খুনের জন্য

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

পৃথিবীতে যেমন সুখের উপাদানের শেষ নেই। স্বপ্নের আলোর শেষ নেই। তেমন অযাচিত কষ্টেরও শেষ নেই। সেই কষ্টের বহু উপাদান পৃথিবীতে আমরাই সৃষ্টি করেছি। পার্থিব জীবনকে আমরা এত বেশি গুরুত্ব দিই যে শেষ পর্যন্ত যখন কষ্ট হয় তখন আমরা যে কোনো শর্তে বাঁচার প্রয়াস করি, আর তখনই মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আর অপরাধের পথ খুলে যায়। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িকতা এর সংখ্যাটা এত বিশাল যে আমরা এর সঙ্গে ভালোর পাল্লা দিয়েও একে সরাতে পারি না। আসলে একটা দিনের ২৪ ঘণ্টার মতো অর্ধেকটা দিনের মতো স্পষ্ট আর অর্ধেকটা রাতের মতো আবছা ঠিক এইরকম কিছুটা বোঝা আর কিছুটা না বোঝা নিয়ে আমরা জীবনে এগুতে থাকি। ফলে ভালোর সঙ্গে খারাপকেও আমরা নির্মূল করতে পারি না। তাই একদিকে জন্ম হয় আরেকদিকে খুন হয়। একদিকে সৃষ্টিকে ভালোবাসি। আরেকদিকে সৃষ্টিকে ধ্বংস করি। আমাদের মস্তিষ্কে সব ধরনের অনুভূতির জন্য আলাদা আলাদা স্থান আছে। এমন নয় যে রাগ, দ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহা এগুলো কোনো বহির্ভূত বিষয় কিন্তু যখন এদের প্রাধান্য মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন ঘটনাটা অন্য রূপ নেয়। মানুষ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন জীব, নিজের দেহ, এর শিল্প, এর কবিতা, এর গান, এর মেধা নিয়ে মানুষ জর্জরিত। সেই দেহ থেকে কখন মানুষ রক্ত ঝরাতে পারে নিশ্চিন্ত চিত্তে? যখন তার অন্যন্য বোধরা ওই খুনের বোধের থেকে অনেক লঘু হয়ে থাকে।

বিশ্বের একটি উন্নত পরিসংখ্যান বলছে সারা পৃথিবীতে প্রতি মাসে গড়ে ১০০টি করে খুন হয়। গড়ে সারা বছরে পৃথিবীতে ১ কোটি ২৫ লক্ষ খুন হয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে এই বিষয়ে আতঙ্কের শহর হলো লস ক্যাবস (মেক্সিকো) আর কারাকাস (ভেনিজুয়েলা)। সেইদিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে সুইটজারল্যান্ডে সবচেয়ে কম অপরাধমূলক কাজ হয়। আর এই জঘন্য কাজে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় পুরুষরা। “ইউনাইটেড নেশন অফিস অ্যান্ড ড্রাগস এ্যান্ড ক্রাইম”-এর পরিসংখ্যানে হোমিসাইড স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে খুনের ৭৮ শতাংশের খুনী হলো পুরুষ। একজন মার্ডার এক্সপার্ট বলছেন মানুষের খুনের প্রধানত ১০টি কারণ থাকে, যথা—১. অন্ধ রাগ বা ইগো ২. লোভ ৩. হিংসা ৪. ক্ষমতা ৫. প্রতিশোধ ৬. সাংস্কৃতিক ভিন্নতার বিশ্বাস ৭. নেশাসক্তি ৮. খুব দারিদ্র্যপূর্ণ অবস্থা ৯. ভয় ১০. মানসিক বৈকল্য। এর মধ্যে সেলফ ডিফেন্স আর মানসিক বৈকল্য বাদ দিলে সমস্ত খুনে মোটের ওপর তিনটে সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়—১. বুদ্ধি কম হওয়া কিম্বা অপরিণত ভাবনা ২. অন্যায়ের প্রতি আসক্তি ৩. অনুভূতিপ্রবণতার গোলমাল। দেখা যায় যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় পরিবারে খুব অশান্তি দেখে বড় হয় কিম্বা ছোটবেলায় খুব অপমানিত হয় তাদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বাড়তে পারে। সাইকোলজি বলে একটা ভবিষ্যত সুস্থ মনের মানুষের ছোটবেলা খুব নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা উচিত যাতে অন্তত সে নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে শেখে। যেন সে অকারণে লজ্জা পেয়ে বড় না হয়। বহু খুনের যাচাই করে দেখা গেছে ছোটবেলায় বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়নি। লেখিকা সিলভিয়া প্লাথ খুন নিয়ে একটি দারুণ বক্তব্য দিয়েছিলেন—“why do we electrocute men for murdering an individual and then pin a purple heart on them for mass slaughter of someone arbitrarily labeled “enemy?”. ডার্ক জার টিন জু বলেছেন—“our love was a two-person game.at least until one of us died, and the other became a murderer”. মহাকাব্যের লেখক হোমার বলেছিলেন ওডিসি তে—“There will be killing till the score is paid”

বিজ্ঞাপন

হেমিংওয়ে বলেছিলেন আমরা যাকে ভালোবাসি নিজের জন্য, লোভের জন্য তাকেও আমরা খুন করি। আমরা মাছকে ভালোবাসি আবার খিদের জন্য খুনও করি। শেষপর্যন্ত আমরা ভাগ্যবান নিজেদের জন্য আমরা চন্দ্র, সূর্য খুন করি না। আসলে হেমিংওয়ে বলতে চেয়েছিলেন বেসিক্যালি আমরা খুনী, নিজেদের জন্য আমরা খুন করি প্রতিনিয়ত। ভাগ্যিস পৃথিবীর আশেপাশে সব সুন্দর জিনিসের খুন আমাদের খুব দরকারি নয়। মানুষ যে দেহকে লালন করে তাকে যখন নিজে হাতে খুন করে তখন আসলে যত না সে অন্যকে মারে তারচেয়ে বেশি সে নিজেকে খুন করে। তাই মনোবিদরা বলেন ব্যক্তি তার সত্তা সম্পর্কে কতটা সচেতন ভালো করে তা বোঝা উচিত।