অদৃশ্য মানচিত্র

  • মূল: মাজা মেনজিস্ট, অনুবাদ: ফজল হাসান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী

প্রতীকী

অদৃশ্য মানচিত্র
মূল: মাজা মেনজিস্ট
অনুবাদ: ফজল হাসান

দিন
লিবিয়ার চোরাচালানিরা কারাগারের সংকীর্ণ যে কক্ষটি অফিস হিসাবে ব্যবহার করে, টাইজিস্ট সেখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কক্ষটি কংক্রিটের তৈরি এবং সেখানে শুধু একটা টেবিল এবং দু’টি চেয়ার আছে। সাহারা মরুভূমির মাঝে একটা বিশাল কারাগারে সে আটকে আছে। কারাগারের চতুর্দিকে অস্ত্রবাহী লোকজন পাহারা দিচ্ছে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় তারা যেন শিকারি।

বিজ্ঞাপন

‘ফোন করো’, টাইজিস্টের মুখের সামনে সেলফোন নাড়তে নাড়তে একজন বলল, ‘বলে দাও, তুমি এখন কুফরাতে আছো এবং তারা যখনই তারবার্তায় টাকা পাঠাবে, তখনই আমরা তোমাকে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাব এবং সেখান থেকে ইতালির জাহাজে তুলে দেব।’ লোকটি চাচ্ছে টাইজিস্ট যেন তার বাবা-মাকে ফোন করে মুক্তিপণ দেওয়ার কথা বলে। তার বাবা-মা বছরে যা আয়-রোজগার করেন, মুক্তিপণের অংক তার দ্বিগুণ পরিমাণে।

মানচিত্রের উপর কুফরার দিকে টাইজিস্ট বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এবং মানচিত্রের অস্পষ্ট সীমারেখা ভালো করে দেখার জন্য মাথা ঝাকায়। কতক্ষণ ধরে সে এই জায়গায় আছে? সে মনে করতে পারে না কখন সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার নেমে আসে। মনে হয় দীর্ঘ ঘণ্টা যেন একাকীত্বের নিজস্ব কক্ষপথে রূপান্তরিত হয়েছে। শুধু মরুভূমির ঊষর বুকে তেজদীপ্ত সূর্যের ওঠা-নামা দেখে একটা সীমাহীন ঘূর্ণন যাত্রার ছবি ঠাহর করা যায়।

বিজ্ঞাপন

টাইজিস্ট বুঝতে পারছে না, সে কেমন করে বাবা-মার কাছে মুক্তিপণের টাকা চাইবে। কেননা সে আসার সময় তাদের বিদায় জানায়নি। তখন বেকার জীবনের অসহায়ত্বের কথা বলার ভয় ছিল, কঠোর পরিশ্রম করা ও কোথাও না যাওয়া, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি কিছু করার এবং আরো অনেক কিছু চাওয়ার অনুতাপ প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তার চেয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলাটা সহজ ছিল, ‘কোথাও পৌঁছে আমি তাদের টেলিফোন করবো, যেন তারা বুঝতে পারেন।’

‘এক্ষুনি করো’, ধমকের সুরে চোরাচালানি বললো।
টাইজিস্ট আদ্দিস আবাবায় তার বাবা-মাকে ফোন করে। রিং হতে থাকে। টাইজিস্টের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবা বিকলাঙ্গ পা নিয়ে তার প্রিয় চেয়ারে বসে আছেন, খবরের কাগজ পড়ায় মশগুল এবং চোখেমুখে অসন্তোষের চিহ্ন ফুটিয়ে বিড়বিড় করছেন। রান্নাঘরে তার মা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গুনগুন করছেন এবং কফির দানা ভাজছেন। বসার ঘরে পর্দা খোলা যায়। টাইজিস্টের বিগত ঊনত্রিশ বছরের জীবনে প্রতিদিন ঘরের ভিতর উজ্জ্বল মেজেন্টা রঙ বিবর্ণ হয়ে নিস্তেজ গোলাপি রঙের ফুলতোলা সোফার কোণায় যে জায়গায় সূর্যের নরম রোদ এসে পড়তো, সেই একই জায়গায় এসে রোদ পড়েছে। হয়তো তার মা অপরিসর রান্নাঘর থেকে তাকিয়ে আছেন, মুখমণ্ডল থেকে গন্ধযুক্ত ধোঁয়া মুছছেন এবং বলছেন, যা তিনি রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সচারচর বলে থাকেন: ‘কবে আমাদের নতুন সোফা হবে?’ এবং তার বাবা, যিনি সবসময় মিতব্যয়ী, মাথা নেড়ে বলবেন, ‘ফিকির, আদরের বউ, এগুলো এখনো ভালো আছে।’ হয়তো কুয়াশাচ্ছন্ন দূরে কোথাও কোনো এক সন্নাসীর সুরেলা কণ্ঠস্বর জনস্রোতের একটানা উঁচু শব্দকে আলতো করে ঠেলে এগিয়ে যাবে এবং সরু সুতার মতো প্রার্থনার সুর তাদের বাড়িতে প্রবেশ করবে। তার মা ‘ক্রশ’ চিহ্ন আঁকবেন এবং বাবা-মা দু’জনেই মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাবেন। অথবা তার অনুপস্থিতে হয়তো দৈনন্দিন কাজের ধারা বদলে গেছে এবং মা-বাবা তার সুস্থতার জন্য কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করছেন, হয়তো টেলিফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে একে অপরের বাহুবন্ধন থেকে আচমকা ঝাঁকি দিয়ে নড়েচড়ে উঠেছেন। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নেওয়ার আগে তার বাবা তিনবার রিং-এর জন্য অপেক্ষা করেন।

টাইজিস্ট কারাগারের কক্ষে বন্দি আছে, যা আয়তনে চোরাচালানিদের অফিস কক্ষের সমান। এই কক্ষটিতে রয়েছে পঁয়তাল্লিশজন বিধ্বস্ত মহিলা, ছয়টি শিশু এবং একটা ভাঙা শৌচাগার। টাইজিস্ট টেলিফোনের কর্কশ আওয়াজ হজম করার চেষ্টা করে। বাবা-মায়ের কথা সে সামান্য মনে করতে পারে। তার শুধু মনে পড়ে বাবার অনিমেষ অসহায়তার কথা এবং মায়ের চাপা কান্নার সুর। সে জিজ্ঞাসা করেনি কোথা থেকে তারা টাকা সংগ্রহ করবে, কিন্তু মনে মনে এরকম কল্পনা করেছে: ‘তার বাবা একজন খুঁতখুঁতে পুরকৌশলী, সবচেয়ে ভালো স্যুট পড়েন, পায়ে থাকে চকচকে জুতা কিন্তু পেট্রোল বাঁচানোর জন্য হেঁটে যান, বাড়তি অথবা অন্য প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য চীনা বসকে অনুনয়-বিনয় করে অনুরোধ করেন। ‘আমি ছুটি না নিয়ে প্রজেক্টে প্রতিদিন কাজ করবো,’ তিনি হয়তো বলবেন। তার মা প্রত্যেক প্রতিবেশীর ঘরের দরজায় টোকা দিবেন এবং লিবিয়ার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবেন, ‘মন যা চায়, তা-ই দিতে পারেন। যা করতে বলবেন, আমি তা করে ঋণ পরিশোধ করবো।’ তার বাবা ব্যাঙ্কে যাবেন এবং জমানো সব টাকাকড়ি তুলে আনবেন । দু’জনেই ঘরে ফিরবেন এবং যৎসামান্য টাকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন। তারা টাকা সংগ্রহ করার জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করবেন এবং টাইজিস্ট জানে, তারা তা পারবেন না।

যা হোক, যাত্রা সহজ হতে পারতো। কয়েকটি বিন্দুকে সংযোগ করে তাকে এবং তার বান্ধবী হেলিনাকে লোকগুলো পথ দেখিয়ে ইথিওপিয়া থেকে সুদান এবং তারপর লিবিয়া নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তারা দু’জন সুদানি পুলিশের হাতে বন্দি হয়। খার্তুমের এক বাড়ি থেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তাদের পাকড়াও করে। চোরাচালানিদের সঙ্গে পুলিশের টাকা-পয়সার লেনদেন হয়। তারপর তাদের জোরপূর্বক অন্যান্য বেপরোয়া পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের সঙ্গে সংকীর্ণ লৌহ নির্মিত কন্টেইনারের মধ্যে তোলা হয়। এসব লোকজন পানি এবং আলো-বাতাসের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করেছিল। সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে ট্রাক এদিক-ওদিক দুলতে দুলতে যাচ্ছিল। একসময় ট্রাক থামে। ট্রাকের ভেতর যারা বেঁচেছিল তারা প্রথমে মৃতদেহগুলিকে নিচে নামায়। ‘এখানে বসে থাক’, হেলিনা বললো। একসময় একজন বলেছিল, ‘সুন্দর জীবনের পথ আমি জানি।’ অথচ সে এখন সুর পাল্টিয়ে বলে, ‘ভালো কিছুর চিন্তা করো এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো।’ সে হেলিনাকে দূরে সরাতে চায়, কিন্তু বুঝতে পারে যে, আগের দিন হেলিনাও একই কারণে ফোন করেছিল। সে-ও অপেক্ষা করছে। টাইজিস্ট রীতিমতো লজ্জিত।

একসময় টাইজিস্ট হেলিনার হাত চেপে ধরে। সাধারণত এই প্রকাশ ভঙ্গি তাকে মনে করিয়ে দেয় তাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমাবর্তন দিনের কথা। সেই অনুষ্ঠানে তাদের থেকে এক সারি সামনে বসেছিল লাজুক হাসি মুখের একটি ছেলে। টাইজিস্ট নিজের টুপি এবং গাউনের জন্য অত্যন্ত গর্বিত ছিল। তার কাছে মনে হয়েছে গাউনের কারুকাজ যেন সবচেয়ে উজ্জ্বল দিনের স্বচ্ছ আকাশের মতো। সেদিন ছেলেগুলির পুরুষ হয়ে যাওয়ায় তার কোনো ভয় ছিল না। সেই সময় সে বলতে পারতো, ‘না’। তারা শুধু স্মিত হেসে হাত ধরে কালদি ক্যাফেতে কফি খাওয়ার জন্য যেতে বলেছিল, অথবা কোনো ক্লাবে গিয়ে নাচতে আহ্বান করেছিল, কিংবা মেসকেল স্কয়্যারে গিয়ে বিশাল পর্দায় ফুটবল খেলা দেখতে বলেছিল।

কিন্তু তখন তা ছিল না এবং এটা ইথিওপিয়াও নয়। সে এমন এক জায়গায় আছে যেখানে স্বাভাবিকতা হচ্ছে অপরিচিত কোনো পুরুষকে দেখে বলা যায়, ‘হ্যাঁ, সে আমার স্বামী’ এবং আশা করা যেতে পারে যে, অন্য মহিলাদের কাছে যেই ধরনের ঘটনা ঘটে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। সে এমন এক জায়গায় আছে যেখানে নারীদের ধীরে ধীরে আলাদা করা হয়। একসময় তারা ময়লা ও নোংরা হয়ে যায় এবং নিজেদের অন্ধকারের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী চামড়ার আড়ালে গুটিয়ে নেয়। সে এমন এক জায়গায় আছে, যে জায়গার নাম লিবিয়া। পাহারাদার বলেছে, লিবিয়া হলো লিবিয়াবাসীদের জন্য, তার মতো কৃষ্ণ সারমেয়দের জন্য নয়। কয়েকজন প্রহরী বলেছে যে, বন্দিরা ইহুদি। যদিও তারা তাদের ‘ক্রশ’ চিহ্ন দেখিয়েছে এবং অনেকে স্বীকারোক্তি করেছে: তোমাদের মতো আমরা মুসলমান। কিন্তু পাহারাদার জোর গলায় বলেছে যে, তোমরা সবাই ইহুদি গুপ্তচর এবং তোমরা কালো চামড়া ও ‘ক্রশ’ চিহ্নের ছদ্মবেশে এখানে এসেছ। মাঝে মাঝে টাইজিস্ট জানে না বিনয়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে, বিশেষ করে তার পিতা-মাতা যাদের একমাত্র অপরাধ তারা তাকে জন্ম দিয়েছে, অর্থকড়ি আদায় করার অজুহাত।

রাত
অপেক্ষা করার ফাঁকে টাইজিস্ট বাবা-মাকে চিঠি লেখে। তার কাছে যখন কাগজ ও কলম কেনার টাকাপয়সা থাকে, তখন সে সময়কে বাস্তব শব্দে লিপিবদ্ধ করে চিঠি লেখে। লেখার সময় সে আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যায় এবং প্রতিটি লেখা হৃদয় থেকে শুরু করে। এমামা, সেইন্ট গাব্রিয়েল গির্জার, যেখানে একসময় জিদ এবং একগুঁয়েমি একসঙ্গে মিশে থাকতো, পাশে বস্তির কথা কী তোমার মনে আছে? প্রত্যেক বড়দিনের সময় তুমি যে ধূপবাতি জ্বালাতে, তার সুঘ্রাণ কি তোমার মনে পড়ে? আবাবা, আমার ইচ্ছে হয়, পুনরায় তোমার সঙ্গে মিলে আবাবায় আমাদের বাড়ির চালে বৃষ্টির ফোঁটা গুণি। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সকালবেলায় ছোটখাটো ঘটনার জন্য মন খারাপের ধূসর সময়, সারাদিনের গেরস্থালির নীরস কাজ, কাজের পথে যাওয়া শ্রমিকদের ধূলি-ধূসরিত রাস্তায় ভিড় – সেই ভিড়ের মাঝে একজন তার সুদর্শন ও গৌরবান্বিত বাবা। তার ইচ্ছে হয় সে এনটোটো পাহাড় থেকে নিচের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এদিক-ওদিকে খনন করা জমিন দেখে এবং সদ্যনির্মিত বাড়িগুলোর একটিতে বাস করার স্বপ্ন বোনে মনের ভেতর। বিশাল কোকাকোলা বোতল আকৃতির কিয়স্কে সাজানো সেলফ থেকে ক্যান্ডি কিনতে চায়। এছাড়া সে বাসে যাত্রী ওঠানোর জন্য ছেলেদের লাগাতার ডাকাডাকির অনুপস্থিতি দারুণভাবে অনুভব করে। সে বন্দি জীবনের বিস্তারিত বিবরণ মনে রেখেছে, যেমন মানুষের মলের দুর্গন্ধ ছাড়া কারাগারের মধ্যে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। তার মনে আছে মানুষের মাংসের মতো পুরো ও ভরাট বিরাজমান একধরনের আতঙ্ক এবং প্রায় প্রতিদিন ট্রাক ভর্তি নতুন বন্দির আগমন ও পুরনো অনেক বন্দির গায়েব হওয়ার ঘটনা। তার কাছে মনে হয় মানুষের যাওয়া-আসার জন্য এই জায়গাটিতে ঘূর্ণায়মান কোনো দরজা আছে। সত্যিকার অর্থে সে মনে করে যে, তাদের প্রকোষ্ঠের দরজা প্রায়ই খোলা হয়। তখন উপুড় হয়ে থাকা মহিলাদের গায়ের উপর বাইরের একঝলক আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পরবর্তী সম্ভাব্য ঘটনার কথা সে পরোক্ষভাবে বলতে পারে। সে বলে, ঘুমানোর আগে মহিলারা প্রায়ই প্রার্থনা করে। সে আরো বলে, মহিলারা একে অন্যের দেখভাল করে এবং নির্দিষ্ট দিনে এক বা দু’জনের চারপাশে সবাই জড়ো হয়। তখন তারা একে অন্যের মা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এমামার অনুপস্থিতিতে সে বলে, অনেক মহিলাই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। চিঠির শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিগগিরই দেখা হওয়ার কথা এবং ঋণ পরিশোধ করার জন্য টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে লেখা সমাপ্ত করে।

দিন
যদিও টাইজিস্ট কারাগারে বন্দিনী এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকাপয়সা আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তবুও এসব কথা বলার কারণ সে জানে না। কিন্তু সে বলে, ‘হেলিনা, আমি বাড়ি যাবো। আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই।’

টাইজিস্ট ভাবে, সে সাহারা মরুভূমির মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ করা যাত্রার জন্য ঝুঁকি নিতে পারবে। সে জানে, সেই যাত্রা পথে রয়েছে চোরাচালানিদের তৎপরতা এবং এলোপাথারি হত্যাকাণ্ড। লৌহ নির্মিত তপ্ত কন্টেইনারের মধ্যে সে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে, এমনকি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনে নিজের মুখের লালা গিলতে কোনো দ্বিধা করবে না। বাড়ি ফিরে দু’হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরা এবং মাকে আদর করার জন্য এসব কাজ সে অনায়াসে করতে পারবে। এছাড়া তার ইচ্ছে সে কমলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কচি সবুজ পাতা স্পর্শ করবে এবং সকালের শিশির ভেজা হলুদ রঙের ডেইজি ফুল তুলবে। তাই সে পুনরায় চোরাচালানিদের মানচিত্র দেখতে চায় এবং তার দেশে ফিরে যাওয়ার প্রতিটি রাস্তা, যা শরীরের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে, মুখস্ত করতে চায়।

‘টাইজিস্ট, সম্মুখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই’, বলেই হেলিনা তার বুড়ি মায়ের মতো, যার নামে তার নাম রাখা হয়েছে, প্রচণ্ড ঝাকুনির সঙ্গে মাথা দোলায়। তারপর সে আরো বলে, ‘অতিক্রম করার পরপরই সব পথ অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে পথের মাঝে যারা মারা গেছে, তাদের হাঁড় ছাড়া এমন কিছু নেই যা চিহ্নিত করে রাখা যায়। এটা একটা অদৃশ্য মানচিত্র। যা হোক, টাকাকড়ি না আসা পর্যন্ত আমাদের শক্ত থাকতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমরা প্রার্থনা করবো।’

টাইজিস্ট হেলিনাকে ভালো করেই চেনে। হেলিনা যখন বলে, ‘সম্মুখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই,’ আসলে সে বলতে চায়, ‘আমরা আটকে আছি।’

রাত
টাইজিস্ট স্বপ্ন দেখে। সে টেলিফোনের শব্দ শুনতে পায় এবং তার বাবা ফোন করেছে। বাবা হ্যালো বলেননি, বরং তার পরিবর্তে তিনি টাইজিস্টকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘বাড়িতে তোর জন্য ঘর খালি আছে। তুই কি ওখানে গাদাগাদি করে আছিস না?’ অন্য সময় তার মা হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই তো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না। আরো দু’মুঠো ভাত চেয়ে নিস।’ অন্য একসময় ক্লাসের শান্ত ছেলেটি একবার তার উরুর দিকে এক পলক দৃষ্টি ফেলে বলেছিল, ‘তুমি আর নতুন নও’। কখনও সে সকাল হওয়ার একটু আগে ঘুম থেকে জেগে যায় এবং জবুথবু হয়ে শুয়ে থাকা অন্য মহিলাদের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনে। সে সূর্য কল্পনা করে। মেঘহীন আকাশের গায়ে সূর্য যেন তার নিজের আলোক রশ্মির তীব্রতায় জ্বলছে। সে স্বপ্ন দেখে হেলিনা হাঁড় দিয়ে তার জন্য একটা মই বানিয়েছে। সেই মই বেয়ে সে সূর্যের বাড়ি পৌঁছে গেছে এবং সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, ‘ইথিওপিয়ায় ঠিক সকাল ছ’টায় তুমি প্রতিবার উদয় হও। কিন্তু লিবিয়ায় মাঝরাতের অন্ধকার খানাখন্দের মধ্যে একটা নতুন দিনের সূচনা করো। আমার পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তুমি কি বলো?’

দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, দিনের পরে রাত, রাতের পরে...
তারপর একদিন ঘটনা ঘটে। আলোর ঝলক টইজিস্টকে খুঁজে পায়। সে জানে, এই সেই অপেক্ষার রাত, যে রাতে তার পালা। সে চোখের পাতা বন্ধ করে এবং হেলিনার হাত চেপে ধরে। কিন্তু হেলিনা তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। ‘উঠে দাঁড়াও, টাইজিস্ট’, হেলিনা বললো, ‘উঠে পড়ো। যাও। তুমি কী বুঝতে পারছো না?’

এবার লিবিয়ার চোরাচালানি এসেছে, পাহারাদার কেউ আসেনি। ‘জলদি করো’, চোরাচালানি লোকটি তাড়া দিয়ে বললো।

হেলিনাকে তুলে টাইজিস্ট দরজা পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং দু’জনে একই সঙ্গে সজোরে ঝাড়া দিয়ে চোরাচালানির হাত সরিয়ে দেয়। তখন মনে হয় যেন উভয়ের ধুকপুকানির হৃদয় একটাই। তারা যদি কথা বলার জন্য কোনো কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়, তাহলে দু’জনেই চোরাচালানি লোকটিকে বলবে, ‘আমরা শপথ করেছি, কখনও কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। আমার হাত হেলিনার হাতকে শক্ত করে ধরে রাখে। সে যেন ঘুমিয়ে যায়, সেজন্য আমি গুনগুন সুরে গান করি। ত্রিপোলিতে পৌঁছে ইউরোপে যাওয়ার জন্য কোনো বাহন না পাওয়া পর্যন্ত আমরা একজন অন্যজনকে সহযোগিতা করবো। শুধু তাই নয়। ইউরোপে পৌঁছে আমরা যতদিন পর্যন্ত আমাদের ঋণ পরিশোধ করতে না পারি, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা প্রেমে পড়ি এবং বিয়েশাদি করে থিতু হই, এমনকি যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা মন খুলে গান গাইতে না পারি, ততদিন আমরা এক হয়ে থাকবো। হেলিনাকে আমি একা রেখে যেতে পারি না। হ্যাঁ, সত্যি, আমি তা পারি না।’ চোরাচালানি লোকটি ধাক্কা দিয়ে হেলিনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে টাইজিস্টকে টেনে সামনে আনে। তখন টাইজিস্ট নিজের ভেতর শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারে না।

পরবর্তীতে লোহার কন্টেইনারের দু’টি দরজা ভীষণ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কন্টেইনারের ভেতর অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। কন্টেইনার লোকজনে ঠাসা এবং তারা বিলাপ করছে। ট্রাকের ঘড়ঘড় আওয়াজ, পানির জন্য নারী-পুরুষ ও শিশুদের চিৎকার-চেঁচামেচি, ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার জন্য বিনয়ী কন্ঠস্বর – সবকিছু ছাপিয়ে টাইজিস্ট শুধু দুর্বল বাতাসে ভাসমান একজনের নামই শুনতে পায় এবং সেই নাম তার বান্ধবী এবং বোনের, যে কিনা অতিসত্ত্বর স্মৃতি হয়ে যাবে।

২৮ জুন ২০১৬
টাইজিস্ট প্রতিটি চিঠি একইভাবে আরম্ভ করে:
সমুদ্র হলো একধরনের নীল, যা তুমি জীবনে কখনই দেখনি, হেলিনা। আমি রোমে আছি। তুমি কোথায়? কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যারা এসেছে, তারা সবাই বলেছে তুমি সেখানে নেই। বোন আমার, এমন একটা দেশে, যেখানে চারপাশের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তোমাকে একা ফেলে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। এখানে আমার একাংশ বাস করে। অদৃশ্য মানচিত্রের যেখানে তুমি আছো, সেখানে আমার বাকিটুকু রয়ে গেছে এবং বাদবাকি হাঁড় সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দেওয়ার কাজে সেখানে ব্যস্ত আছে। তোমার কণ্ঠস্বর আমি রাতের আঁধারে শুনতে পাই। তুমি বলেছো, আমি যেন চিৎকার-চেঁচামেচি না করি। কিন্তু নিস্তব্ধতার মাঝে আমার কাছে এসে লিবিয়া হাজির হয়। হয়তো কোলাহলই মানুষ হিসাবে আমাদের চিহ্নিত করে। হয়তো তার জন্যই আমরা কাঁদি। আমি তোমাকে খুঁজবো, খুঁজতে থাকবো। কখনই হাল ছেড়ে দেব না।

লেখক পরিচিতি:
ইথিওপিয়ার সমকালীন কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখক ও লেখিকাদের মধ্যে মাজা মেনজিস্ট অন্যতম। তার জন্ম আদ্দিস আবাবায়, ১৯৭৪ সালে। মাত্র চার বছর বয়সে বিপ্লবের ভয়ে সপরিবারে নাইজেরিয়ায় অভিবাসী হন। তার শৈশব কাটে নাইজরিয়া, কেনিয়া এবং আমেরিকায়। তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ইতালিতে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ মাস্টার্স অব ফাইন আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। তার লেখা ফিকশন এবং নন-ফিকশন বিখ্যাত পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে, যেমন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’, ‘গ্রান্টা’, ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘এনকারে রিভিউ’-এ নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

এছাড়া মাজা মেনজিস্টের ছোটগল্প ‘দ্য গ্রান্টা অ্যান্থোলজি অব দ্য আফ্রিকান শর্ট স্টোরিজ’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং বিবিসি রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। তার লেখালেখির মূল বিষয় যুদ্ধ-সংঘাত, বিপ্লব, অভিবাসন এবং ফটোগ্রাফির সঙ্গে হিংস্রতার সম্পর্ক। প্রথম উপন্যাস “বিনিথ দ্য লায়ন’স গেইজ” ২০১০ সালে প্রকাশের পরপরই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এই উপন্যাসে তিনি ইথিওপিয়ার বিপ্লবের সময় একটি পরিবারের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামী জীবনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেন। উপন্যাসটি লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা সমকালীন আফ্রিকার দশটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হিসাবে নির্বাচিত করেছে। এছাড়া উপন্যাসটি ‘ফ্লাহার্টি-ডুন্নান ফার্স্ট নোবেল প্রাইজ’-এর চূড়ান্ত তালিকায় নির্বাচিত হয় এবং ‘ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর’ ও ‘বোস্টন গ্লোব’ ম্যাগাজিন ২০১০ সালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আফ্রিকার উপন্যাস হিসাবে আখ্যায়িত করে। ইতোমধ্যে উপন্যাসটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

মাজা মেনজিস্ট ‘ওয়ার্ডস উইথআউট বর্ডার্স’ এবং ‘ওয়ারস্কেপস’ অনলাইন ম্যাগাজিনের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য হিসাবে নিয়জিত আছেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং সেখানেই বসবাস করেন।

গল্পসূত্র:
‘অদৃশ্য মানচিত্র’ গল্পটি মাজা মেনজিস্টের ইংরেজিতে ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যাপ’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘এনকারে রিভিউ’ ম্যাগাজিনের ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।