সচেতনতাই ‘সিলিকোসিস’ প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার

  • মো. আকতারুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘সিলিকোসিস’ শব্দটি বাংলাদেশে খুব পরিচিত নয়। তবে এটি একটি মরণব্যাধি, যা ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, সর্দি-কাশি, জ্বর সবসময় লেগে থাকে, শরীর দিনদিন দুর্বল হয়ে পরে ও ওজন কমে যায়। এক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। সাধারণত পাথর ভাঙা শ্রমিকরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

পাথরের উপাদান সিলিকা (স্ফটিকের ধুলো) থেকে এ রোগ হয় বলে একে ‘সিলিকোসিস’ বলা হয়। সিলিকা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহের ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফুসফুসের সূক্ষ ছিদ্রগুলোকে বন্ধ করে দেয়। এমনকি পাথরের ধুলিকণা নাক, মুখ এমনকি চোখের মধ্যদিয়ে শরীরে প্রবেশ করায় ফসফুস ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতপক্ষে সিলিকোসিস রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই সচেতনতাই এ রোগ প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার। সিলিকোসিস তিন ধরনের হতে পারে:

১. সাধারণ সিলিকোসিস/হালকা সিলিকোসিস: ধুলোর মধ্যে কাজ করলে ১০-৩০ বছরের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এ রোগ শনাক্ত করা কঠিন। তবে এক্ষেত্রে, অব্যাহত খুসখুসে কাশি এবং শ্বাসকষ্টজনিত চিনচিনে ব্যাথা হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

২. বর্ধমান সিলিকোসিস সিলিকার: ধুলোর মধ্যে কাজ করলে ৫-১০ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এটিও সাধারণ সিলিকোসিসের মতোই। তবে এর সংক্রমণ দ্রুততার সাথে জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

৩. জটিল সিলিকোসিস: এটি জটিল আকার ধারণ করে যখন ফুসফুসের বায়ু কুঠুরিগুলো যুক্ত/স্ফিত হয়ে এক সেন্টিমিটার বা তারও বেশি বড় হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে খুব সমস্যা হয়। এ সময় যক্ষা ও ছত্রাক সংক্রমণের মতো রোগগুলো একে আরো জটিল করে তুলতে পারে। এ সমস্যা ধীরে ধীরে ফুসফুসের ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে।

এগুলোর বাইরে যেটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতি তা চরম সিলিকোসিস। পাথরগুড়া বা পাথরের ধুলা শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করার কারণে কয়েক সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে একিউট বা চরম সিলিকোসিস বলে।

চরম সিলিকোসিসে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কাশি ও দুর্বলতা বাড়ায় এবং ওজন কমে যায়। এ অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়। এ রোগে বেসরকারি হিসাব মতে, এখনও পর্যন্ত ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, সিপাইপাড়া, ভোজনপুর, জগদল, ময়নাকুড়ি এলাকা,  জয়পুরহাটের আক্কেলপুর বিভিন্ন এলাকায় শিলপাটা তৈরির কারখানায় কয়েক

হাজার শ্রমিক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত। পাথরভাঙা শ্রমিকদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১২ সালে। সে সময় লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের সিলিকোসিসে আক্রান্ত ৫৩ জন শ্রমিকের সন্ধান পায় জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা।

বক্ষব্যাধি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতপক্ষে সিলিকোসিসের কোনো চিকিৎসা নেই। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা প্রতিরাধ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে সিলিকা ধোঁয়া বেরিয়ে যেতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত একজন শ্রমিকের শ্বাস-প্রশ্বাসে সংস্পর্শে না আসা, শ্রমিকের ব্যক্তিগত সচেতনতা ও মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করাও এ রোগ প্রতিরোধের অংশ হতে পারে।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দরে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা পাথরভাঙা কারখানাগুলোয় সিলিকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। ভারত ও ভুটান থেকে আমদানি করা বোল্ডার পাথর, লাইমমেটালসহ বিভিন্ন ধরনের পাথরভাঙার সময় প্রচুর পরিমাণে সিলিকা কণা তৈরি হয়। এগুলো শ্রকিকের সারাদেহ ঢেকে দেয়। মাঝে মাঝে ধোঁয়ার পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পানি ব্যবহার করা হয়। তবে পানি ব্যবহারে উৎপাদিত পাথরের গুণগতমান নষ্ট হওয়ার অজুহাতে মলিকপক্ষ তা করতে দেন না। এতে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে শিলপাটা তৈরির কারখানায় কাজ করতে গিয়েও সিলিকোসিসে প্রায় অর্ধশত লোকের মৃত্যু হয়েছে।

পাথরভাঙা শ্রমিকদের সিলিকোসিস সম্পর্কে সচেতন করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ লেবার স্ট্যাডিজ (বিলস) কাজ করছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, লালমনিরহাটের স্থানীয় প্রশাসন, সিভিল সার্জন অফিস, একসাথে কাজ করছে। সিলিকোসিস রোগের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিলস এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল যৌথভাবে গবেষণা করছে। বেসরকারি সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি বুড়িমারীর পাথর শ্রমিকদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যক্যাম্প পরিচালনা করছে।

পাথরভাঙা শ্রমিকদের সিলিকোসিস থেকে বাঁচাতে মালিক-শ্রমিকের ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাস্ক ছাড়া কোনোক্রমেই কাজ করা উচিত নয়। সেইসাথে কারখানা মালিককেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি পাথরভাঙার মেশিনগুলো জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে হবে। কোনো মতেই খোলাস্থানে কোনো পাথরভাঙা যাবে না এবং পাথর ভাঙার সময় পাথরে পর্যাপ্ত পানি ঢালতে হবে। কারণ পাথরের ধুলায় শুধু শ্রমিকই নয়, এলাকার লোকজনেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।

এ রোগ প্রতিরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকের বিশেষ পোশাক ও মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রতিষেধক ওষুধ ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। পদক্ষেপগুলো শুধু বুড়িমারীতে কিংবা তেঁতুলিয়াতেই নয়, যেখানে পাথর ভাঙা হয় সেখানেই নিতে হবে।

সিলিকোসিস প্রতিরোধের বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ডা. আনিসুল আওয়াল বলেন, ‘পাথর ভাঙার কাজ কোনোভাবেই খোলা পরিবেশে করা যাবে না। এমনকি পাথর ভাঙার সময় পর্যাপ্ত পানি ঢালতে হবে। যেখানে পাথর ভাঙা হবে সেখানেই ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানার ভেন্টিলেশনের মাথায় এক্সজাস্ট ফ্যানের সাথে এই ঝর্ণা লাগাতে হবে, যাতে বাতাসে ডাস্ট বা ধূলিকণা মিশতে না পারে। শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। পরিস্কার না করে কোনো মাস্ক ব্যবহার করা যাবে না।’