ঘোর লাগা ভোর

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

টোকন ঠাকুর, অতিথি লেখক | 2023-08-31 05:39:34

আমি এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল গল্পের পাশে জেগে উঠে ভোর দেখছিলাম। ভোর আমাকে দোর খুলে বাইরে নিয়ে গেল। ভোর আমাকে বড় মাঠের শিশির প্রান্তরে নিয়ে গেল। ভোর, ঘোর উন্মোচন করে দিল। আমি দেখলাম, ঘাসের ওপরে হাঁটতে হাঁটতে পা ভিজে যায়, মাথা ভিজে ওঠে, সমস্ত শরীর ঢেকে যায় কুয়াশায়। কুয়াশা আসে দিগন্তপ্লাবনে। কুয়াশা আসে সুহাসিনী থেকে, সুহাসিনী সেই শহর, যেখানে স্থাপত্য নেই।

সুহাসিনী সে রকম এক শহর, একদিন ছিল, এখন নেই। সুহাসিনী তবে অতীতের বিলুপ্ত নগরী! শুধু এক পরিত্যক্ত রেলস্টেশন- চুপচাপ, স্তব্ধতার রহস্যে রেলস্টেশনটি রোল প্লে করে চলেছে। স্টেশনে যাত্রী নেই, কুলি নেই, স্টেশন মাস্টার নেই, কোনো ওয়েটিং রুম নেই। সমগ্র স্টেশনই একটি শহর হয়ে আছে, খাঁ খাঁ হয়ে মনের মধ্যে ছাপচিত্রের শহর হয়ে আছে।

সেই শহরের ভোর, সেই শহরের ঘোর আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তোলে। ঘোর বলে, আজ তুমি বসে আছ পরিত্যক্ত স্টেশনে, আজ তুমি একা এক যাত্রী। কিন্তু কোনো ট্রেন আসবে না এই স্টেশনে, কোনো শব্দ হবে না, কোনো হুইসেল বাজবে না। তাহলে তুমি কোথায় যাবে? অব্যবহৃত প্লাটফরমে বসে আছ কেন, একা?

দূর থেকে দেখি, কুয়াশায় শাদা হয়ে আছে সমস্ত শহর। এই শহরের নামই সুহাসিনী। সুহাসিনী, তোমাকে আমার মনে পড়ে, একদিন তুমি মুখর মুখর ছিলে। একদিন, তুমি ছিলে অপেক্ষা, ছিলে গগনবিস্তারী রহস্য-বাস্তবতা, শাদা শাদা। আজ ভোর সেই রহস্য-বাস্তবতার সামনে ডেকে এনেছে আমাকে। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভূমি-দিগন্ত আকাশ মিলে মিশে গেছে। বুঝতে পারছি না, এই ঘোর রহস্য বাস্তবতা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়! আমাকে কী কুয়াশা প্রান্তরে বিলীন হতে হবে আজ? ভোর বলল, ঘোর বলল, তুমি বসে আছ, একা। আমি তোমার জন্যই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি আজ, পুব আকাশে আলোর সংকেত।

অবশ্যই এই কুয়াশার মধ্যেই উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকপাখি, পাখিরা কি জানে, আজ তুমি আমার জন্য বসে আছ পরিত্যক্ত স্টেশনে, একা! ঘাসের শিশির জেনেছে, আমি কেন হেঁটে যাচ্ছি পা ভিজিয়ে। আমার মাথায় জমে যাচ্ছে শিশির। আমার সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে হৈম হাওয়ায়। কাঁপতে কাঁপতে, হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে, এক মহাকাল ইতিহাস ভাবতে ভাবতে আমি তোমার কাছে যাচ্ছি। শীত ভোরে তুমি অপেক্ষা করছ আমার, আমি অপেক্ষা করেছি গোটা একটা জীবন। এই জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

চলে এসেছি নদীপাড়ে। এ নদীর নাম কী? নদীর ওপরে এমনভাবে জমেছে কুয়াশা, মনে হয়, নদী বলে কিছু নেই। সবই সমতলের মাটি। মাটি বলে কিছু নেই, শাদা শাদা শূন্যতা। আমি শূন্যতার ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছি বহু পথ, বহু জনপদ। বহু মানুষের সঙ্গে কি আমি কথা বলিনি? বহু মানুষের চোখের দিকে কি আমি তাকাইনি? কিন্তু আমি আজ শুধু তোমার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি, আজ আমি তাকিয়ে দেখতে চাই শুধু একজোড়া চোখ, তোমার চোখ।

তোমার চোখের ভেতর দিয়ে আমি প্রবেশ করতে চাই সেই সময়ের মধ্যে, যেখানে আরও আরও ভোর সব জমে আছে, অজস্র ভোর একত্রিত হয়ে আছে। তোমার চোখের ভেতর দিয়ে আজ আমি ঢুকে পড়ব সেই ভোরসমগ্রে, শুনেছি সেখানে আজও ফাঁকা পড়ে আছে কুঁড়েঘরের রাজপ্রাসাদ, স্বপ্নভূমির অট্টালিকা। আমি সেই স্থাপত্যের ভেতরে ঢুকব। কী দেখব, কী পাব সেখানে?
তার আগে, এখন এই ভোরনদীর কুয়াশার ওপারে যাব কী করে?

ভোরনদী। ভোরমাঠ। ভোরস্টেশন। ভোরশহর। ঘোরশহর। আমি ঘোরশহরের গলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে কাটিয়ে দিয়েছি অনেক বছর। তোমাকে পাইনি। তোমাকে নিয়ে তেপান্তরের ঘোড়সওয়ারে যাব, যাওয়া হয়নি। তোমাকে নিয়ে নদীর ধারে গ্রামীণ মেলায় যাব, যাওয়া হয়নি। আমি সারারাত, অজস্র রাত, আদিগন্ত রাতসহস্র জেগে থেকেছি ভোরে তোমাকে দেখব বলে। ভোরের প্রথম রোদে চিকচিক করে উঠবে তোমার মুখ, আমি সেই মুখ দেখব বলে আমারই চোখের মধ্যে রাতসহস্রের ইতিহাস গ্রন্থনা করেছি। আমি রাত্রির কালো খোড়লে বসে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মতো প্রহর গুনেছি। আমি জানতাম, একদিন অন্ধকার পরাজিত হবে, একদিন অপেক্ষার সমাপ্তি হবে, একদিন ভোর হবে। ভোরের আলোয় তোমাকে দেখব অনেক।

ভোরের শিশিরে তোমাকে নিয়ে হাঁটব বহু দূর। ভোরের রেললাইন আমাদের ডেকে নিয়ে যাবে। আমরা কেবলই সামনে এগিয়ে যাব, পেছনে ফিরব না। মানুষ তো পেছনে ফিরতে পারে না। মানুষের পেছনে ফেরার কোনো রাস্তা নেই। মানুষের কেবল সামনে এগিয়ে চলা। মানুষ ফেরে না। মানুষ শুধু সামনে যায়। সময় শুধু সামনে ধায়।

মানুষই কি সময়? কত জন্ম, কত গ্রহণসাপেক্ষে তবে আজ এই ভোরে আমি শিশিরে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, আমি কিংবা সময় এগিয়ে যাচ্ছি, আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি কালপর্বের একেকটি অধ্যায় : এই মহাশীতকাল পাড়িয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, তুমি এই ভোরে একা অপেক্ষা করছ, সুহাসিনী স্টেশনে। তুমিও কি জেগেছিলে রাত? করেছ প্রতীক্ষা, প্রহরের পর প্রহর, আমার জন্য! সময়ের জন্য! আজ আমরাই সেই সময়। তাহলে সময়ই অপেক্ষা করেছে, সময়ের?

সারারাত ঝরে ঝরে পড়েছে ফুল। টুপটুপ করে ঝরেছে শূন্যতার অশ্রু। ঝিরঝির করে ঝরেছে জলের হিমকণা। শুকনো বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, আমি নদী পেরিয়ে এলাম। পৃথিবীতে এত ভোর আছে, কোনোদিন জানা হয়নি। পৃথিবীতে এত অপেক্ষা আছে, কোনোদিন বুঝতে পারিনি। পৃথিবীতে এত ভালোবাসা আছে, এত ঘোর আছে, এত স্বপ্ন আছে_ কোনোদিন টেরই পাইনি। এখন আমার মধ্যে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছে প্রেম, স্বপ্ন, ছুঁয়ে ফেলার ঘোর। টের পাচ্ছি, ঘোর আমাকে গ্রস্থ করে ভোরবেলা ডেকে নিয়ে এলো, বলল, তুমি একা বসে আছ।

দেখতে পাচ্ছি, মাঠতক শর্ষে ফুলের হলুদ সংসার। কুয়াশার শাদা ভেদ করে হলুদের চিত্রিত লেপন। আমি এই হলুদ মাঠ পাড়ি দিয়ে যাই। মাঠের পরে আরও আরও মাঠ। ইলেকট্রিকের পিলারগুলো স্থির, পাহারা দিচ্ছে সৈনিকের মতো। মাঠের মধ্য দিয়ে চলে গেছে মহাসড়ক। মহাসড়ক আবৃত কুয়াশায়। দূরে, গ্রাম প্রান্তের শ্যামলরেখা আর চোখে পড়ে না। ঝাপসাতিঝাপসা। আমি তবু জানি, আমাকে পৌঁছুতে হবে তোমার কাছে।

তুমি কি জানো, আমি তোমার কাছেই ছুটে আসছি? একমাত্র তোমাকেই পাব বলে আমাকে আজ ঘোরগ্রস্থ ভোর ডেকে নিয়ে এত দূর এই মাঠ পেরুনো মহাসড়কে নামিয়ে দিয়েছে। আর তুমি অপেক্ষা, আর তুমি প্রতীক্ষা, আর তুমি পাবার নেশা, আর তুমি ছোঁবার নেশা, আর তুমি জীবন নেশা, তুমি মরণ নেশার মতো আমাকে টান দিয়ে ঘর থেকে বের করে এনেছ। কী বলব তোমাকে, প্রথম দেখায়?
কেমন আছ?
তুমি এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে সেই কবিতার পংক্তি- 'তোমাকে এমন বিদীর্ণ করল কে?'
বলব, চলো।
কোথায়?
আরও কিছু দূর।
কোন দিকে?
যে কোনো দিকেই।
এখনই? এত ভোরেই?
হ্যাঁ। এই ভোর আমাদের নিয়ে যাবে গগনতলার দিকে, আমরা গগনতলায় যাব। আমরা আকাশের নিচে ছাদ বাঁধন না। আমরা সুহাসিনী স্টেশনের প্লাটফরম থেকে হাঁটতে হাঁটতে আবার বেরিয়ে পড়ব। এবার আর আমি একা নই, তুমিও একা নও। এখন আমরা দু'জন। দু'জনে মিলেই শুধু বহু দূর যাওয়া যায়। দু'জনে মিলেই পাখি হওয়া যায়। দু'জনে মিলেই উড়ে যাওয়া যায়। দু'জনে মিলেই পাহাড়ে যাওয়া যায়। দু'জনে পাহাড়ের চূড়ায় ঘর বাঁধা যায়। দু'জনে মিলে বাঁচা যায়। সব হাহাকার বিদায় হয়ে যায়_ দু'জনে মিলে গেলে। চলো, মিলি আমরা দু'জন।
চলো।
চলো তবে।
কোথায়?
যেখানে মিলেছে নদী, যেখানে মিলেছে ট্রেনলাইন।
ট্রেনলাইন কি মিলেছে কোথাও?
মিলেছে। ঐ যে, দূরে, দেখতে পাচ্ছ না?
চোখের সীমানা নয় তো?
তা কি না তা দেখতে তবে হেঁটে যাই চলো।
তারপর তুমি তাকাবে, আমি দেখব তোমার চোখ। তোমার চোখের ভেতর সেই কুঁড়েঘরের স্থাপত্য।

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাব আমরা। তুমি কি জানতে চাইবে, কেমন করে গেল এতকাল, এমন একাকী? তুমি বুঝতে চাইবে, কীভাবে কাটল এত এত বছর? এত দিন-রাত? নিঃসঙ্গতার মাইল মাইল চরাচরে কেমন লেগেছে একা একা হেঁটে বেড়াতে? নিস্তব্ধতার বিছানায় শুয়ে আমি এত বছর ঘুমিয়েছি কি-না_ তা কি তুমি জেনে নেবে একবার, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে? বহু ধ্বংস, বহু বিপ্লব-বিদ্রোহে ক্লান্ত আমার চোখের মধ্যে যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত, তুমি কি তা এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবে না? তুমি কী আমার খুব কাছে এসে একবার বলবে না, যা হয়েছে আর না, আর কোনো রাত নেই, আর কোনো অন্ধকার নেই, আর কোনো বিভ্রান্তি নেই_ এখন শুধু ভোর!

আমি হাঁটছি তোমার দিকে, এ জীবনে আমার কাটবে না ঘোর!


লেখক: কবি ও নির্মাতা

এ সম্পর্কিত আরও খবর