'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'
বাঙালির চেতনায় চিরায়ত কাল থেকেই সন্তানের কল্যাণ কামনার বার্তা স্পষ্ট। বাংলার মায়েরা সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সত্ত্বা। বাড়িতে, পথে, স্কুলে, পেশায়, সঙ্কটে ও সমস্যায় সন্তানের বিপদ দেখলে সবচেয়ে আগে এগিয়ে যিনি, তিনি আর কেউ নন, মা জননী।
বাংলার মায়েদের তুলনা করা হয় ছায়াদায়িনী মহাবৃক্ষের সাথে। পাখির নিরাপদ ডানায় অসহায় শাবককে আগলে রাখার প্রতীক হলেন মা। মা বাংলার শিশু-কিশোরদের প্রথম শিক্ষক, পথ-নির্দেশক, জীবনের নির্মাতা ও নিরাপত্তার সংরক্ষক।
বাংলার কবি ও শিল্পীরা মায়ের অম্লান ছবি অঙ্কন করেছেন আস্থা, নির্ভরশীলতা ও আশ্রয় হিসাবে। মায়ের কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন অমর ধ্বনিমালা, যা সন্তানের সার্বিক নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ, মঙ্গল ও কল্যাণের বার্তাবহ। বাংলার মাতৃকুল সন্তানের জন্য বরাভয়ের অপর নাম।
'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে', হলো সন্তানের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মায়ের এক চিরন্তনী ভাষ্য। বহুল ব্যবহৃত হলেও অনেকের জানা নেই, কোন কবির কলম দিয়ে এই অমর লাইনটি রচিত হয়েছে।
উদ্ধৃতিটির রচয়িতা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। এই রচনাটির পেছনে চমৎকার একটি পটভূমিকাও রয়েছে। মূলত 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের প্রধান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অনেক অসাধারণ লেখা থাকলেও এই কবিতাছত্র তাঁকে অমর করে রেখেছে।
কবিতাটির কাহিনী আখ্যানটি হলো এরকম: অন্নপূর্ণা দেবী কুলবধূ বেশে খেয়া পারের জন্য নদীর ঘাটে এলেন। মাঝি ঈশ্বরী পাটনী তার পরিচয় জানতে চাইল। কুলবধূ স্বামীর নাম মুখে আনবেন না। কথা যথার্থ। মাঝি রাজি হয়ে তাকে নৌকায় তুলল। কুলবধূ নৌকায় কাঠের সেঁউতিতে পা রেখে বসলেন। মুহূর্তেই কাঠের সেঁউতি সোনায় রূপান্তরিত হল। এ কী কাণ্ড! মাঝি ঈশ্বরী পাটনি বুঝে গেল-- এ তো কূলবধূ নয়, নিশ্চয় কোনো দেবী। অন্নপূর্ণা ছদ্মবেশ ছেড়ে বললেন, 'তুমি কী বর চাও'। মাঝি তখন যা চাইবে তা-ই পাবে। ফলে সে তার সন্তানদের মায়ের মনোবাঞ্ছার কথাই দেবীকে জানালো: 'প্রণামিয়া পাটনী কহিছে জোড় হাতে/ আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।'
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২ – ১৭৬০) অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি। হাওড়া জেলার পোড়ো-বসন্তপুরে জন্ম হলেও পরবর্তী জীবনে তিনি নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়অন্নদামঙ্গল কাব্যের স্বীকৃতিতে তাঁকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্নদামঙ্গল ও এই কাব্যের দ্বিতীয় অংশ বিদ্যাসুন্দর তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ও হিন্দুস্তানি ভাষার মিশ্রণে আশ্চর্য নতুন এক বাগভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে বাংলা কবিতায় নিপুণ ছন্দপ্রয়োগ ছিল তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাব্যের অনেক পঙক্তি আজও বাংলা ভাষায় প্রবচনতুল্য।
যথাযথভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যকে তুলনা করেন “রাজকণ্ঠের মণিমালা”র সঙ্গে। তার আর একটি বিখ্যাত কাব্য সত্য পীরের পাঁচালি। তিনি ১৭৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সমাপ্তি হয়।
তিন শতাধিক বছর আাগে, মধ্যযুগের মহান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বাঙালির শাশ্বত একটি চাওয়ার কথাই বলেছিলেন, যে চাওয়া সন্তানের জন্য বাংলার মায়েদের চিরকালীন প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করেছে।
মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র বর্তমানের এই বাংলাদেশে যদি জন্ম নিতেন, ক'দিন ধরে চলতে থাকা কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলন দেখে উৎকণ্ঠিত হতেন নিশ্চয়। তিনি অবশ্যই চাইতেন না যে, শিশু-কিশোররা সড়কদানবের হত্যাযজ্ঞের শিকার হোক। তিনি এটাও চাইতেন না যে, শিশু-কিশোররা তাদের মূল কাজ পঠন-পাঠন বাদ দিয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় থাকুক। তাদের জীবন, ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হচ্ছে দেখে নিশ্চয় কবি নীরব থাকতে পারতেন না।
'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'-এর মতো ঐতিহাসিক ভাষ্যের নির্মাতা আজকের ঘোলাটে, অনিশ্চিত ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সন্তানের কল্যাণ কামনায় কি লিখতেন? কোন এক মায়ের মুখ দিয়ে সন্তানের মঙ্গলার্থে এই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে কোন কল্যাণ-বার্তা উচ্চারণ করতেন তিনি?
মধ্যযুগের অমর কবি ভারতচন্দ্র নেই। কিন্তু বাংলার মাতৃ সমাজ তো রয়েছেন। তাদেরকে সন্তানের জন্য মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করতেই হবে; সন্তানের কল্যাণধ্বনি জাগিয়ে রাখতেই হবে শত বিরূপতা ও বিপদের মধ্যেও। সকল সঙ্কট থেকে সন্তানদের বাঁচিয়ে রেখে বলতেই হবে: 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।'
ছবি: সুমন শেখ ও তামিম