আদর্শ শিক্ষক ও ভারতের রাষ্ট্রপতি
প্রথমত তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। পরে হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। সর্বাবস্থায় তিনি শিক্ষকের ব্যক্তিত্বে ছিলেন উজ্জ্বল। রাষ্ট্র ও রাজনীতির জটিল ও ব্যস্ত জীবনেও তাকে মনে হয়েছে আপাদমস্তক শিক্ষক।
ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরে পালন করা হয় `শিক্ষক দিবস’। শিক্ষক হিসেবে এতটাই প্রখর তার ভাবমূর্তি যে, রাজনীতি নয়, শিক্ষা প্রসঙ্গেই তাকে স্মরণ ও চর্চা করা হয়।
১৯৬২ সালে ছাত্রদের অনুরোধে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হন। তিনি ছিলেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি ও উপদেষ্টা। ভারতবর্ষের সকল বিদ্যার্থীর পক্ষ থেকে তাকে সম্মান জানানোর এমন উদাহরণ সারা বিশ্বে বিরল।
একজন আদর্শ শিক্ষক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ (৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ – ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৫) ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য তামিলনাডুর তিরুট্টানিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ১৩১ বছর পেরিয়েও এই শিক্ষক উপমহাদেশে এখনো আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনীতিতে তার শিক্ষক-রাষ্ট্রনেতার আলোকময় আবেদন আজও প্রাসঙ্গিক।
ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ স্বাধীন ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হন ১৯৫২ সালে। ১০ বছর তিনি এ পদে থেকে ১৯৬২ সালে হন সে দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। এক নাগারে প্রায় পনের বছর তিনি ছিলেন ভারত রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শীর্ষবৃত্তে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সুদীর্ঘ বছর রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অবস্থান করেও তিনি শিক্ষা ও শিক্ষকতা পেশাকে বিস্মৃত হননি। তাকে ঘিরে সবসময় আবর্তিত হয়েছে শিক্ষা বিষয়ক বিষয়াবলী। ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষার কল্যাণ চিন্তাই ছিল তার সার্বক্ষণিক ধ্যান ও সাধনা।
রাজনীতিবিদ হলেও ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণকে বিবেচনা করা হয় দার্শনিক ও অধ্যাপক হিসেবে। অতি শান্ত ও সজ্জন স্বভাবের পাশাপাশি ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন অতি মেধাবী। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি তিনি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তার ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’(The Ethics of the Vedanta and its Metaphysical Presuppositions)।
তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সচ্ছল ছিল না। দূর সম্পর্কের এক দাদার কাছ থেকে দর্শনের বই পান এবং তখনই ঠিক করেন তিনি দর্শন নিয়ে পড়বেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার জন্য তিনি “বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা” বিষয়ে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধও রচনা করেন। তিনি ভেবেছিলেন তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ দর্শনের অধ্যাপক বাতিল করে দেবেন। কিন্তু অধ্যাপক অ্যালফ্রেড জর্জ হগ তার প্রবন্ধ পড়ে খুবই খুশি হন। এই উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধ যখন ছাপানো হয় তখন রাধাকৃষ্ণাণের বয়স মাত্র ২০ বছর।
অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বের দরবারে অতি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক-অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তাকে British knighthood-এ সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪ সালে ভারতরত্ন উপাধি পান তিনি।
প্রথম জীবনে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তা ছিল ১৯১৮ সালের ঘটনা। এ সময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গবেষণা পত্রিকায় লিখতেন। সে সময়েই তিনি ভারতের প্রধানতম সাহিত্যপ্রতিভা রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। তখনই তিনি রচনা করেন তার প্রথম গ্রন্থ ‘The Philosophy of Rabindranath Tagore’। তার দ্বিতীয় গ্রন্থের শিরোনাম ছিল ‘The Reign of Religion in Contemporary Philosophy’, যা প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে।
এক পর্যায়ে ড. রাধাকৃষ্ণাণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। শিক্ষক হিসাবে দেশে ও বিদেশে ছিল তার প্রভূত সম্মান ও মর্যাদা।
জাতীয় প্রয়োজনে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি হন। দল-মত নির্বিশেষে এই পণ্ডিত ও দার্শনিককে ভারতের সকলেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরে বরণ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা তার জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি ব্যক্তিগত উদযাপনকে নিরুৎসাহিত করেন। বরং তিনি বলেন, “জন্মদিনের পরিবর্তে ৫ সেপ্টেম্বর যদি ‘শিক্ষক দিবস’ উদ্যাপিত হয় তবে আমি বিশেষরূপে অনুগ্রহ লাভ করবো।”
ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের মনোভাবকে সম্মান জানিয়ে ভারতে তার জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষক দিবস’ রূপে পালিত হচ্ছে। এই বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদ নিজের জন্মদিনকেও উৎসর্গ করে গেছেন শিক্ষার উন্নয়নে ও শিক্ষক সমাজের কল্যাণে।