কিশোরগঞ্জের স্বশিক্ষিত শিল্পী গৌতম
কিশোরগঞ্জ: স্টেশন রোড। হাসপাতাল থেকে সদর থানার সামনে দিয়ে রেল স্টেশন পর্যন্ত শহরের প্রধান সড়ক। জেলা সদরের সবগুলো হাসপাতাল, ক্লিনিক, ঔষধের দোকান গিজগিজ করছে এখানে।
'শহরে সবচেয়ে বেশি দোকান সম্ভবত মেডিসিনের?'
প্রশ্নটি করতেই উত্তর পেলাম সঙ্গে সঙ্গে। স্থানীয় একজন বললেন, 'হাসপাতালের চোরাই ঔষধ কেনা-বেচার জন্যই এখানে এতো মেডিসিন শপ চালু হয়েছে।'
বক্তব্যটি সত্য। কদিন আগেই জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এখানে অভিযান চালিয়ে প্রচুর চোরাই ও নকল ঔষধ জব্দ করেন। আটক করেন কয়েকজন ফার্মেসি মালিককে।
ঢাকার কলা বাগানের লাজ ফার্মা থানার সামনে সদ্য তাদের কিশোরগঞ্জ শাখা খুলেছে। হাসপাতালে ভর্তি এক রোগির জন্য সঠিক ঔষধ কিনতে গত কদিন ধরে সকাল-বিকাল সেখানে আসা-যাওয়া করছি।
পাশেই 'রংলিপি' নামে একটি দোকান চোখে পড়ে। আগেও এ পথে যেতে-আসতে দোকানটি দেখেছি। সাধারণ কমার্শিয়াল আর্টিস্টের দোকানের বেশি অন্য কিছু মনে হয় নি তখন।
কাছ থেকে গত কদিন 'রংলিপি' নামের দোকানটির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে অবাক হলাম। রবীন্দ্রনাথের অন্য রকম একটি তৈলচিত্র নজর কেড়ে নিল। পাশেই চকচক করছে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের একটি পোর্টাল। আরও নানা রকমের ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম, ডিজাইন ইত্যাদি চোখ এড়ায় না।
ঈদের দিন (বুধবার) বিকেলে আশেপাশের প্রায়-সব দোকানপাট যখন বন্ধ, তখনও খোলা পাওয়া গেল দোকানটি। হাতে সময় থাকায় গিয়ে বসি 'রংলিপি'তে।
আগে কখনো না এলেও কর্ণধার সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, 'আমি আপনাকে চিনি স্যার।' আমি তার নাম-পরিচয় জেনে নিই। গৌতম দেবনাথ তার নাম। আমি তার কাজগুলো নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করি।
রবীন্দ্রনাথের অভিনব তৈলচিত্রটি বাঁশের চাটাই কেটে তৈরি করা হয়েছে। চাটাই যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য কেমিক্যালে প্রসেস করা, 'দীর্ঘ বছর স্থায়ী হবে ছবিটি। ঘুণ বা পোকায় কাটবে না। বর্ষা বা অতি গরমেও নষ্ট হবে না', জানান গৌতম।
শিল্পাচার্য জয়নুলের ছবিটি ভালো করে দেখলাম। প্লাস্টিক কেটে অভিনবভাবে তৈরি সুন্দর প্রতিচ্ছবি। আরও দেখতে পেলাম মাটির তৈরি মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য। শোলার মধ্যে যন্ত্রাংশ লাগিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩ উপজেলার ভৌগোলিক ইমেজ ফুটিয়ে বানানো হয়েছে চমৎকার ঘড়ি।
'রংলিপি' কেবলমাত্র কমার্শিয়াল কাজ করার দোকান নয়। বিভিন্ন ক্রেস্ট, মেমেন্টো, স্মৃতি স্মারক, সম্মাননা স্বীকৃতি, শ্বেত পাথরের শিল্পবস্তু ইত্যাদি তৈরির জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এখানে আসেন। আশেপাশের নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহ থেকেও অভিনব বা জটিল কাজের জন্য মানুষ ভিড় করেন এখানে।
গৌতম দেবনাথ কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলেও প্রতিটি কাজে নিজের শৈল্পিক স্পর্শ দেন। নিজেই তিনি তৈরি করেছেন আলাদা ধরণের হরফ বিন্যাস। নিজস্ব ফ্রন্ট তিনি হাতে এঁকে বানিয়েছেন, যেগুলো কম্পিউটার বা প্রচলিত অন্যান্য ফ্রন্টের চেয়ে আলাদা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, মধ্য-চল্লিশ বয়সের গৌতম এসএসসি'ও পাস করেন নি। শিল্প সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোনও শিক্ষাই তার নেই। একেবারেই স্বশিক্ষিত, স্বনির্মিত এই শিল্পীর আদিবাস সদর উপজেলার মহিনন্দ গ্রাম। বর্তমানে থাকেন শহরের বত্রিশ-নগুয়ায়।
পিতা সতীশচন্দ্র দেবনাথ ছিলেন লোককবি। গ্রামে গ্রামে গান গাইতেন তিনি। পিতার সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে কেটেছে গৌতমের শৈশব। স্কুলে ভর্তি হলেও কোন পরীক্ষায় পাস করে সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব হয় নি তার পক্ষে। 'পড়ার চেয়ে মাটি দিয়ে বিভিন্ন বস্তু ও দৃশ্য বানাতেই আমি বেশি পছন্দ করেছি শৈশবে। সেই আগ্রহই আমাকে নিয়ে এসেছে বর্তমান পেশায়', জানান গৌতম।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন এই স্বনির্মিত ব্যক্তি শৈল্পিক কাজের পাশাপাশি কবিতা চর্চাতেও মগ্ন। ২০১৭ সালে 'জলনূপুরের কাব্য' নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাতে তার নান্দনিক মননের প্রচ্ছায়া স্পষ্ট: 'একদিন ছবি হয়ে যাবো/চার দেয়ালে বন্দি কাচের ছাঁচে/ভেঙে যাওয়ার ভয়/আতঙ্কিত উত্তাপ/নিত্যসঙ্গী হবে ক্রোধান্বিত ক্রন্দনে।'
শিল্পে-কবিতায়-নন্দনের আবহে জারিত কিশোরগঞ্জের স্বশিক্ষিত শিল্পী গৌতম দেবনাথ স্বপ্ন দেখেন মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে আরও বড় মাপের কাজ করার। 'শিল্পের সঙ্গে মানুষ-প্রকৃতি-ইতিহাসের মেলবন্ধন রচনার প্রয়াসই আমার জীবনের একমাত্র অভীষ্ঠ লক্ষ্য', স্পষ্ট ভাষায় গৌতম জানান তার জীবনবোধ।