বাবার বিয়ে |



মোজাফ্‌ফর হোসেন
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাবাকে কিছুই বলার ছিল না। বিয়ের খবরটা শুনে ছাদে গেলাম। আগামীকাল কিংবা পরশু বিয়ে করবেন বাবা। বাড়িতে চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। ছোটবোন ফোন করে রাতে জানাল। মায়ের মৃত্যুর ছ’মাসও হলো না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে মুখ দেখাব কেমন করে, বলে ছোটবোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কিছু বলিনি। ওর কথা শেষ হলে মোবাইলের কলটা ও নিজেই কেটে দিল। মা জানতেন তার মৃত্যুর পর বাবা ফের বিয়ে করবেন। আমাকে বলেওছিলেন, ছোট সন্তান হিসেবে আমি যেন বাধা না দিই। মায়ের আদেশ ঠিকঠাক মেনে চলার মতো আদর্শ সন্তান আমি না। মৃত যে তার কাছে দায় তো আরো কম। তবু বাবার বিয়ে করার খবরটি আমার মধ্যে এতটুকু নাড়া দিল না। ছোটবোন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে চিন্তিত। ওর সমস্যা আন্দাজ করতে পারি। আমার ওরকম কোনো সমস্যা নেই। শহর থেকে দূরে আরেকটি শহরে পড়াশোনা করছি। এখানে আমার মা জীবিত না মৃত, বাবা আবার বিয়ে করলেন কিনা, তাতে কার কী এসে যায়। কারো কিছু এসে গেলেই বা আমার কী করার আছে!

ছাদে আজ আলোটা বেশ। এত চড়া আলো রাতে বেমানান। কোনো এক রাতে এমন আলোয় বাবাকে দেখেছিলাম মাকে উঠোনে বেঁধে ঘরের হুড়কো দিয়ে পেটাচ্ছেন। সকালে উঠে মায়ের হাতে-পায়ে কোনো দাগ দেখিনি। বড় ভাইবোনদের বললে ওরা হাসতে হাসতে বলেছিল, বাবা কখনোই মায়ের গায়ে হাত ওঠান না। এরপর খেতে বসে আমার সামনেই বাবাকে যখন ওরা বলল, বাবা তুমি নাকি কাল রাতে মাকে উঠোনে মেরেছো! সঙ্গে সঙ্গে মা বাবাসহ ওদের হেসে ওঠা দেখে আমি তো লজ্জায় বাঁচি না। এরপর যতবার এ দৃশ্য দেখেছি আমি চুপ করে থেকেছি। আমার দেখার ভুল নিয়ে আরো অনেক সন্দেহ থেকে গেছে। সংসারে সব সন্দেহ দূর হয় না। এটা মায়ের কথা। কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন আজ আর মনে করতে পারি না। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক কথা উড়োকথা মনে হয়। কোনো কোনো কথা ভেসে ওঠে বাতাসে। মানুষের মৃত্যুর পর যদি কিছু থেকে যায় পৃথিবীতে, সে হলো কথা। সেই কথা থেকে আবার নতুন কথা তৈরি হয়। যেমন, মাসখানেক আগে মা বললেন, ন্যায় অন্যায় সমাজের ব্যাপার। খুন করাও কখনো কখনো অন্যায় না, প্রকৃতির চেয়ে বড় খুনি তো আর কেউ হতে পারে না। তাই মনের ভেতর ন্যায় অন্যায় বলে কিছু পুষে রাখতে নেই। এই কথাগুলো মা যখন আমাকে বললেন তার কয়েকমাস আগেই তিনি মারা গেছেন। মায়ের ভাসতে থাকা কথা থেকে এমন আরো অনেক কথা তৈরি হয়, আমি কিছু শুনি, কিছু আমার অন্য ভাইবোনরা শুনতে পায়। কিছু হয়তো কেউ শোনে না। আমি কারো না শোনা কথাগুলো প্রায়ই ধরে ধরে মেলানোর চেষ্টা করি। সেদিন ভুল করে অন্য একজনের কথা ধরে ফেলেছিলাম, আমার মা নয়, অন্য মা, তার সন্তানকে বলছেন মরে উঠতে। সন্তানের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাইনি। জীবিত মানুষের কণ্ঠস্বর শূন্যে ভাসে না। মা কেন তার সন্তানকে মরে উঠতে বলবে? কথাটি কি বেঁচে উঠতে হবে? মৃত মা কেন তার জীবিত সন্তানকে বেঁচে উঠতে বলবে? নাকি সন্তানও মৃত? সন্তান মৃত হলে মরে উঠতে বলবে কেন? অনেকদিন এই কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি।

ছোটবোন ফের ফোন করে। ওর স্বামী বলেছে, তোর বাবা যদি সত্তরে বিয়ে করতে পারে, আমি করলে দোষ কোথায়? সম্ভবত মেরেছেও। ও না বললেও বুঝেছি। মার খাওয়াটা ওর জন্য ঘটনা না, আরেকটা বিয়ে করার হুমকি শুনে ভড়কে গেছে। একটা মেয়ে প্রাইমারি শেষ করবে, আরেকটা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বিয়েটা যদি সত্যিই করে ফেলে তো ওর জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু ওর কষ্ট আমাকে এখন ছুঁতে পারে না। আমি যত চেষ্টা করি তত দুলাভাইয়ের কথা মনে হয়। এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছে। শুয়েছেও। লোকজন সব এখন জানে। ও বিয়ে না করলে ওই নারী আত্মহত্যা করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমি বোনের হয়ে ওকালতি করতে গিয়েছিলাম। সংসার টেকাতে ওকে হালকা করে হুমকিধামকিও দিতে হয়েছে। মহিলা রাজি হয়েছিল এক শক্ত শর্তে। আমি যদি বিয়ে করি তো ও আমার দুলাভাইকে ছেড়ে দেবে। মহিলার মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনেছি। এরপর আর ওর ব্যাপারে আমি কিছু বলিনি। তুই বিয়েটা করে ফেল। ছোটবোন আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার দুধের শিশুদুটোর কথা ভেবে। আমি বললাম, ঠিক আছে করব। ও তখন নিজেই তেড়ে ওঠে, ও বেশ্যা মাগীকে বিয়ে করে তুই কেন জীবন নষ্ট করবি? ওই খানকি তো এটাই চায়, কারো গলায় ঝুলে যেতে পারলেই হয়। ও কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা রেখে দেয়।

নীলার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে আমার। এটাকে ঠিক ব্রেকআপ বলা যায় কিনা জানি না। ও চেয়েছিল স্বামীটা যতদিন পিএইচডিটা শেষ করে দেশে ফিরছে ততদিন আমাকে দিয়ে বিছানার কাজটা মিটিয়ে নেবে। চারদিন ওর বাসাতে আর একদিন আমাদের মেসের রুমে চেষ্টাও করা হলো। কিন্তু আমার সাড়ে তিন ইঞ্চি দিয়ে ওর হলো না। বিবাহিত, এক সন্তানের মা। আমাকে দেখে নাকি ধারণাই করতে পারেনি এত ছোট হবে। ও খুব হতাশ হয়েছে। আমার কোনো অপরাধ নেই, ওকে বলেছি। এইটুকু নিয়ে কেউ প্রেম করে, তাও পরকীয়া—নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। নীলার মনটা খুব নরম। হাসনা চাচির মতো হিজড়া গালি দিয়ে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়েনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকেছে। কেঁদেছে, একটু আমার জন্য একটু নিজের জন্য। আমার চেহারা ও শরীরটা দেখে আরো অনেক নারী ধোঁকা খেয়েছে। অধিকাংশ মেয়েদের সমস্যা ওরা মোড়ক দেখে কোয়ালিটি বিচার করতে চায়। আমার রুমমেট শফিকের সাইজটা ঠিক আছে, কিন্তু চেহারা খারাপ, ছোটখাটো মানুষ বলে কোনো মেয়েকে বিছানা পর্যন্ত আনতে পারেনি। শফিকের জন্য আমার খারাপ লাগে। ভেবেছিলাম নীলাকে বলব শফিকের কথা। তার আগেই নীলা একজনকে পেয়ে গেল। ওর মেয়েকে পড়াতে আসে ছেলেটা। আমাকে ফেসবুকে ছবি দেখিয়েছে। অল্পবয়সী ছেলে। শুকনো শরীর। কিন্তু যেটা দরকার সেটা ঠিক আছে। নীলাকে খুশি দেখে আর কিছু বলিনি।

বড়ভাইয়ের ফোন এলো। বুঝেছি বাবার বিয়ে নিয়ে বলবে। ভেবেছিলাম আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে বলবেন আপত্তি না করতে। বড়ভাবী বাবাকে রান্না করে খাওয়াতেন। কিছুদিন থেকেই বলছেন বাপের বাড়ি চলে যাবেন। বাবা বললেন, বাবাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যও তো একজন দরকার। বুড়ো হয়েছে, বিছানায় পড়ে গেছে কে দেখবে? আমি কোনো কথা বলিনি। মায়ের মৃত্যুর পর ঠিক হয়েছিল বাবাকে বড়ভাবী আর মেজভাবী পালা করে খাওয়াবেন। গতমাসেই মেজভাই শহরে বাড়ি ভাড়া উঠেছেন। গ্রাম থেকে নাকি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। বাবার বিয়ের বিষয়ে তার অমত থাকার কথা না। মেজভাই ফোন করে বাবার বিয়ে নিয়ে কিছু বললেন না। বললেন, বিয়ের আগে সম্ভব হলে বাবার কাছ থেকে বাড়িটা লিখে নিতে হবে। না হলে শেষ বয়সে নতুন কেউ সংসারে এসে বাড়িটা তার নামে লিখে নিতে পারে। মাঠের জমির বণ্টননামা ঠিক করে নিতে হবে। বিয়েতে আমরা মত দিলে বাবা সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। মেজভাবীর হাত থেকে মোবাইলটা বড়ভাবী নিলেন। বললেন, নতুন বউকে লিখে দেয়াটা বড় কথা না। যদি তার ঘরে সন্তান হয়, তাহলে সে বাড়ি-জমিজমার অংশীদার হয়ে যাবে। বাবার বয়স সত্তর পার। এ বয়সে সন্তান হয় নাকি? ভাবীকে বললাম আমি। ভাবী বললেন, সন্তান হতে বাবাকে লাগবে কেন? আশেপাশের পুরুষ মানুষের অভাব নাকি? অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে দু বছরের মধ্যেই পেট হবে, আমি বলে দিলাম, তুই লিখে রাখ। ভাবী আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন। সন্তান হলে সম্পত্তির ভাগ পাবে। বড়ভাই আর মেজভাই কি আমাদের ভাগ দিচ্ছে না? আমরা আলাদা মায়ের সন্তান হলেও তো কেউ বঞ্চিত হচ্ছি না? আমি প্রশ্ন করি ভাবীকে। কিন্তু এখন যে সন্তান হবে সে তো বাবার সন্তান না, আমরা তাকে ভাগ দেব কেন? ভাবীর উত্তর। এতটা নিশ্চিত হয়ে ভাবী যখন বলেন আমার আর কিছু বলার থাকে না। শুধু আস্তে করে বলি, আমরা কে বাবার সন্তান আর কে বাবার সন্তান না, সেটা আর এখন শতভাগ নিশ্চিত হই কেমন করে যখন আমাদের মায়েরা মৃত। ভাবী আমার কথা শুনে রাগ করে ফোনটা রেখে দেন। ভাবীর পুরানো ইতিহাস আমি জানি, ইঙ্গিতটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখে কথা বাড়াননি।

ব্যক্তির ইতিহাস সমষ্টির ইতিহাস না। এটা সবসময় লিপিবদ্ধ থাকে না। জাতির ইতিহাস ব্যক্তি ধারণ করে সেখানে তার নিজের ইতিহাস নেই দেখেও। আমার মুক্তিযুদ্ধ-পলাতক বাবা জাতীয় ইতিহাসে নিজের ভুল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে গবেষক শান্তিবাহিনীর তালিকাতে বাবার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভারতে প্রথম স্ত্রীর বড়বোনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস পর গ্রামে ফেরেন। ওখানে কিছু ঋণ করে আর একটা দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে শরণার্থী ক্যাম্পের জন্য ছোটভাইয়ের হাতে নিয়মিত টাকা দিতেন। দেশে ফিরে জানতে পারলেন তার ছোটভাই, মানে আমার আপন ছোটচাচা, কলকাতায় হোটেলে আরামে থেকেছেন সেই টাকায়। ওই গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ছোটচাচার নামটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ আছে। বাবাকে বলেছিলাম গবেষক ও প্রকাশকের নামে একটা মানহানির মামলা করতে। বাবা করেননি। বলেছেন, টাকা যখন শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছায়নি তখন আর পলাতক ও শান্তি কমিটির মধ্যে পার্থক্য করে কী লাভ! বাবা লাভ লোকসান না দেখলেও ক্ষতি একটা হয়েছে আমাদের। সেজবোনের বেসরকারি স্কুলের হওয়া চাকরিটা হতে দিল না প্রতিপক্ষ ক্যান্ডিডেটের বাবা, আমার বোনকে রাজাকারের মেয়ে অভিযোগ তুলে। সেই ছোটচাচার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হিসেবে সগৌরবে চাকরিটা পেল। বাবা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। সেজবোনটা আত্মহত্যা করলেন তার এক বছর পরে। চাকরি না হওয়ার জন্য নয়, স্বামী অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, বিয়েও করেছিল। বোনটাকে মেরে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। আত্মহত্যা বলে সেজবোনের ব্যক্তিগত ইতিহাসে লেখা রইল।

সেজবোনের কোনো কোনো কথাও শূন্যে ভেসে ওঠে। আমাকে একদিন বলেছিল মেয়েটা খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। মরার সময় ওর পেটে ছিল। সাত মাসের। আর একদিন বলেছিল, ওর খুব আনন্দ হয় বেঁচে থাকতে। ও তো মৃত, বেঁচে থাকতে আনন্দ হয় কিভাবে আমি বুঝিনি। মৃতদের যে কথাগুলো শূন্যে তৈরি হয় তাদের আগের কথাগুলো থেকে তাতে অনেক সময় কোনো অর্থ থাকে না। থাকলেও আমরা জীবিত মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে পারি না। কখনো কখনো সক্ষমতার প্রশ্নে কে বেশি এগিয়ে— জীবিত না মৃত আমি বুঝতে পারি না। যেমন আমার নিজের সক্ষমতা কতটুকু? নীলা কিংবা হাসনা চাচীকে কেন খুশি করতে পারি না? বাবার বিয়ে থামাতে বলে ছোটবোন, বড়ভাই-মেজভাই বলে বিয়েতে আপত্তি না তুলতে। কিন্তু আমি কি চাই সেটা নিজেও ঠিক করতে পারি না।

মাঝে মাঝে মনের এমন নিষ্ক্রিয়তা থেকে কোনো কোনো কাজ করে বসি। ছোটবোন সেদিন রাতে বলল দুলাভাইয়ের প্রেমিকার বাসায় ফের যেতে। গেলাম আমি। মহিলার বয়স আমার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। ঘরের ভেতরে গিয়ে বসলাম। মহিলার মা বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিল। আমি কিছু বলি না। জানি না কী বলতে এসেছি। ছোটবোন কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারি না। মহিলা শাড়িটা খোলে। ব্লাউজ না খুলে পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। আর কিছু পরেনি ভেতরে। এরপর কী হবে আমার জানা। কিন্তু এই মহিলা অন্য নারীদের মতো আমার নগ্নতা দেখে হতাশ হয় না। হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে। আমি কী বলতে এসেছিলাম, কী করছি সেটা ভেবে লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মহিলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। কেউ একজন দরজাটা ফাঁক করে। ক্যাচ করে শব্দ হয়। মোবাইলে ছবি তোলার আওয়াজ আসে। ক্যামেরার সাউন্ড অফ করতে ভুলে গেছে কিংবা ইচ্ছা করেই অফ করেনি। ছবি তোলা শেষ। এখন মহিলার থেমে যাওয়া উচিত। তা না করে আমাকে বসিয়ে এক পা বিছানায় তুলে মুখটা চেপে ধরে। বের হ মাগি। ওর মা বাইরে থেকে বলে। থাম, বের করে নিই। মহিলা ভেতর থেকে ঘনস্বরে উত্তর দেয়। আমার নিস্ক্রিয়তা কখনো কখনো কারো জন্য সক্রিয়তার কারণ হয়ে ওঠে। আমি আর সে রাতে বোনের বাসায় ফিরে যাই না। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পেছনের মসজিদে কয়েল জ্বেলে ঘুমায় পাড়ার শফি হুজুর। মসজিদে গেল সপ্তায় দু রাতে দুটো ফ্যান চুরি হয়েছে। জুম্মার নামাজে টাকা তোলায় ব্যবহৃত টিনের বাক্সটাও কখন কে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে শফি হুজুর পাহারায় থাকে। বউ ডাকলে উঠে যায়, কাজ সেরে আবার এসে মসজিদে ঘুমায়। মাঝরাতে মসজিদের টিউবওয়েলে ওর গোসল করার শব্দ শুনে বুঝি। আমার এখন গোসল করা উচিত কিনা জানি না। কোনো নারীর সামনে নগ্ন হলে কি গোসল করতে হয়? পাশে শুয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি। কাজ না করলে গোসল করার দরকার নেই। শফি হুজুর আমাকে বলে। কাজ করা বলতে যা বোঝায় তা আামাদের হয়েছে কিনা বুঝে উঠতে পারি না। আমরা মসজিদের ভেতরে আর এসব নিয়ে কথা বলি না। কিছুক্ষণের মধ্যে শফি হুজুরের নাক ডাকার শব্দ আসে। একজন নারী আমাদের মাথার কাছ থেকে ছায়ার মতো ঘুরে যায়, আমি টের পাই। পেছন ফিরে তার চলে যাওয়া দেখি। শফি হুজুরের বউ সালোয়ার-কামিজ পরে না। শাড়ি পরে। সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি শফি হুজুরের বাড়ির উল্টো দিকে আমবাগানের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে মিলে যায়। ওদিকে গোরস্থান। কোনো বাড়িঘর নেই। আমি উঠে বসি। স্বপ্ন দেখছেন, ঘুমিয়ে পড়েন। শফি হুজুর বলে। গোলস করে শুলে ভালো করতেন। ওর কথা শুনে আমার আর ঘুম আসে না।

বড়দুলাভাই ফোন করেন। উনার ধারণা বাবার বিয়েতে আমার জোর আপত্তি আছে। আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর তোর মাকে যখন শ্বশুর বিয়ে করলেন তখন আমরা আপত্তি করিনি। শশুরের বয়স তখন কম ছিল, আপত্তি করলেও শুনতেন না। পুরুষ মানুষ ওই বয়সে একা থাকলে নানা বদনাম হতে পারে। তারচেয়ে বিয়ে ভালো। এখন শ্বশুরের বয়স হয়েছে। আমরা আপত্তি করলে জোর করতে পারবেন না। কিন্তু তার দেখাশোনার জন্য তোর বোনরা পড়ে থাকতে পারবে না। তোর দু ভাইয়ের বউ তো কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তুই বিয়ে করে বউকে রেখে যা। গরীবঘরের অল্প শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে থাকবে। দুলাভাইয়ের কথাগুলো আমি শুনলাম। বিয়ে আমি করতেই পারি। বউ আমার টিকবে না। বাবার তৃতীয় বিয়ের কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে আরেকটা কেলেঙ্কারি তৈরি হবে। দুলাভাইকে সব বোঝাতে পারি না। বলি, বাবা বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়? তাহলে তোর অমত নেই? দুলাভাই আমার মত পেয়ে খুশি হন। তখন বুঝতে পারি উনি আসলে কৌশলে আমার মত নিতে চেয়েছিলেন।

রাতটা ছাদে বেশ কাটে। শহরের সন্ধ্যারাতের প্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভে গেলে কিছুটা অন্ধকার আসে এদিকে। কিংবা অন্ধকার আগে থেকেই ছিল, আলো সরে গেলে দৃশ্যত হয়। অন্ধকারটাই পৃথিবীর, আলোটা আসে বাইরে থেকে। গাছগুলো যে আছে এতক্ষণে টের পাওয়া যায়। প্রাণ আছে যতকিছুর তার মধ্যে গাছ এক যে নিজের ইচ্ছায় স্থান বদল করতে পারে না। শহরে এক একটা গাছ আমাদের পূর্বগাছদের বিস্মৃত স্মৃতি হয়ে অপেক্ষা করে। কোনো কোনো অপেক্ষা জড় বস্তুর মতো নিস্ফলা, বৃক্ষের মতো নিশ্চল।

রাত আরো গভীর হলে আমার স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। অতীতের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা আগাম মনে পড়ে। মনে হয় মা বেঁচে আছেন। আমি গনগনে দুপুরে গোলাঘরের ছায়ায় বসে। বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তখন আর মা বেঁচে নেই। উঠোনে দেখি রোদের ভেতর মা শুকোতে দেওয়া সিদ্ধ ধানগুলো নেড়ে দিচ্ছেন খালি পায়ে। সেই উঠোনেই আবার নতুন বউ নিয়ে বাবা বসে আছেন এক বিকালে। ঘোমটা সরিয়ে লোকজন দেখছে। আমি উঠে গিয়ে দেখি আমার মায়ের চেহারা। বাবার বয়স তখন অনেক কম। মাকে বিয়ে করে এনেছেন। আমার জন্মের আগের দৃশ্য কিন্তু আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। বাবার বয়স আরো কমে, ঘোমটার ভেতর চেহারাটা বদলে যায়। আমার বড় মা কিংবা মেজ মা হবে। আমি তাদের দেখিনি বলে নিশ্চিত হতে পারি না। মা যখন ধানগুলো নেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে যান, তখনই অন্ধকার নামে। দুপুর থেকে সরাসরি রাত। বিকালটা গায়েব। রাতে আমি বারান্দায় বসে। সামনে অচেনা দৃশ্যপট। একজন নারী আমার সামনে চায়ের কাপ তুলে ধরে বলে, পেনশনের টাকাটা কাল তুলে আনো। আমার পায়ের শক্তি কমে আসে। বুঝতে পারি বয়স হয়েছে। চায়ের কাপ ধরে থাকা হাতটির মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী হতে পারে। কিন্তু আমি বিয়ে করলে আমার স্ত্রী টেকার কথা না। আমার বাকি জীবন একা থাকার কথা কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অনেক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। একজন জোর গলায় বলছে, আমাকে কেউ মারেনি। আমি একা একা মরেছি। কিন্তু আত্মহত্যা করিনি। আমার মেজবোন কিংবা মায়ের কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়। আরেকজন বলছে, চেষ্টা করলে হয় না, সব চেষ্টা হওয়ার জন্য না। কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারি না। আমি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কার্ণিশের কাছে চলে যাই। এই আমি অতীত, বর্তমান নাকি ভবিষ্যতের কিছুক্ষণের জন্য বুঝে উঠতে পারি না।

ঘুমটা ভাঙে বড় দুলাভাইয়ের কলে। ভালো একটা পাত্রী পেয়েছি। বয়সটা কম, কিন্তু সন্তান হবে না। আগের স্বামী সেই কারণে তালাক দিয়েছে। কোনো বদনামের সুযোগ থাকল না। আমার আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। আজ ভার্সিটি যাব না। দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয় ছোটবোন। বাবার বিয়ে হয়ে গেছে। ও বলে। ততটা অখুশি বলে মনে হয় না। ওই মহিলার সঙ্গে। বড় দুলাভাইয়ের প্ল্যান।
কোন মহিলা? আমি জানতে চাই।
মাগীটা। বলে আমাকে আবার প্রশ্ন করে—এখন কি গালি দেওয়া ঠিক হবে? বাপের বউ মানে তো আমাদের মা। মানি আর না-মানি।
রাখ তুই। আমি ঘুমাব। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকব। যখন জেগে উঠব আমার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠবে শূন্যে। তুই মোবাইল ছাড়াই শুনতে পাবি।
দিন কোথায় পেলি? এখন তো রাত। ছোটবোন বলে।
জানালা খুলে দেখি সকাল হয়েছে। মা বাসি উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ময়লাগুলো টোকায় তুলছেন। একবার মনে হয়, মাকে ডেকে বলি বাবা আবার বিয়ে করবেন। তখন মনে পড়ে যায় মা আগে থেকেই জানেন, মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন। আমি ভবিষ্যৎ দেখে এলাম নাকি অতীতে ফিরে গেছি বুঝে উঠতে পারি না। নিজের বর্তমান ছাড়া সময়ের আগপিছ নির্ণয় করা কঠিন। মৃতের কি কোনো বর্তমান থাকে?

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;