আট বছরে ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি
জাবিতে বাড়ছে ভর্তি আবেদন ফি, সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০ সেশনে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার অনলাইন আবেদন শুরু হয়েছে। ছয়টি অনুষদ ও তিনটি ইনস্টিটিউটের অধীনে মোট ১০টি ইউনিটে ভর্তির আবেদন চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নানা সমালোচনার মুখে আবারও বাড়ানো হয়েছে ভর্তি ফরমের মূল্য। এ বছর এ, বি, সি, ডি এবং ই ইউনিটের ভর্তির ফরমের মূল্য গত বছরের চেয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সি১, এফ, জি, এইচ এবং আই ইউনিটের ফরমের মূল্যও ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০১১-১২ সেশনে এ, বি, সি এবং ডি ইউনিটের ভর্তি ফরমের মূল্য ছিল ৩৫০ টাকা। ক্রমান্বয়ে ২০১৫-১৬ সেশনে ৫২৫ এবং ২০১৬-১৭ সেশনে ৫৫০ টাকা তথা প্রতি বছর ফরমের মূল্য ২৫ টাকা করে বৃদ্ধি করা হলেও এবার বৃদ্ধি করা হয়েছে ৫০ টাকা। ফলে বিগত ৮ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস বিভাগের সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ সেশনে ভর্তির ফরম বিক্রি বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয় করে ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ভর্তির যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে এ খাতে অবশিষ্ট থাকে ৯ কোটি টাকা। অবশিষ্ট টাকা ভর্তি পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকরা পারিশ্রমিক বা সম্মানী হিসেবে পকেটস্থ করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস সূত্রে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ভর্তির ফরম বিক্রি বাবদ আয়ের শতকরা ৪০ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভর্তি পরীক্ষার খরচ বাদে সমুদয় অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নেন শিক্ষকরা।
প্রশাসনিক সূত্রের তথ্যমতে, ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন ও কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে উপাচার্য তিন লাখ, উপ-উপাচার্যদ্বয়, কোষাধ্যক্ষ, সকল অনুষদের ডিন ও ইনস্টিটিউটের প্রধান পেয়েছেন দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা করে। আর ভর্তি পরীক্ষায় যে সব শিক্ষক ডিউটি বা পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটিতে যে সব কর্মকর্তারা যুক্ত রয়েছেন তারাও পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে।
ভর্তি ফরমের মূল্য বৃদ্ধিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় উপাচার্য মূল্য কমানো যায় কিনা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
দিন দিন ফরমে মূল্য বৃদ্ধি করা অমানবিক আখ্যা দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, ‘ফরমের মূল্য বৃদ্ধিতে এই সময়ে ভর্তিচ্ছু দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সংকটে পড়ে। শিক্ষকদের এই ভাগবাটোয়ারা একদিকে যেমন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শোষণ করে অন্যদিকে শিক্ষকদের ভোগ বিলাস হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সম্মিলিত শিক্ষক সমাজের সদস্য ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘গণহারে সবার জন্য ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানো উচিত নয়। দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে সত্যি কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। আর দু’বেলা খাওয়ার টাকা থাকে না এমন শিক্ষার্থীরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষায় ডিউটি দিয়ে ‘চমকপ্রদ’ অংকের টাকা আমরা নিচ্ছি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগেকার তুলনায় আমাদের বেতন বেড়েছে। ফলে ভর্তিচ্ছু অভিভাবকের পকেট কেটে টাকা রোজগার করা শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক নয়।’ তাছাড়া ভর্তি সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের বিষয়ে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভর্তি আবেদন ফি বাড়ানোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন বলেন, ‘এ বছরের বাজেটের পর জিনিস-পত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ফরমের দাম বাড়ানো হয়েছে।’
গত বছরই ভর্তির ফরম থেকে ৯ কোটি উদ্বৃত্ত থাকার পর এবছর আবার কেন দাম বাড়ানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘একটি নিয়ম চালু হলে তা বন্ধ করা যেকোনো প্রশাসনের পক্ষে কষ্টকর। তাছাড়া প্রতি বছর শিক্ষকদের সম্মানী বাড়ানোরও একটা চাপ থাকে।’
সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা হলে এমন চিত্র দূর করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘ফরমে মূল্য বৃদ্ধি বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ বিষয়।’ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা না দিলে ইউজিসি’র পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। ‘সংবাদমাধ্যম থেকে এমন কোন তথ্য জানলে ইউজিসি সিদ্ধান্ত নেবে’ বলে জানান তিনি।