সোহরাব হোসেন : যিনি শুধু শিল্পীই নন
কোনো কিছুর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা আর আত্মপ্রত্যয় থাকলে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সঙ্গীতগুরু সোহরাব হোসেন। রানাঘাটের আয়েশতলা গ্রামের বুক চিড়ে প্রবাহিত চূর্ণী নদীর স্রোতধারায় যে ছন্দের দোলা, সঙ্গীতের সুর হয়ে তা যেন উঠে এসেছিলো সোহরাব হোসেনের কণ্ঠে। অকল্পনীয় বন্ধুর-পথ পেরিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। পারিবারিক রক্ষণশীলতা, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করার পথে সহযোগিতাও পেয়েছেন অনেকের। নিজের অদম্য ইচ্ছা আর শুভাকাক্সক্ষীদের সহমর্মিতায় বাধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে হয়েছেন একজন নিকষিত শিল্পী।
সোহরাব হোসেনের জন্ম নদীয়া জেলার রানাঘাট মহকুমার অন্তর্গত আয়েশতলা গ্রামে ১৩৩০ বঙ্গাব্দে (১৯২৩ সালের ৯ এপ্রিল) চৈত্রের এক পূর্ণিমা রাতে। ৪ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। শিশু বয়সে নানার কোলে চড়ে তাঁর তীক্ষ্ন কণ্ঠে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে পিতাম্বর দাস রচিত সেই বিখ্যাত গান ‘একবার বিদায় দে মা ঘুওে আসি...’-শুনে সোহরাব হোসেন বিস্মিত হয়েছিলেন। সেদিনই হয়তো তাঁর কোমল মনের উর্বর জমিনে রোপিত হয়েছিলো সঙ্গীতের চারা।
সেসব দিনে গ্রামোফোন ছিলো গান শোনার অন্যতম মাধ্যম। পেশাদার গানঅলারা গ্রামে-গঞ্জে কলেরগান বাজিয়ে গান শোনাতেন অর্থ বা শস্যের বিনিময়ে। গ্রামোফোন কোম্পানির তরফ থেকেও এমন ব্যবস্থা চালু ছিলো। বাড়ির প্রশস্ত উঠোনে গানের ফেরিঅলারা যখন গ্রামোফোন যন্ত্রে গান বাজাতেন তখন আর সকলের মতো শিশু সোহরাবও গোল হয়ে বসে গান শুনতেন। অবাক বিস্ময়ে ভাবতেন, ওই যন্ত্রের মধ্যে মানুষ ঢুকলো কী করে! এভাবে গান শোনেন আর গুনগুন করতে থাকেন। অসম্ভব প্রতিভার কারণে যখন যে গান শোনেন তাই অনায়াসে কণ্ঠে তুলে নেন অবিকল সুরে। দিনে দিনে অনুরাগ জন্মায় সঙ্গীতে।
তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে আঙিনায় সঙ্গীত নিষিদ্ধ সেখানে নিতান্তই একটি বালকের পক্ষে একা একা গান শেখা ছিলো মরুভূমিতে জল খুঁজে পাওয়ার মতোই দুরূহ। তবুও তিনি খুঁজেছেন নিরন্তর, রক্তাক্ত হয়েছেন; কিন্তু হাল ছাড়েননি। অবশেষে পেয়ে যান কাঙ্খিত জলধারার দিশা। এ পর্যায়ে পাশে পেয়েছেন রানাঘাটের জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর আনুকূল্য।
সোহরাব হোসেনের সঙ্গীত শিক্ষার প্রারম্ভিক জীবনে জড়িয়ে আছে চমকপ্রদ কিছু ঘটনা, কিছু নাম। চূর্ণী নদী, গোপী মাঝি, হ্যাপী ক্লাব এমন আরো কতো কী! কৈশোরে গান শেখার জন্যে প্রথম গুরু ধরেন রানাঘাটের এক ওস্তাদ জয়নাল আবেদিনকে। গোপীর নৌকায় চূর্ণী নদী পার হয়ে লুকিয়ে শহরে যান। গানের তালিম শেষে আবার গোপী মাঝির নৌকা। একদিন গান শিখে ফিরতি পথে দেখেন ঘাটে নৌকা নেই। মাঝির অপেক্ষায় চূর্ণীতীরে বসে উঁচু কণ্ঠে গান ধরলেন। বাতাসে সে সুর ভেসে পৌঁছে গেলো জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর কানে। জমিদার বাবু তলব করলেন তাঁকে। ভয়ে ভয়ে জমিদার বাবুর কাছে গেলেন।
বালক সোহরাবের পরিচয় জেনে একটি গান শোনাতে বললেন। তিনি গাইলেন, ‘মা তোর বরণ কালো কিসে মাগো বল...’। শ্যামাসঙ্গীতটি শুনিয়ে জমিদার বাবুর চক্ষু সজল হলো। এই একটি ঘটনা তাঁর সঙ্গীত জীবনের মোড় ঘুরে দিলো। সংস্কৃতিমনস্ক জমিদারের স্নেহের পরশে তাঁদের হ্যাপি ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করলেন। শুধুমাত্র এলিট হিন্দু ব্যক্তিরাই যে ক্লাবে সদস্য হওয়ার যোগ্য, সেখানে তিনি হলেন প্রথম মুসলমান সদস্য। একইসঙ্গে পুরস্কার হিসেবে পেলেন সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ কিরণ দে চৌধুরীর শিষ্যত্ব লাভের সুযোগ।
প্রাপ্তি অনেক হলো, তবু পারিবারিক বৈরীতা পিছু ছাড়ে না। রাতের আঁধারে কখনো গোপীর নৌকায়, কখনো সাঁতরে চূর্ণীর জল পার হয়ে যেতে হয় গানের তালিম নিতে। কখনো জোটে ভাইয়ের প্রহার। গোপী মাঝিও অপারগতা প্রকাশ করে একদিন। অতঃপর আবার সহায় হন জমিদার ক্ষীরোদ বাবু। তিনি তাঁর নিজস্ব ইঞ্জিনচািলত লঞ্চে নদী পারাপারের ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি একদিন জানাজানি হয়ে গেলে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের ছেলের গান শেখা প্রশ্নে গ্রামের মানুষ দুই ভাগ হয়ে যায়। সোবরাব হোসেনকে করে দেয় ‘একঘরে!’ এভাবেই নিরন্তর লড়তে হয়েছে কিশোর সোহরাব হোসেনকে।
আব্বাসউদ্দীনের সান্নিধ্য
১৯৪৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সোহরাব হোসেন তখন ২১ বছরের টগবগে যুবক। সে সময় একদিন রানাঘাটে এলেন কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদ এবং ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু। আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ গ্রন্থে (পৃ. ১৭৫) উল্লেখ করেছেন : ‘রানাঘাটে এলাম একটা গানের জলসায়। সিনেমা হল জনাকীর্ণ। প্রোগ্রামের মাঝখানে একটি তরুণ ছেলে ভারী মিষ্টি সুরে গান গাইল। কেন যেন মনে হল ছেলেটির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে শিল্পী সম্ভাবনা। জলসা শেষে ছেলেটির খোঁজ করলাম। রেলওয়ে কলোনিতে আমাদের রাত্রি প্রবাসের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সেখানে ছেলেটি এল। গান গাইতে বললাম। অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠ। গলা সূক্ষ্ম কাজে ভর্তি। ঠিকানা দিলাম কলকাতায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করার জন্য।’
নির্দিষ্ট দিনে সোহরাব হোসেন কলকাতা হাজির হলেন। আব্বাসউদ্দীন তখন কলকাতা রেডিওর সং পাবলিসিটিতে কাজ করেন। কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন সং পাবলিসিটির অর্গানাইজার। সং পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে একটা পোস্ট খালি ছিল। আব্বাসউদ্দীনের সুপারিশে সং পাবলিসিটিতে সিঙ্গার হিসেবে চাকরি হয়ে গেলো সোহরাব হোসেনের। শুরু হলো সোহরাব হোসেনের জীবনের নতুন অধ্যায়।
কলকাতাতেই সোহরাব হোসেনের বেতার ও গ্রামোফোন রেকর্ড এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এতে তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে। ১৯৪৬ সাল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি অডিশন দেন এবং যে কোনো কারণেই হোক উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। একথা জানতে পেরে আব্বাসউদ্দীন খুবই বিস্মিত। বিষয়টি তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। অতঃপর তিনি কলকাতা বেতার কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের ঘরোয়া পরিবেশে সোহরাব হোসেনের গান শোনানোর ব্যবস্থা করেন। গান শুনে সকলে মুগ্ধ হন। নিয়মানুসারে তিন মাস পর আবার অডিশন দেন এবং উত্তীর্ণ হন। এরপর থেকে সোহরাব হোসেন কলকাতা বেতারে নিয়মিত নজরুল সঙ্গীত ও আধুনিক গান গাইতে শুরু করেন।
সোহরাব হোসেনের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় ১৯৪৬ সালে জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের স্বদেশি রেকর্ড কোম্পানি মেগাফোন থেকে। আব্বাসউদ্দীন সাহেব তখন বিভিন্ন গ্রামোফোন কো¤পানিতে সোহরাব হোসেনের গান রেকর্ডিংয়ের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। একদিন তিনি একটা চিঠি দিয়ে সোহরাব হোসেনকে পাঠালেন একজনের কাছে, যিনি সবার কাছে ম্যাগাই ঘোষ নামে পরিচিত। সোহরাব হোসেনে গান শুনে ম্যাগাই ঘোষ তৎক্ষণাৎ কন্ট্রাক্ট সই করিয়ে নিলেন। বললেন, ২৫ টাকা পাবে। গান রেকর্ড হবে সেই আনন্দে সম্মানীর কথা না ভেবে ২৫ টাকাতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এতো কম টাকায় কন্ট্রাক্ট সই করেছেন শুনে আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ক্ষেপে গেলেন। তিনি কবি জসীমউদ্দীনকে নিয়ে ম্যাগাই ঘোষের কাছে গিয়ে বললেন, কন্ট্রাক্টে টাকার অংক কম হয়েছে। এককথায় ম্যাগাই ঘোষ বললেন, গান রেকর্ড করুক, আপনারা যা বলবেন তাই ওকে দেবো।
কলকাতায় তিনি গান শিখেছেন গিরীন চক্রবর্তী ও আব্বাসউদ্দীনের কাছে। আব্বাসউদ্দিন আহমেদের সাহচর্যে সোহরাব হোসেনের কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীতের যে ধারা রচিত হয়েছে, তা আজও পদ্মার ঢেউয়ের তালে তালে প্রবাহিত হচ্ছে এদেশে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
দেশভাগ ও আয়েশতলা ত্যাগ
১৯৪৭ সাল। ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। সোহরাব হোসেনের পরিবার আয়েশতলা গ্রামের সাতপুরুষের ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন সে সময়ের কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমার লোকনাথপুর গ্রামে। চাকরি ও গান-বাজনার জন্য পরিবারের সদস্যদের লোকনাথপুর রেখে ঢাকাতেই থাকতে হয় তাঁকে। পরে অবশ্য সবাইকে নিয়ে আসেন। সেটা অনেক পরের কথা। ঢাকায় তিনি প্রথমে নীলক্ষেত ব্যারাকে এবং পরে চলে যান ৪১ জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে থাকতেন। ওই বাড়িটি ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু এবং আব্বাসউদ্দীনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। বাড়িটির আশপাশে বাইজিরা থাকত বলে খসররু সাহেব ও আব্বাসউদ্দীন আহমেদ সেখানে থাকেননি। ফলে সে বাড়িটিকে মেসবাড়ি বানিয়ে সেখানে সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দিন আহমদ, শেখ লুৎফর রহমান, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান, মমতাজ আলী খান ও শমসের আলী থাকতে লাগলেন। পরে ওস্তাদ মীর কাশেম খান এবং বাহাদুর হোসেন খান এসে যোগ দেন সেখানে ।
সোহরাব হোসেন শুধু শিল্পীই নন
সোহরাব হোসেন শুধুমাত্র একজন শিল্পী হিসেবে বেতার, টেলিভিশন বা চলচ্চিত্রে গান করেননি, তিনি ছিলেন শিল্পী নির্মাণের এক কুশলী কারিগর। ছায়ানট, নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, নজরুল ইনিস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ হিসেবে নিরন্তর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অনেকেই তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে বিদেশে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, জনপ্রিয় হয়েছেন। সেই তালিকা নেহায়েতই ছোটো নয়। সোহরাব হোসেনের গুণী শিষ্যদের সবাই যে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী তা নয়। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ড. সানজিদা খাতুন, আতিকুল ইসলাম, ইসমত আরা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, আবিদা সুলতানা, রেবেকা সুলতানা, রওশন আরা মুস্তাফিজ, শাহীন সামাদ, শবনম মুশতারী, সাবিহা মাহবুব, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, যোসেফ কমল রড্রিক্স, রফিকুল ইসলাম, এম.এ. মান্নান, ডালিয়া নওশীন, খায়রুল আনাম শাকিল, রওশন আরা সোমা, রাহাত আরা গীতি এবং আরো অনেকে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক জয়ী শিল্পী সোহরাব হোসেন। নজরুল সঙ্গীতের বাণী ও সুরের বিকৃতি নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতেন। ভাবতেন কীভাবে এই বিচ্যুতি রোধ করা যায়। এ বিষয়ে সর্বদা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অবশেষে সরকার নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রথম ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘নজরুল-সংগীত স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদ’ গঠন করে। এর সভাপতি হিসেবে নজরুল সঙ্গীতের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বিকৃতি-রোধে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
সোহরাব হোসেন একাধিক স্বর্ণপদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের এম. মিউজ-এর ব্যবহারিক সঙ্গীত বিষয়ের বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে। তবে কণ্ঠমাধুর্য দিয়ে একসময় দেশে-বিদেশে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করা শিল্পীর সে সব গান বেতার বা টিভি যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
নজরুল-দর্শন
১৯৩২ সাল। এক রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে রানাঘাট মহকুমা শহরে আসেন কবি নজরুল। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। লোকজন জোয়ারের মতো ছুটতে থাকে শহর অভিমুখে। সোহরাব হোসেন তখন ৯ বছরের বালক। গ্রামের অন্যান্যের সঙ্গে ছুটে আসেন রানাঘাটে। সেই অনুষ্ঠানে স্বরাজি টুপি-পরা ঝাঁকড়া চুলের নজরুলকে সরাসরি দেখার ও তাঁর কণ্ঠে গান শোনার পরম সৌভাগ্য হয়েছিলো সোহরাব হোসেনের। নজরুল সেদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিলেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি। এই গান যেন সেদিন তাঁর বালক মনের সকল বাঁধন ভেঙে দিয়েছিলো। মুগ্ধ-অভিভূত সোহরাব হোসেন এই গানে অনুপ্রাণিত হয়ে নজরুলের গানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন সেদিনের সেই ভালোলাগা তাঁর সঙ্গীত জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
নজরুল সঙ্গীতের মতো ব্যক্তি-নজরুলেরও একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরাগী ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রায় সম্পূর্ণ সময়ই তিনি নজরুল ভাবনায় কাটিয়েছেন। তিনি যে পুরোই ছিলেন নজরুলময়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় নজরুল-প্রয়াণে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, সেদিন সোহরাব হোসেনের শরীর ভীষণ খারাপ। নজরুলের মৃত্যুর খবর শুনে বিচলিত হয়ে ওঠেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই কবিকে শেষবারের মতো দেখতে বের হন। কিন্তু জনসমুদ্র ভেদ করে অসুস্থ শরীরে কবির নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব হয়নি সেদিন। বেদনামথিত মন নিয়ে ফিরে আসেন। বাসায় এসে আমাকে কাগজ-কলম নিয়ে আসতে বলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম জীবনে যিনি কখনো গান রচনা করেননি, শুধু গেয়েছেন আর কিছু গানে সুরারোপ করেছেন, সেই তিনি তাঁর প্রিয় কবিকে নিয়ে মুখে মুখে একটি গান রচনা করে ফেললেন, আমি তা লিপিবদ্ধ করলাম :
আমার গানের সুরের পাখি
হারায়ে ফেলেছি তাই,
তাই আজ আমি এই সভাতে
বেসুরো গান গাই ॥
বোল ছিল না তার
তবু আশা ছিল ফুটিবার
সেই আশা নিয়ে এতদিন আমি
গান গেয়েছিনু হায় ॥
সে দিলো আমারে ফাঁকি
বলো আমি কিবা নিয়ে থাকি
তাই তার পথ ধরে চলেছি আমিও
যদি তার দেখা পাই ॥
তিনি যখন থেমে থেমে বলছিলেন তখন তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। গান লেখা শেষে হারমোনিয়াম নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সুর বসিয়ে তাঁর ‘গানের সুরের পাখি’ প্রিয় কবির নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন।
শেষকথা
১৯২৩ সালের ৯ এপ্রিল বাংলার সঙ্গীত আকাশে সে তারকার প্রজ্জ্বলন ঘটেছিলো, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তা নির্বাপিত হয়েছে। দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবনে তিনি যে কীর্তি রেখে গেছেন, নজরুল সঙ্গীতের যে আলো ছড়িয়ে এদেশের সঙ্গীত জগতকে করেছেন আলোকময়, তা সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে ও মননে থাকবেন অনেকদিন।
লেখক : বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও সোহরাব হোসেনের কন্যা