শ্রীলঙ্কা থেকে: সারি বেঁধে দুধ খেতে আসছে হস্তিশাবরা। যেগুলো বেশি ছোটো সেগুলোর মুখে বোতল পুরে দিচ্ছেন প্রশিক্ষিত কর্মীরা। একটু বয়সিদের দুধ দেওয়া হচ্ছে কর্কে ঢেলে নলের মাধ্যমে। বরাদ্দের সবটুকু এক নিঃশ্বাসে গিলে নিয়ে হস্তিশাবকেরা অনতিদূরে রাখা খাবারের পাত্রের দিকে হাঁটছে। একটা অতি আহলাদী শিশু হাতি এসে তার জন্য বরাদ্দ দুধে সন্তুষ্ট হতে চাইলো না। একটু বুঝি বেশিই খিদে পেয়েছিলো তার। শুঁড় বাড়ালো খাদ্যকর্মীর হাতে ধরা দুধের পাত্রের দিকে। মনে হলো, পাত্রটাই ছিনিয়ে নেবে।
কিন্তু, না। খাদ্য কর্মী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই শান্ত শাবকটা। ঘুরলো। খাবার রাখা পাত্রের দিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে শুঁড় তুলে হাঁক ছাড়লো। অন্যদের যেনো বলতে চাইছে, সব শেষ করে ফেলো না। একটু ধীরে খাও। আমি আসছি।
অবশ্য এর বেশী অস্থির হলো না শাবকটা। সঙ্গীদের সঙ্গে মিলেমিশে খাবারের পাত্রে মুখ নামালো। ওখানকার খাবার শেষ হলে পা বাড়ালো পাশেই ফেলে রাখা ডালপাতার দিকে। যেগুলোর খাওয়া এরই মধ্যে শেষ, তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সেগুন ছায়ার নিচে।
গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে শিশু হাতিদের খাওয়া দেখছিলো ওয়াভাভা। বয়স ১২। সাত ক্লাসের ছাত্র। ডালটুনু থেকে এসেছে হাতি শিশুদের খাওয়া দেখতে। শ্রীলঙ্কার শিক্ষার মান কেমন সেটা তার জড়তাহীন ইংরেজিতেই স্পষ্ট। জানতে চাইলাম, তুমি কি বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারকে চেনো? অবাক করে দিয়ে ওয়াভাভা বললো, মাহমুদ উল্লাহ ইজ এ ভেরি কুল ম্যান।
চমক ভাঙার আগেই ওয়াভাভার পাল্টা প্রশ্ন। তুমি কি করুনারত্নেকে চেনো? হাসারাঙ্গা? শানাকা?
শ্রীলঙ্কান এক শিশুর দেশের প্রতি টান দেখে বিষ্ময় আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। আরও কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে ফের প্রশ্ন ছোঁড়ে ওয়াভাভা। তোমার মায়ের নাম কি?
মা হারা হস্তিশাবকদের খাওয়া দেখতে দেখতে এসে উদাওয়ালাউই এলিফ্যান্ট ট্রানজিট হোমে মনটা ভারী হয়ে ওঠে।
সামনের হস্তিশাবকরা সবাই মা হারা। ২২ মাস গর্ভধারণের পর ওদের জন্ম দেয় মা। জন্মের পরও ওই মা-ই হয় তাদের বাঁচার প্রধান অবলম্বন। বাবার কাছে সাপোর্ট পায় না মোটেই। মা ছাড়া একদিনও টিকতে পারে না। ২/৩ ঘণ্টা পরপর মুখে পুরে মায়ের ওলান। মা ছাড়াও বোন, দাদির মতো আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটায়। মানবশিশুর মতোই মা ছাড়া অচল ওরা। ঘাস চিবিয়ে খাওয়া শিখতেই বছর চারেক সময় লেগে যায়।
দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। খায়। ঘুমায়ও গলাগলি করে। শীতের রাতে গায়ে গা ছুঁয়ে ওম নেয়। গরমে জলাশয়ে নেমে শান্তি খোঁজে। গায়ে কাদা মেখে গরম কমায়।
মা ছাড়া বনের ভেতর খুবই অসহায় ওরা। শিশুবয়সে হাতির মৃত্যুর হার খুবই বেশি। ওদের কথা চিন্তা করেই ১৯৯৫ সালে শ্রীলংকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় এই এলিফ্যান্ট ট্রানজিট হোম। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন এটি পরিচালনা করছে। দিনে সাত দফা এখানে দুধ খাওয়ানো হয় হস্তিশাবকদের। যখন ওরা নিজে নিজে খাবার খুঁজে নিতে শেখে, তখন আবার বনে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
আরও পড়ুন:সিংহ পাহাড়ে কশ্যপের কান্না
এই এলিফ্যান্ট ওয়াইল্ড লাইফে হস্তিশাবকদের খাওয়া দেখতে আসা মানুষের টিকিটের অর্থ এদের জন্যই ব্যয় করা হয়। এলা থেকে ক্যান্ডি, বা ক্যান্ডি থেকে এলা শহরে ঘুরতে যাওয়া ট্যুরিস্টরা খানিক থেমে খাওয়া দেখে যায় এদের।
একটা হাতি বিষয়ক মিউজিয়ামও আছে। নান্দনিক এই জাদুঘরের দেওয়ালে ধাপে ধাপে হাতির জীবনচক্র, পরিচিতি, খাদ্যাভ্যাস, চরিত্র চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলা। সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিবরণ। এই জাদুঘর ঘুরে গেলে যে কেউ হাতি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান পেয়ে যাবেন।
জাদুঘরের সামনের চত্বরে বসার জন্য যেসব বেঞ্চ পাতা, সেগুলোতেও হাতির ডিজাইন। অতিকায় একটা হাতির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে মানুষের নিষ্ঠুরতা ঘোষণা করছে। তার গায়ে এখনও একটা বুলেট। মানুষকে শিক্ষা দিতেই ওই বুলেট যেখানে বিঁধেছিলো সেখানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। এই শিক্ষা নিতে পারলেই মঙ্গল।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন।
আরও পড়ুন: বন পাহাড়ের কোলে