সাংবাদিকতার শিক্ষক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং তাঁর কিছু স্মৃতি
দেশের বাইরে থাকলে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতে হয়। তার মধ্যে প্রিয়জন, স্বজন, সতীর্থদের সান্নিধ্যও অন্যতম। এই যে মুহম্মদ জাহাঙ্গীর কাছের মানুষ ছিলেন, এখন দূরের মানুষ হয়ে হারিয়ে গেলেন। দূরের দূরত্ব আরো দীর্ঘ হলো। কিন্তু স্থান করে নিলেন মনের গভীরে।
লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, উপস্থাপক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নানা ক্ষেত্রেই তিনি কাজ করেছেন। কাজে-কর্মে, চলনে-বলনে খুব ঝরঝরে ছিলেন। সদা তারুণ্যদীপ্ত জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে যখনই দেখা হয়েছে, তখনই মনে হয়েছে প্রাণবন্ত। নিজস্ব গুণের জন্য তিনি মানুষকে মুগ্ধ করতে পারতেন।
খ্যাতিমান হয়েও মানুষ হিসেবে ছিলেন সাদামাটা। কখনোই বলতে শুনিনি, তিনি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহম্মদ ইউনুসের ভাই। চালচলনেও ছিলেন অতি সাধারণ। আজিজ মার্কেটে বই কিনতে বা অন্য কাজে এলেই আমার অফিসে ঢু মারতেন, আড্ডা দিতেন। একবার রাহমান ভাই এসেছেন অফিসে। আমাদের আড্ডা হচ্ছিল। হঠাৎ এসে হাজির হলেন জাহাঙ্গীর ভাই। তাঁকে পেয়ে আড্ডা জমে উঠল। কারণ, রাহমান ভাই আড্ডার মধ্যমণি হলেও কথা বলতেন কম। ফলে জাহাঙ্গীর ভাই জমিয়ে তুললেন। খুব মনে আছে, সেদিন তিনি বলেছিলেন—‘আমি বাংলা সাহিত্যে এবং সাংবাদিকতায় ডবল মাস্টার্স করেও কিছুই করতে পারলাম না। আপনি এসব না পড়েই আমাদের গুরু!’
আজ তাঁর টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো মনে নাড়া দিচ্ছে। যেমন, ঊর্মি আপা আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ছাড়াছাড়ি হবার পর তিনি ‘ঊর্মি জাহাঙ্গীর’ থেকে আবারও ঊর্মি রহমান হয়ে গেলেন। তখন ঊর্মি আপা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় টিভির অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করতেন। টেলিভিশনে আমার গান প্রচার হয়েছে, কিন্তু আমার নাম যায়নি। বইমেলায় জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে দেখা; বাংলা একাডেমির গেটে রিক্সায় বসে আছেন। তিনি বললেন, একটু দাঁড়াও। এক্ষুনি ঊর্মি আসবে। তাঁকে বলে দিচ্ছি!
একটু পরে ঊর্মি আপা এলেন। ঘটনা শুনলেন। তারপর তাঁরা এক রিক্সায় করে চলে গেলেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হলেও, বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট হয়নি। এই ‘আধুনিকতা’ দেখেছি বহু বছর আগে!
জাহাঙ্গীর ভাই বিভিন্ন চ্যানেলে উপস্থাপনা করতেন। এই উপস্থাপনা নিয়েও তাঁর সাথে স্মৃতি আছে। আমি তখন বিটিভিতে ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ নামে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। সেই সময় কলকাতা বইমেলার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ। সেই বইমেলা বিটিভিতে প্রচার করার জন্য সরকারি দলের সদস্য হিসেবে যাবার কথা থাকলেও তথ্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দোটানায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমার নাম বাদ পড়ে যায়। পরে কলকাতায় গিয়ে অনুষ্ঠান ধারণ করে প্রচার করি। আর তা রেকর্ডিং করার যাবতীয় কাজটি করে দিয়েছিলেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর ভাই। তিনি এটিএন বাংলা অথবা চ্যানেল আইয়ের প্রোগ্রাম করছিলেন। সেই ফাঁকে ক্যামেরা, টেপ সব দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে তিনি সাংবাদিক প্রশিক্ষক ছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক। এবং আমাকেও একদিনের ‘শিক্ষক’ বানিয়েছিলেন। ক্লাস নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রেস ইনস্টিটিউটে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমদ ভাইও আমাকে একবার ফরেন একাডেমিতে এভাবেই প্রশিক্ষক বানিয়েছিলেন।
সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর পাবার পর আজিজ মার্কেটে মিডিয়া সংক্রান্ত ব্যবসা শুরু করি। জাপানের মানচিত্র, ক্যালোফোর্নিয়ার পড়শি, সুইডেনের পরিক্রমা ঢাকা থেকে সম্পাদনা, প্রকাশনা করে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে পাঠাতাম। সেজন্য ‘প্রবাসে বাংলা গণ মাধ্যম’ নিয়ে কথা বলি। পরে তা প্রেস ইনস্টিটিউটের পত্রিকা ‘নিরীক্ষা’য় ছাপা হয়। লেখাটি দীর্ঘ করে বই বের করার জন্য বারবার তাগিদও দেন! কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের লেখা পঁচিশটি বই। যার বেশিরভাগই সাংবাদিকতা নির্ভর। সাংবাদিকতার ওপর এত বই আরো কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। আর সেজন্যই তিনি চেয়েছিলেন—‘প্রবাসে বাংলা গণ মাধ্যম’ বইটা বের হোক।
তাঁর সাথে মধুর স্মৃতির বাইরে একটা তিক্ত এবং বিরক্তকর স্মৃতিও আছে। একবার জাহাঙ্গীর ভাই স্টোকহোমে যাবেন। আমার কাছ থেকে সুইডেনের পরিক্রমার সম্পাদকের ঠিকানা নিলেন। দেখা করলেন এবং পরের সংখ্যা থেকে পত্রিকা বের করার দায়িত্ব পায় সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট কম্যুনিকেশন। সেজন্য খুব মন খারাপ হয়েছিল এবং ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ওপর। কিন্তু পরিক্রমা বের করার ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস ছিলেন না এবং গোপনে এটি একটি এনজিও মুখপত্র হিসেবে দূতাবাসের সাথে যুক্ত করেন। পরিক্রমা কর্তৃপক্ষ এসব টের পাবার পর সিদ্ধান্ত পাল্টায়।
মজার ব্যাপার, পরের বছর আমি সুইডেনে গেলে পত্রিকাটি পুনরায় আমাকে দিয়ে বের করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এই ঘটনাটির জন্য জাহাঙ্গীর ভাই লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হন। তবে আমার মন হয়—এজন্য জাহাঙ্গীর ভাই নয়; পত্রিকার সম্পাদক লিয়াকত হোসেনই নাটের গুরু!
যাই হোক। জাহাঙ্গীর ভাই ক’ বছর আগে টরন্টোতে এসেছিলেন। তখন তাঁর ভাতিজি ডা রুবিনা রোকাইয়ার বাসায় দীর্ঘ আড্ডা দিতে দিতে জাহাঙ্গীর ভাই বলেছিলেন, ‘দুলাল, দেশ ছেড়ে দূরে চলে এলে। আর আমাদের আড্ডা হবে না।’
জাহাঙ্গীর ভাই, আজ আপনি তো দেশ থেকে নয়; একেবারে এ জগত ছেড়েই না ফেরার দেশে চলে গেলেন! আর তো আমাদের দেখা হবে না, আড্ডা হবে না!