে আবর্জনা না-ফেলার আবেদন জানাচ্ছেন। লড়ে যাচ্ছেন লেক সুরক্ষায়, পরিবেশ সুরক্ষায়। তার সাথে বাবা ছাড়াও আছেন পুরো দেশ আর বিশ্বের পরিবেশবাদী মানুষ। পরিবেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি তীব্র মমতাবোধ কিশোরী জান্নাতকে পরিণত করেছে 'ভারতের গ্রেটা থানবার্গ'-এ। আর তাকে রূপান্তরিত করেছে এক অদম্য-উদ্যমী ও অক্লান্ত-পরিশ্রমী পরিবেশকন্যায়।
পরিবেশকন্যা কাশ্মীরের জান্নাত 'ভারতের গ্রেটা থানবার্গ', ছবি: সংগৃহীত