নিষেধাজ্ঞার পরও শাটার নামিয়ে, তালা ঝুলিয়ে চলছে ‘কোচিং বাণিজ্য’
একজন একজন করে ভিতরে প্রবেশ করছে। কারো কাঁধে ব্যাগ, কারো হাতে খাতা কলম। সবার গন্তব্য একটাই ‘পলিভিটা কোচিং সেন্টার’। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ‘কোচিং সেন্টার বন্ধের সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে’ বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সবুজবাগের এই প্রতিষ্ঠানটি।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার পর এসএসসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রেখেছে তাদের কার্যক্রম। তবে এই নিষেধাজ্ঞা অনেকের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান ‘পলিভিটা’-কোচিং সেন্টার। তবে শুধু যে পলিভিটা কোচিং সেন্টার সরকারি নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা করছে তা নয়, মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন ঘুরে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ নির্দেশনা আমান্য করতে গিয়ে তাদের নিতে হয়েছে ছলচাতুরীর আশ্রয়। কেউ কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নাম করে গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ শাটার ও সাইনবোর্ড নামিয়ে রেখেছে। তবে এসবের আড়ালে চলছে কোচিং সেন্টারের কার্যক্রম।
সরেজমিনে ঘুরে দেখে গেছে, রাজধানীর কোচিং বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে খ্যাত মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, বেইলীরোডে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী বেশি কয়েকটি কোচিং সেন্টারে তালা ঝুলতে দেখা যায়। এমনকি কোচিং বন্ধের নোটিশও টানিয়ে রেখেছেন কর্তৃপক্ষরা।
বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অভিনব সব কায়দায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার। কোনো কোনো কোচিং সেন্টার গেইটে তালা ঝুলিয়ে আবার কেউ কেউ সাইনবোর্ড সরিয়ে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, বাহিরের সব লাইট বন্ধ কিন্তু কক্ষের ভিতরের লাইট জ্বালিয়ে ক্লাস নিচ্ছে। এছাড়া স্থায়ী ঠিকানা থেকে সরে গিয়ে এক মাসের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েও অনেক কোচিং সেন্টার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসব কোচিং সেন্টারের কর্তৃপক্ষদের প্রশ্ন করা হলে তারা কার্যক্রম চালিয়ে রাখার বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নয় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন। আবার কিছু কিছু কোচিং সেন্টারের কর্তৃপক্ষ বলছেন, এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাড়া অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে সরকারের কোনো নিষেধ নেই।
এমনই ভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানীর সবুজবাগে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘কমার্স’কোচিং কর্তৃপক্ষ। মিরপুর ১০ নম্বরের ‘জব মেকার’ কোচিং সেন্টার। কোচিংয়ের লাইব্রেরী চালু রাখার নামে বিসিএস পরিক্রমা নামে মিরপুরের একটি কোচিং সেন্টার তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কমার্স কোচিংয়ের মালিকদের একজন রাব্বী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা সরকারি নির্দেশ মেনেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ছাড়া অন্যদের ক্লাস নিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আমি সরকারি নির্দেশ পড়েছি।
এদিকে রাজধানীর পূর্বরাজা বাজারে অবস্থিত বীকন কোচিং সেন্টারে বাহিরে তালা ঝুলিয়ে ভিতরে চলছে ক্লাস। এ বিষয়ে বীকন কোচিং সেন্টারের কর্মকর্তা সুজন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের শুক্রবার, মঙ্গলবার ও বুধবারে ক্লাস চলে। তবে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নয়, অনার্সের ছাত্রদের ক্লাস নেওয়া হয়। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস হবে না বলে তাদের আমরা জানিয়ে দিয়েছি।
কিন্তু বীকনে ক্লাস করতে আসা এক শিক্ষার্থীর আহমেদ হৃদয় বার্তা২৪.কমকে জানায়, সে এসএসসি পরীক্ষার্থী। কোচিং ক্লাসে তাদের এখন এসএসসি পরীক্ষার আদলে মডেল টেস্ট চলছে। তাই শিক্ষকরা মডেল টেস্ট দেওয়ার জন্য তাদের কোচিং সেন্টারে ডেকেছে।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার শিক্ষার্থীদের মাহমুদ সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সে ইরা কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিলে সমস্যা হবে বলে, শিক্ষকরা তাদের এখন নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন।
প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ক্লাস নেওয়ার জন্যই প্রতিষ্ঠানটির শিকক্ষরা এ কায়দা বেছে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, মিরপুরে অনেক কোচিং সেন্টার তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। তালা ঝুলিয়ে শাটার নামিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনেকে ভয়ে ভয়ে আছে কখন পুলিশ যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস যা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অলিতে গলিতে যদি কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করতে না পারে তাহলে প্রশ্নফাঁস চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে কোচিং সেন্টারগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন ফর স্যাডো এডুকেশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হাসান সোহাগ বার্তা২৪.কমকে বলেন, এসএসসি পরীক্ষার আগে থেকে সকল কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন যদি কেউ তা না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বার্তা২৪.কমকে বলেন,দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কোচিং সেন্টারগুলো মারাত্মক হুমকি। কিছু কিছু কোচিং সেন্টারের মালিকরা শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস নয় পরীক্ষা হলে বসে রিটেন জালিয়াতিসহ নানা অপকর্ম তারা করেছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় এর প্রমাণও পাওয়া গেছে।
উল্লেখ, এসএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে ২৭ জানুয়ারি থেকে আগামী এক মাস সব ধরনের কোচিং সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষামন্ত্রণালায়। এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার গুজব ঠেকানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এটি অন্যতম একটি।