চুলোচুলি
না না যেরকম ভাবছেন ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয়! মারপিট ঝামেলা এসব নিয়ে এই লেখা নয়! বরং পুরোটাই চুলোচুলি বাদ দিয়ে খাঁটি চুলের কথা। মানুষের চেহারার ওপর মানুষের হাত নেই। একেবারেই কী নেই? হ্যাঁ বিজ্ঞানের দৌলতে মানুষের হাত এখন অনেক লম্বা। নারী-পুরুষ উভয়ের কাঠামোগত সুদৃশ্যে চুলের ব্যবহার কিন্তু অনস্বীকার্য। এখন চুল কি থাকতেই হবে? না, এর অপরিহার্যতা নিয়ে এখন কোনো প্রশ্নই নেই! যেহেতু সেই দিক থেকে ভাবলে কোনো কিছুই অপরিহার্য নয়! তবে এখানে সৌন্দর্যের উপস্থাপিত উপকরণ হিসেবে চুলের কথা ভাবা হচ্ছে।
একটা সময় ছিল যখন আদিম মানুষ চুলের বৃদ্ধি নিয়ে ভাবিত ছিল না। শরীরের ক্রমান্বয় বৃদ্ধির মতো চুলেরও আকৃতি বাড়ে। তবে কর্মক্ষেত্রে অসুবিধের জন্য তারা পাথর দিয়ে এসব চুল কাটাকাটি শুরু করল আর সুস্থ বোধ করল—এই গেল আদিম অবস্থা। তারপর যুদ্ধক্ষেত্রেও চুলের জন্য ঝামেলা বাড়ল। বলা যায় চুলোচুলি এড়াতেও ছেলেরা চুলের গাঠনিক পরিস্থিতি থেকে সরে আসল। কিন্তু উন্নত সভ্যতার মানুষ যেহেতু শিল্প কী বুঝেছিল তাই চুলের প্রভাবে সুন্দর হওয়ার কথাও তারা বুঝে গেল। বিশেষত নারী দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে চুলের আহ্লাদকে তারা শৈল্পিক আবেদন হিসেবে অনুভব করতে পারল। একটি পূর্ণ ও ভর্তি গঠনে মাথার চুল যে সাযুজ্য দেয় এ সকলেই বুঝলেন। তারপর ক্রমাগত চুল ও তার ব্যবহারিক কাঠামোতেই মানুষ অভ্যস্ত হতে থাকল।
চুলের স্টাইল, তার নামকরণের বাহার দেখলে চমকে যেতে হয়। বাংলায় কদমছাঁট, বামুনছাঁট, প্রেমের জপমালা ইত্যাদি সব নামের চুলের কাট। জাপানীদের সকার সান নামক চুলের কাট বিশেষ বিখ্যাত। এছাড়াও ওয়েন্ডওয়েপ্ট, হেলি হেয়ার, ইল্লুমিনাটি—এসবও চুল কাটার পদ্ধতি। ফুটবল খেলোয়াড় রোনাল্ডোর চুলের কাট আসলে ইল্লুমিনাটি ফ্যাশনের আওতায় পড়ে। চুল নিয়ে সাজসজ্জা, চুলের প্রদর্শনকে বিশেষ করা তোলার প্রয়াস শুরু হয় ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে প্রধানত ইউরোপীয় মহিলাদের মধ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ মেয়েরা চুল কাটতে শুরু করে ছোট রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করে সুবিধার জন্য। প্রাচীন সভ্যাতার সবগুলিতেই প্রায় যত্ন সহকারে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতিতে মেয়েরা চুলের রক্ষণাবেক্ষণ করত। রোমে অবশ্য চুলের স্টাইল ভীষণ জটিল ছিল। মেয়েদের সম্পর্কে এরকমও ধারণা করা হতো যে, খোলা চুলের মাধ্যমে তারা যৌনতা, অশরীরী প্রভাবকে আহ্বান করে। এমনকি যে সমস্ত মেয়রা চুল বাঁধে তাদের মূল্যবোধ সুগঠিত বলে ধরে নেওয়া হতো।
ইংল্যান্ডে লাল চুলের প্রভাব খুব বেশি ছিল। পুরুষেরাও চুলে লাল রং করত। বোরাক্স, সালফার, কেশর এসব ব্যবহার করে চুলে লাল রঙ করা হতো। রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় চুল লাল করার প্রবণতা তীব্র হয়। তবে মধ্যযুগীয় সভ্যতায় মেয়েরা চুল ফুলিয়ে তাকে উঁচুতে বেঁধে অলঙ্কারের প্রয়োগ করতে শিখেছিল। চুলে সুগন্ধি পাউডার দেওয়ার এক প্রথা ছিল গন্ধের জন্য। ছেলেরা অবশ্য পরচুলাও ব্যবহার করতেন। ১৬০১ সাল থেকে ১৬৪৩ সালে ফ্রান্সে পুরুষদের মধ্যে পরচুলা ব্যবহারের প্রাধান্য দেখা যায়। নিওক্ল্যাসিকাল মুভমেন্টের পর ছেলেরা সাধারণভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং তা কেটে ছোট চুল রাখার ব্যাপারে আগ্রহী হয়। চুল নিয়ে কত যে গান, কত যে ডায়লগ, কবিতা তার বোধ করি ইয়ত্তা নেই। তুলনামূলক হাত বলে একটি কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন কোনো এক নারীকে উদ্দেশ্য করে যে, সে যেখানে চুলের ভেজা জল মাটিকে দেয়, খোঁপা ভেঙে কবি সেখানে হাত পেতে বসেন।
আসলে যখন থেকে মানুষের মনের সঙ্গে চোখের সাযুজ্য বেড়েছে মানুষ সচেতন হয়েছে। ফ্যাশন দুনিয়াকে সফল করতে চুলের যে অত্যাশ্চর্য ব্যবহারের রকমফের আমরা দেখি তা অনস্বীকার্য। হিন্দু, জিউস, জাপানী বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ছেলে শিশুর মাথা পূর্ণ মুণ্ডন করিয়ে আবার তাকে প্রাকৃতিক চুলের আওতায় ফেলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন রক মিউজিকে মাথা ঝঁকিয়ে চুলের প্রদর্শন সেসব এক অভিনব প্রক্রিয়া। নারীর চিত্ররূপ ফুটিয়ে রহস্যের বুননে তাকে প্রকাশ করতে চুল ছাড়া কিছু ভাবাই যায় না। তবে আক্ষরিক অর্থে চুলোচুলি ছেড়ে দিয়ে চুলের ভালোবাসার প্রতি মন দিলে সভ্যতাকেও ভালোবাসা হয়।