অন্য রকম 'জলাতঙ্ক'!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

কুকুরের কামড়ের জলাতঙ্ক নয়, অন্য রকম ‘জল-আতঙ্ক’-এ আক্রান্ত হতে চলেছে পৃথিবী! অবিবেচক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর পানির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বের অনেকগুলো শহর জলশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে সেসব শহর। সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা সমীক্ষায় এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ পেয়েছে।

বিজ্ঞানিদের কাছ থেকে এ তথ্য এসেছে প্রমাণসহ। বলা হচ্ছে, অচীরেই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন হবে প্রথম শহর, যেখানে জল আর পাওয়াই যাবে না। সমস্যাটি প্রকট হতেও যে বেশি দেরি নেই, তা-ও টের পাওয়া যাচ্ছে। শহরটিতে খেলতে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেট দলকে জল-স্বল্পতার কারণে দু’ মিনিটের বেশি সময় স্নান করার অনুমতি দেওয়া হয় নি! নগরবাসীকেও পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাপী পানি নিয়ে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা নতুন নয়। অতীতে পানির জন্য বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে। আদিম জনগোষ্ঠী পানির উৎস, নদী, জলাধার, হ্রদের দখল পেতে লড়াই করেছে। প্রতিপক্ষকে নিধন করে বসবাস করেছে সেখানে, যেখানে পানি সহজলভ্য। মানব সভ্যতার বিকাশও ঘটেছে জলের ধারে-কাছে। পানি ছাড়া জীবন ও সভ্যতার অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। সেই পানিই এখন দিনে দিনে কমছে।

আধুনিককালে বিশ্বের প্রায় সকল শহর-নগরে পানির স্তর নেমে যাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। ব্যাপক নগরায়ণ, পানি সংরক্ষণের অভাব, পলিথিনের দ্বারা পানির স্তর বিনষ্টসহ নানাবিধ কারণে পানির তীব্র সঙ্কট ও স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি যে এতো মারাত্মক হয়ে চোখের সামনে চলে আসবে, তা কেউ ভাবে নি। কেপ টাউনের পানিহীনতার বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিশ্বের টনক নড়িয়ে দিয়েছে।

অতলান্ত সমুদ্রজলের তীরে সাজানো শহর কেপ টাউনেরই যদি পানির জন্য এমন দুরাবস্থা হয়, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শহরগুলোর বিপদ কত মারাত্মক হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আফ্রিকার অপর পাশে অবস্থিত এশিয়ার দেশগুলো হিসাবে আমাদের সামনে কেমন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে? এসব প্রশ্ন জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়ার দরকার পড়েছে এইজন্য যে, বিপদ আমাদের দোর গোড়ায় এসে হানা দিয়েছে বলে গবেষণায় জানা যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, ভারতের প্রায় ২১টি শহর খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে জলশূন্যতার দিকে। ২০২০ সালের মধ্যেই ‘জিরো গ্রাউন্ড লেভেল’-এ পৌঁছে যাবে এই শহরগুলোর জলস্তর। ভারতের বিপজ্জনক শহরগুলোর মধ্যে আছে বেঙ্গালুরু, দিল্লি-গুরগাও, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, বিজয়ওয়াড়া, অমরাবতী, শোলপুর, শিমলা, কোচি, ইন্দোর, জালনা, আওরঙ্গাবাদ, ভোপাল, উজ্জয়িনী ইত্যাদি। সেসব শহরে ইতিমধ্যেই ওয়াটার ট্যাঙ্কার ব্যবহার ও জলাধার উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। নাগরিকদের পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা রকমের কঠোর বিধি-নিষেধের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

পরবর্তী ধাক্কাটা যে কলকাতা, পাটনায় এসে লাগবে, বিশেষজ্ঞরা সে কথাও বলেছেন। সে ধাক্কার তোড়ে তাপর আমাদের ঢাকার অবস্থা কেমন হবে, তা ভাবতেও ভয় হচ্ছে। থিক থিক মানুষ এ শহরে প্রতিদিন অকাতরে পানি খরচ করছে। প্রতিদিনই বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে। ব্যবহারের জন্য মাটির গভীর থেকে পাম্প দিয়ে টেনে তোলা হচ্ছে পানি। পানির স্তর নামছে হু হু করে।

রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান পানিশূন্যতার মধ্যে জলাধার ও নদী-নালা দখল করছে ভূমিদস্যুরা। ঢাকার চারপাশের খোলা ও জলবহুল জায়গা ভরাট করে সেগুলো ভূমিরাক্ষসরা গিলে খাচ্ছে প্রতিদিনই। সামান্য বৃষ্টিতে শহর-উপচানো বন্যা-সদৃশ্য জলাবদ্ধতা দেখে ভূমিদস্যু ও ভূমিরাক্ষসদের অপকর্মের গভীরতা প্রতিটি নাগরিকই মর্মে মর্মে টের পাচ্ছেন।

এইসব বিপদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে সৃষ্ট সমস্যাগুলো। এই নগরে মানুষের ভিড়ের মধ্যেই হাজার রকমের কল-কারখানায় প্রতিদিন পানির খরচ বাড়াচ্ছে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য দিয়ে ভূমণ্ডলের পানিকে বিষিয়ে তুলছে।

পানির প্রতি উদাসীনতা এবং পানি-বিরোধী নানা আত্মধ্বংসী অপধারা চলতে থাকলে কেপ টাউনের দুর্ভাগ্য ঢাকার ললাটে এসে লেপ্টে যেতে বেশি দিন লাগবে না!