প্রতিবন্ধী
আমরা “প্রতিবন্ধী” শব্দটা খুব সুস্থভাবে ব্যবহার করতে সর্বজনীনভাবে এখনো শিখি নি। যদি কেবল আক্ষরিক অর্থে না ভেবে ভাব নিয়ে ভাবি আসলে তো প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুঝতে না পারা সব মানুষই প্রতিবন্ধী, মানসিক বা শারীরীক সে যাই হোক প্রতিবন্ধকতাকে মুক্ত করার দ্বিমাত্রিক উপায়কে অস্বীকার করা যায় কি! আসলে আমরা মস্তিষ্কপ্রধান জীব। কিভাবে জীবনের সঙ্গে যুঝছি তা একটি বড় বিষয়। জর্জ লুইস বোর্হেস তার দেখতে না পারার প্রতিবন্ধকতাকে নস্যাৎ করে টাইমসের এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন “I CAN’T WRITE. AND THAT’S WHY I HAVE FALLEN BACK ON CLASSIC FORMS OF VERSE. I FIND THAT SONNETS FOR EXAMPLE ARE VERY PORTABLE. YOU CAN WALK ALL OVER A CITY AND CARRY A SONNET INSIDE YOUR HEAD, WHILE YOU CAN HANDLY DO THAT WITH FREE VERSE”.
মনোবিদরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বলেছেন যেমন, কেউ জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী, কেউ জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এসে প্রতিবন্ধী হলেও সামাজিকভাবে সে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া—কোন অংশে বসবাস করছে তা খুব গুরুত্বের! আসলে শরীর মনের চূড়ান্ত পরিপূরক; বলা হয় নিয়মিত শরীরচর্চা করলে মনের হতাশা, নেতিবাচক মনোভাব দূর হয়। অর্থাৎ শারীরিক প্রভাব মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক সেইরকম মনের পূর্ণ পরিপোষক থাকলে শরীরের প্রতিবন্ধক্তাকেও নগণ্য বোধ করানো যায়। এখন বিষয় হলো জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো কিছু মাত্রায় হলেও অভ্যাসের কারণে স্থিতি পেতেও পারে কিন্তু জীবনের মধ্য বিপর্যয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের আঘাতটা বেশি এসে পড়ে কারণ দুটো পার্থক্যের জীবন তার সামনে খোলা থাকে। ফলে যে সামাজিক জায়গায় সে বসবাস করে সেখান থেকে সে কতখানি অনুপ্রেরণা পায় তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৫৮ সালে বেলজিয়ামে এক খনির দুর্ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজারের ওপর মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে যান। এরপর জুরিখের এক সম্মিলিত সংগঠনের উদ্যোগে ৩ ডিসেম্বরকে বিশ্বের প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যক্তি যখন সাধারণ সমাজের মাঝখানে স্পেশাল হয়ে যায় তখন তাকে আমরা স্পেশাল হিসেবে ইতিবাচক না নেতিবাচক গুরুত্ব দিই সেটা ভাবার কারণ তা থেকেই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে ওঠে এবং তাদের শারীরিক পরিস্থিতির উন্নয়ন বা অবনমন নির্ভর করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী কিছু হলেও কাজের দায়িত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজন। কারণ কাজ ব্যক্তির আত্মস্থিতিকে মূল্য দেয়, ব্যক্তি তার নিজস্বতাকে বুঝতে শেখে। প্রতিবন্ধী বলে তাকে কাজ না দেওয়াও সামাজিক বা পরিস্থিতির ত্রুটি। তাকে বিশেষ অনুভব করাতে গিয়ে তাকে একাকিত্বের মধ্যে ঢুকিয়ে না দেওয়া, কারণ তার অবস্থাগত ত্রুটি শারীরিক হওয়ায় মন তার একমাত্র পথ, সেই মন যদি ভারাক্রান্ত হয় তখন কিছুতেই সে প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে পারে না। এমনই সেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শারীরিক অক্ষমতার কারণে জীবনের বহু কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকসময় দেখেছি, সুস্থ মানুষ মানে শারীরিকভাবে তারা প্রতিবন্ধীকে এত তীব্র দৃষ্টি বা ভাব প্রদান করে দেখেন যে অদ্ভুত কিছু দেখছেন, এখানে দৃষ্টিদানকারী ব্যক্তি হয়তো নতুন আবিষ্কারের আশায় মাতাল কিন্তু যাকে দেখছেন সেই ব্যক্তিটি বুঝতে পারলেই তার ভয়াবহ মানসিক অবনমন হয় কারণ সে এমনিতেই নিজের অবস্থা সম্পর্কে অতিসচেতন থাকে।
আসলে প্রতিবন্ধকতাকে যেখান থেকে সবচেয়ে বড় ছাড়পত্র দেওয়া হয় তা হলো মন। তাই এই মন বা ইচ্ছাশক্তির যদি সেই অতিক্রমের ক্ষমতা থাকে তবে প্রতিবন্ধী শব্দ বলে আমরা নিজেদেরকেই হাস্যকর করে তুলি। যাদের প্রতিবন্ধকতাকে শুনলে মনে হয় সত্যি কি এরকম ছিল কারণ তাদের জীবন এমন মহাসেতুর জয়গান গেয়েছেন যে আমরা হতবাক হয়ে আছি, এখন তাদের কথায় আসি : মহাকবি রুদাকী, হোমার, হেলেন কিলার, জন মিল্টন এবং সদ্য প্রয়াত বিজ্ঞানী জন হকিন্স থেকে শুরু করে আরো কত কত বোদ্ধা ব্যক্তিত্ব এই প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধকতার টানাপোড়েনের মাঝখানে ইচ্ছেশক্তির প্রমাণ দিয়েছেন।
হেলেন কেলারের কথায় আসি, ১৮৮০ সালে তাঁর জন্ম হয়, জন্মের ১৯ মাস বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান, বধির হয়ে যান। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে বি এ পাশ করেন তিনি। জীবনে একটা সময়ে বিশেষ শিক্ষক সুলিভানের সাহচর্য পেয়েছিলেন কিন্তু চূড়ান্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে আউট অফ দার্ক, মাই রিলিজিনের মতো লেখা উপহার দিয়ে গেছেন। ফার্সি সাহিত্যের জনক কবি রুদাকীকে মিথ ইতিহাসের মতো মানা হয়। জন্মান্ধ এই কবি গানও গাইতেন অসাধারণ। অক্টাভিয়া ই বাটলার সায়ন্স ফিকশনে তাঁকে সর্বকালের লেখক মানা হয়; সারাজীবন ডিস্লেক্সিয়ার সঙ্গে লড়েছেন আর লিখেছেন। ক্রিস্টি ব্রাউন—এই আইরিশ লেখক তাঁর বাঁ পায়ের পাতা দিয়ে লিখতেন কারণ তাঁকে সেরিব্রাল পালসির সঙ্গে লড়তে হয়েছিল। সেই স্মৃতি নিয়ে তার বিখ্যাত লেখনী প্রকাশিত হয়—“MY LEFT FOOT”—যা নিয়ে ফিল্ম হয়। দ্য ডাইভিং বেল এবং বাটারফ্লাই—এ দুটি বিখ্যাত ফিল্মের কাহিনী রচনা করেছিলেন ফ্রেঞ্চ লেখক ববি। তিনি ‘এলে’ ম্যাগাজিনের সম্পাদকও ছিলেন, একটি ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর তাঁর কেবল চোখের পাতা নাড়াবার ক্ষমতা ছিল। তবুও তিনি লড়াই ছাড়েননি, এর মধ্যেও তিনি এদুটি অপূর্ব লেখা লিখেছিলেন।
আমাদের সকলের প্রিয় দস্তয়ভস্কি—যাঁর অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি অথচ এরকম লেখক যিনি বোধহয় বিচারের জায়গাতেই আসেন না। জন মিল্টন, যাঁর কথা না বললে বোধ করি লেখাই অসম্পূর্ণ, এই অন্ধ কবি তাঁর জীবনে কী লিখে গেছেন তা নিয়ে আলোচনা করাই বোধহয় আয়ত্তের বাইরে! তিনি তার জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর সনেট “ON HIS BLINDNESS”-এ লিখে গেছেন।
পৃথিবীর জৈবিক যে কোনো প্রতিবন্ধকতাকে ইচ্ছাশক্তি হারাতে না পারলেও অনেকসময় তীব্রভাবে যুঝতে পারে। এই বিশ্বাসের প্রভাবকে নষ্ট করাই হয়তো প্রতিবন্ধকতা।