উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুর হক মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজশাহীর নগরীতে তার নিজ বাসভবন ‘উজান’-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
রাত পৌনে ১০টার দিকে হাসান আজিজুল হকের ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইমতিয়াজ হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাবা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। মাঝে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ বোধ করায় তাকে আবারও রাজশাহীর বাসায় আনা হয়। কয়েকদিন ধরে বাবার শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছিলো না। আজ সন্ধ্যা থেকে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। রাত সোয়া ৯টার দিকে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান ইমতিয়াজ।
মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনি, ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষীসহ বহু গুণাগ্রাহী রেখে গেছেন। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাসান আজিজুল হকের স্ত্রী শামসুন নাহার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
কথাসাহিত্যিকের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামীকাল মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বাদ জোহর মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য তার মরদেহ রাখা হবে।
হাসান আজিজুল হক দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে গত ২১ আগস্ট রাজশাহী থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়া হয়। প্রথমে তাকে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পরে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজশাহীর বাসভবন ‘উজান’-এ ফিরেছিলেন হাসান আজিজুল হক।
হাসান আজিজুল হককে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের বরপুত্র হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ ৩১ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটি ‘বিহাস’-এর নিজ বাড়ি ‘উজান’-এ লেখালেখি নিয়ে মগ্ন ছিলেন হাসান আজিজুল হক।
১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের যবগ্রামে জন্ম নেন হাসান আজিজুল হক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখা নিজ গ্রামেই করেছেন তিনি।
১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারাণী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। যৌবনের শুরুতেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন হাসান আজিজুল হক।
রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। কলেজের অধ্যক্ষ তার মেধাবৃত্তি ফাইলচাপা করে রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে কলেজ ছাড়তে বাধ্য করেন। পরে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে।
১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
মূলত ষাটের দশক থেকেই ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন হাসান আজিজুল হক। তবে ১৯৫৪ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পরই লিখে ফেলেন প্রথম উপন্যাস।
১৯৫৭ তে লেখেন উপন্যাস শামুক, যা ২০১৫ সালের বই মেলায় প্রকাশিত হয়। এরপর অসংখ্য ছোটগল্প, গ্রন্থ, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, শিশুতোষ সাহিত্য।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এরমধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার।
১৯৯৯ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ২০১৮ সালে হাসান আজিজুল হকের নিজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালে তিনি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান। সবশেষ ২০১৯ সালে হাসান আজিজুল হককে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।