সমোটো শহরে হাতকাটা ক্যাপ্টেন



মঈনুস সুলতান
সমোটো শহরের দরিদ্র মহল্লা

সমোটো শহরের দরিদ্র মহল্লা

  • Font increase
  • Font Decrease

বেশ বেলা হয়েছে, তবে নিকারাগুয়ার সমোটো শহর এখনো জেগে ওঠেছে বলে মনে হয় না। নিকারাগুয়ার অন্য একটি মফস্বল শহরে আমি বাস করছি বেশ কিছু দিন হলো। গতকাল এসেছি সমোটোতে। এখানে আছে সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি দৃষ্টিনন্দন একটি পাহাড়। তার রুক্ষ পাষাণ কেটে ‘ককো’ নদীর বয়ে চলাতে প্রকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে অত্যন্ত দৃষ্টি নন্দন একটি ক্যানিয়ন। এর রূপবৈচিত্র অসামান্য, তার টানে ইদানীং সমোটো শহরে টুরিস্ট আসছে বিস্তর। আমি নিকারাগুয়া ছেড়ে যাওয়ার আগে এ ক্যানিয়নে একবার ঘুরে বেড়াতে চাই। আমার সাথে আজ অন্য শহর থেকে এসে যোগ দিচ্ছে দুই নিকারাগুয়ান বান্ধবী ইভা ও গাবরিয়েলা। গাবরিয়েলা তার ছোট মেয়ে মারিয়াকে নিয়ে আসছে। ঘণ্টা দুয়েক পর তারা বাসে করে সমোটোতে আসলে আমরা একসাথে ক্যানিয়নে বেড়াতে যাব।

গতকাল এখানে এসে ‘আসিয়ানদা’ বলে একটি গেস্ট-হাউসে উঠেছি। তো একটু বেলা হতেই আমি বেরিয়ে পড়ি। খানিকটা হেঁটে আসতে হয় শহরে। ক্যানিয়নে যাওয়ার আগে শহরটির খতিয়ান আরো ভালো করে নেওয়া উচিত। তাই বেরিয়ে পড়েছি ভোরবেলা। এদিকের ঘরদুয়ারের হালত দেখে মনে হয় না মানুষজনের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ একটা সুবিধাজনক। সড়কটি পিচঢালা, তাতে একটি-দুটি ভ্যান-জাতীয় গাড়ি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই না। ভ্যানের চালকেরাও এখনো খেপ দিতে সড়কে বেরোয়নি। হাঁটতে হাঁটতে বাড়িঘরের নির্মাণশৈলী ও দেয়ালের রংচঙ চুনকামের পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারি, চলে এসেছি মধ্যবিত্তদের মহল্লায়। এ এলাকাও জনহীন, তবে এখান থেকে পেছন ফিরে মিরাদর বলে খ্যাত পর্বতটিকে সবুজ ধূসরে আবছা দেখা যায়। ওদিকে বেশ ঘন হয়ে কুয়াশা জমেছে।

ফুটপাতের পাশে তোলা উনুনে তৈরি হচ্ছে ভাঁপা পিঠার মতো দেখতে নারকেল, শসা ও মরিচের কুচি দেওয়া তমালে। হাতে সময় আছে, তাই দাঁড়িয়ে পড়ে তমালের অর্ডার করে গতকাল সমোটোতে চলে আসার ব্যাপার নিয়ে গুছিয়ে ভাবি। জনসংখ্যার পরিমাপে সমোটোকে ঠিক শহর বলা চলে না। হাল্কাপাতলা কিছু আবাসিক এলাকা, কয়েকটি কমার্শিয়াল স্থপনা, গোটা কয়েক ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, পেট্রলপাম্প ও বাসস্টপ মিলিয়ে শহরের বিস্তার। আমি কোনো হেটেল বা গেস্টহাউস রিজার্ভ করে এখানে আসেনি। তাই বাস থেকে নেমে ক্যাফেতিন কুয়ো বলে ডিসকোর চনমনে মিউজিক বাজা একটা রেস্তোরাঁতে বসে এক পেয়ালা কফি খাই। দেখা হয় এক ট্যুরগাইড তরুণীর সাথে। তার নাম লুসিয়া। সে পর্যটকদের সমোটো কেনিয়ানে গাইড হিসাবে তার ঘোড়ায় চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যায়। মেয়েটি হাসিখুশি ও খুব সহজে তার সাথে কথাবার্তা বলা যায়।

কফি খাওয়া শেষ হতেই সে বলে—চলো, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি একটি আসিয়ানদায়। আসিয়ানদা হচ্ছে একদম পাড়াগাঁয়ের ভেতর ছোট্ট গেস্ট-হাউস। চালাচ্ছে একটি পরিবার। দামে সস্তা। খুব নিরিবিলি। পছন্দ হবে তোমার। সে আমার ব্যাগ ও রুকস্যাখ তার ঘোড়ার জিনগদির ওপর বেঁধে দিয়ে লাগাম হাতে তুলে নেয়। কথাবার্তা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে আসি অসিয়ানদাতে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/02/1535885286565.jpg
আসিয়ানদার কটেজে ঝুলছে হ্যমোক

ঝোপঝাড়ে নিবিড় আসিয়ানদার প্রাঙ্গণে নদীর দিক থেকে বইছে মৃদুমন্দ সুবাতাস। মাটিতে লেপাপুছা দেয়ালের একটি কটেজ ভাড়া করি। দুটি কামরার বড়টিতে গাবরিয়েলা ও তার মেয়ে মারিয়া আমার অন্য বান্ধবী ইভার সঙ্গে থাকতে পারবে। পাশের কামরাটি ছোট হলেও তাতে আমার চলে যাবে। বারান্দায় জোড়া হ্যামোক বা দড়ির দোলনা ঝোলানো। বারোয়ারি আঙিনার চারপাশে অন্য কটেজগুলো গাছপালায় জড়ানো ঘন লতার ঘেরাটোপে আলাদা করা।

আঙিনায় জলপাই রঙের কমব্যাট কেতার জ্যাকেট পরে ক্রুকাট চুলের এক লোক বেজায় ভারী একটি ক্যামেরা নিয়ে কী যেন ধুন্দুর-মুন্দুর করেন। তাঁর জ্যাকেটের একটি হাতার ভেতরে বাহু বলে কিছু নেই। কানের সংখ্যাও এক। অন্যটির দগদগে ক্ষতময় ছিদ্রের ওপর লাগানো ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে একটি ইয়ারপিস। তিনি মাটিতে আয়না পেতে তাতে মস বা শুকনো শেওলার টুকরা রেখে চিমটা দিয়ে তাজাতনা লাল পিঁপড়া ধরে ছেড়ে দেন তার ওপর। পিঁপড়াটি মসের স্তূপ বেয়ে নেমে আসতে গেলে আয়নাতে তার পরিষ্কার প্রতিফলন হয়। তিনি ভারী ক্যামেরার স্ট্র্যাপ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে এক হাতে লেন্স পাল্টে তার ছবি তোলেন। আমি চিয়ার্স বলে তাঁর কামেরাম্যানশিপের তারিফ করলে তিনি চোখমুখ কুঁচকে কুৎসিতভাবে আমাকে স্বমেহন করার পরামর্শ দেন। আচরণটি শুধু অস্বাভাবিকই না অশোভনও বটে। কিন্তু কেন জানি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে ইচ্ছা হয় না। বিমর্ষ হয়ে আমার কটেজের দিকে ফিরে লতানো পত্রপল্লবে তৈরি কুঞ্জের আড়ালে বেতের চেয়ার টেনে বসলে সারা বাতাবরণ ভরে ওঠে অদেখা কোনো পতঙ্গের শার্প গুঞ্জনে।

আমার চেয়ারের সামনে সিমেন্টে বাঁধানো একটি স্মুদ পরিসর। কয়েকদিন আগে আমার বান্ধবী ইভা আমাকে উপহার দিয়েছে শিশুতোষ একটা লাটিম। তো পকেট থেকে বের করে ওখানে তা ঘোরাই। লাটিমটি একটি নির্দ্দিষ্ট বিন্দু থেকে ঘুরে ঘুরে তৈরি করছে বৃত্তের বাইরে একাধিক বৃহৎ বৃত্ত। তাদের ক্রমশ সম্প্রসারিত রেখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, যে মুহূর্তে প্রথম ইভার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়, তার পর কিভাবে যেন তার যাপিত জীবনের বেশ কিছু অধ্যায় ঘুরে আবার তার উদ্যোগে গাবরিয়েলার সঙ্গে পরিচয়। তার সঙ্গে আমার মিথষ্ক্রিয়া লাটিমের চক্রের মতো বাঁক নিচ্ছে। জলপাই রঙের কমব্যাট জ্যাকেট পরা মানুষটি ক্যামেরা হাতে এসে দাঁড়িয়ে অবলোকন করেন লাটিমের ঘূর্ণমান রেখা। মে আই টেক আ পিকচার?—বলে মোলায়েম করে হেসে পোলাইটভাবে আমার পারমিশন চান। কী বলব, মাথা হেলিয়ে সায় দিতেই তিনি মাইক্রোলেন্সে তুলতে শুরু করেন তার ছবি। চেয়ার টেনে কাছে বসে আইপ্যাডের স্ক্রিনে লাটিমের ব্লারি রেখার ছবি দেখাতে দেখাতে তিনি এমন খোলামেলাভাবে নিজের কথা বলতে শুরু করেন যে আমি খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করি। তাঁর নাম এরোন হুরুম। মার্কিন সেনাবাহিনীতে কিছুদিন আগে তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। যদিও ব্যাটেলফিল্ডে খুইয়েছেন একখানা হাত ও বাঁ কান, তিনি আর্মি কমান্ডের তেমন কিছু জানেন না। কমব্যাট ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি চলমান যুদ্ধের ছবি তুলতেন। আহত হওয়ার পর মিলিটারি তাঁকে জবাব দিয়েছে। পোস্ট ট্রামাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের স্নায়বিক বিপত্তিতে ভুগছেন। মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেতে তাঁর সময় লাগছে। এবং সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে—গেস হোয়াট? বলে আমার অনুমান কী তা জানার জন্য মুখ তুলে তাকালে কোন বিষয়টি তাঁর জীবনে কঠিন মনে হচ্ছে, এ নিয়ে অনুমানপ্রসূত কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এবং একটু আগে তিনি যে মিলিটারি মেজাজের পরিচয় দিয়েছেন, তাই কিছু আন্দাজ করাও নিরাপদ মনে হয় না। সুতরাং নীরব থাকি। তিনি একটু অপেক্ষা করে গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন—এই যে একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গভাবে চলাফেরা করা, দিস ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট, বলে রোদেলা দিনে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কেঁদে ওঠেন।

এ রকমের শক্তসমর্থ যুদ্ধংদেহী লোককে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়, তার কলাকৌশল আমার জানা নেই, আবার কিছু বললে যদি হিতে বিপরীত হয়, তাই খামোশ মেরে থাকি। তিনি নিজেই চোখটোখ মুছে মোলায়েম হেসে বলেন—লাইফ ইজ নট অলওয়েজ ব্যাড অ্যাট অল। মিলিটারি থেকে খালাস পাওয়ার পর হাতে এসেছে অঢেল অবসর ও বেশ কিছু বিত্ত। ঘুরে বেড়াচ্ছি এক দেশ থেকে আরেক দেশে, ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করছি। তো ঘুরে বেড়ানো আপনি এনজয় করছেন ক্যাপ্টেন?—বলে আমি তাকালে তিনি রিলাক্স-ভাবে জবাব দেন—আ ফিউ মোমেন্টস। কোনো কোনো জায়গায় কিছু কিছু মুহূর্ত ভালোই লাগছে। ফর এক্সাম্পল, কিছুদিন আগে পেরুতে গেলাম। লিমার এক উষ্ণ জলের স্পাতে সারা শরীর হাত-পা ঘষে-মেজে দিলো ঝামা পাথর দিয়ে। তারপর ফার্মের লামা, তাদের তুলতুলে লোমে হাত বোলানো, বাচ্চা বাচ্চা লামারা খড়বিচালিতে হামা দিচ্ছে, এ সবের ছবি তোলা। ইনডিড হ্যাড আ ফাইন টাইম ইন পেরু।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/02/1535885165878.jpg
ফুটপাতে ছুটছে চশমা চোখে তরুণী

তমালে তৈরি হয়ে গেছে। কলাপাতায় মোড়া তপ্ত পিঠা হাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি শহরের মূল সরণিতে। গতকাল বিকেলে আসিয়ানদা থেকে বেরিয়ে এসে এখানে ঘোরাঘুরি করছি। দেখি ক্যাফেতিন কুয়া নামের রোস্তোরাঁয় রোয়াকে পাতা টেবিলে বসে ক্যামেরা হাতে ক্যাপ্টেন এরোন। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি ডেকে তাঁর টেবিলে বসতে বলেন। ক্যাফেতিন কুয়োর ওপরের তলায় সরগরম পাব। রোয়াকের আঙিনায় ফুলগাছের ঝোপেঝাড়ে বেশ নিরিবিলি। উড়ছে জোড়া ডানার লাল ফড়িং। তাকে ধাওয়া করে উড়ে আসে ছোট্ট এক নীল পাখি। তারা চক্রাকারে ঘুরপাক খেলে ক্যাপ্টেন ক্যামেরায় তাক করেন। ঠিক তখনই দেখি প্রায় নির্জন সড়ক ধরে ছুটে আসছে চশমা চোখের এক তরুণী। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ভীতি। বিষয় কী দেখতে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। মেয়েটি রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে একটু থতমত করে, তারপর জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে ঢুকে পড়ে ভেতরের কেবিনে। ততক্ষণে ক্যাফেতিনের সামনের ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে ধাওয়া করে নিয়ে আসা ছেলে দুটি। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলছে। সম্ভবত রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকবে কি না, তা নিয়ে ইতস্তত করছে। ক্যাপ্টেন ভারী ক্যামেরাটি টেবিলে রেখে ব্যাকপ্যাক থেকে নোঙরের মতো একটি আংটায় প্যাঁচানো দড়ি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান দোতলায়। মিনিট দু-তিনেকের মধ্যে বিষয়টি বিদ্যুদ্বেগে ঘটে যায়। পাবের বারান্দার পিলার বা রেলিংয়ে তিনি নোঙরের মতো আংটা আটকে এক হাতে দড়িতে ঝুলে ফ্লায়িং কেতায় লম্ফ দিয়ে ছেলে দুটির গর্দানে এ্যায়সা পদাঘাত করেন যে, তারা কুকাৎ-জাতীয় আওয়াজ করে ফুটপাতে ছিটকে পড়ে। সিমেন্টে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একজনের দাঁতফাতও বোধ করি ভেঙেছে। কাপড়চোপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে তারা নজর করে ক্যাপ্টেনকে দেখে। কমব্যাট জ্যাকেট পরা মিলিটারির এই সাবেক সাঙ্গাৎকে চিনতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। কোনো চোটপাট না করেই তারা উল্টাপথে হাঁটা দেয়।

শর্ট গ্লাসে সোডা ছাড়া ব্র্যান্ডির অর্ডার করে ক্যাপ্টেন খুব সংবেদনশীল স্বরে মেয়েটিকে ডেকে এনে টেবিলে বসান। জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে নিতে সে চশমা খুলে তাকালেই তার দৃষ্টিতে ঝাপসা অস্থিরতা থেকে বুঝতে পারি, তার মধ্যে ঘটছে অস্বাভাবিক কিছু। শর্টগ্লাস থেকে খুব ধীরে সে চুমুক দিয়ে ব্র্যান্ডি পান করছে। ক্যাপ্টেনকে দেখে মনে হয় খানিক দ্বিধায় পড়েছেন, ঠিক বুঝতে পারছেন না কী করবেন? আমি তরুণীর দিকে আই কন্টাক্ট করে জানতে চাই, কী সমাচার, কোথা থেকে এসেছো তুমি, কী ঘটেছে? কথা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর তীব্রভাবে কাঁপে। হিস্পানিক আমেরিকান সে, তার ইংরেজিতে এসপানিওল উচ্চারণের প্রভাব আছে প্রচুর। আমেরিকার অখ্যাত শহরের এক স্কুলে সে সায়েন্স টিচার। পর্যটক হিসেবে সমোটো ক্যানিয়ন দেখতে গিয়েছিল। মাঝনদীতে নৌকা চালাতে চালাতে গাইড তাকে কোকেন অফার করলে স্রেফ কৌতূহলবশত সে তা স্মোক করে। দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটি বলে, গাইডের কাছ থেকে কোকেন নেওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ঠিক মনে করতে পারছে না কখন পাথর বেয়ে গাইডের সঙ্গে চলে গেছে গুহার অন্ধকারে। কেইভে কোনো পর্যটক নেই দেখে তার খুব অবাক লাগে। আবছা মনে পড়ে, গাইড তার শরীর স্পর্শ করেছে কিন্তু কোনো ভায়োলেন্স ব্যবহার করেনি। নৌকা বেয়ে ফিরিয়ে এনে তাকে নামিয়েও দিয়েছে পাড়ে। তার শরীরে এখনো ক্রিয়া করছে কোকেনের গাঢ় কুয়াশা। এটা কাটানোর জন্য আমি কাউন্টার থেকে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে তাকে পান করতে বলি। জুস খেতে খেতে সে বলে, শহরে ঢোকার মুখে এ ছেলে দুটি তার পেছনে লেগেছে। ফিসফিস করে বলছিল—হানি, আমাদের কাছে আছে আরো ভালো কোয়ালিটির কোকেন। নিয়ে যাব সবচেয়ে সুন্দর গুহায়। চলো, আমাদের সঙ্গে, খুব সফিসটিকেটেড ইক্যুইপমেন্ট আছে, কোনো কষ্ট হবে না, তোমার শরীরে এঁকে দেব চমৎকার উল্কি। মেয়েটি অরেঞ্জ জুসের পুরা গ্লাস খালি করে ওয়াশ-রুমে যায়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/02/1535885355537.jpg
দূরে ক্যানিয়নের পাথর কাটা নদী

ক্যাপ্টেন আমার দিকে কিছুক্ষণ খুব খেয়াল করে তাকিয়ে তাঁর নোঙরের মতো বস্তু ফ্লোর থেকে তুলে তাতে দড়ি প্যাঁচান। তা দিয়ে টেবিলের পায়ায় মৃদু ঠুকে বিদ্রূপ করে বলেন—সো, ইউ নো হাউ টু মেইক আ প্যারোট টক, টিয়া পাখির মুখে কিভাবে বুলি ফোটাতে হয়, তা তোমার জানা আছে দেখছি। জবাবে বলতে চাই, কোকেনের ঘোরে মেয়েটির মস্তিষ্ক এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন। কতটা বলছে আর আদতে কী ঘটেছে, তার পরিষ্কার পিকচার পাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। আমাকে বক্তব্যের মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর নোঙরের মতো জিনিস রেখে ক্যাপ্টেন বলেন—ইউ আর আ কাওয়ার্ড, অ্যাডমিট ইট স্ট্রেইট। আমি এবার তাঁর চোখে চোখ রাখলে তাঁর এক্সপ্রেশনে পরিষ্কার বুঝতে পারি তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, চরের দখল নিয়েছি আমি, ওখানে ফসল বোনার অধিকার আমার। তিনি নোঙর ঠুকে বিষয়টিতে জোর দিয়ে বলেন—অ্যাডমিট ইট, ইউ আর আ কাওয়ার্ড। আমি দ্রুত হিসাব করি, তিনি ফ্লাইং কিক কষিয়ে একটু আগে যে বিক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, তা হিন্দি সিনেমাতে সুলভ হলেও পর্যটনে এ ধরনের তাকদ প্রদর্শন বিরল। আমি খানিকটা কাপুরুষও বটে, আর কোথাও গল্পের সন্ধান পেলে হুঁশও ঠিক থাকে না। তদুপরি আমি কুংফুতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নই, সুতরাং, এক-হাতা সৈনিকের সঙ্গে হাতাহাতিতেও সফল হাওয়ার সম্ভাবনা জিরো। তাই তাঁকে গুডবাই বলে উঠে পড়ি। তিনি কুৎসিতভাবে পেছন থেকে বলেন—গো অ্যান্ড মাস্টারবেট ইয়োরসেল্ফ, স্বমেহন করগে, যাও।

আজ ভোরবেলা আসিয়ানদা থেকে বেরোবার পথে দেখি, যে কটেজে ক্যাপ্টেন এরোন আছেন, তার বারান্দায় হ্যামোকে শুয়ে ঝিমাচ্ছে কোকেন নেওয়া শিক্ষয়িত্রী তরুণীটি। হয়তো সে তার নিজের হোটেলে একা ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন তাকে আসিয়ানদায় নিয়ে এসে শেল্টার দিয়েছেন। পুরা ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় না। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে চাই না, আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেড়াতে আসা মাস্টারনি গোছের হিস্পানিক মেয়েটির আসলে কী হয়েছে, সবকিছু জেনে আমার হবেই বা কি? এ মুহূর্তে আমার অতিথিদের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। ইভা গাবরিয়েলাকে নিয়ে সমোটোতে আসছে, সঙ্গে আছে গাবরিয়েলার বছর চারেকের মেয়ে মারিয়া। তাদের জন্য সমস্ত কিছুর অ্যারেঞ্জমেন্ট খতিয়ে দেখতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে আমি ক্যাফেতিন কুয়ো রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটি।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;