(পূর্ব প্রকােশর পর)
বিপ্লবীদের বিপ্লবগুরু বিবেকানন্দের এমন গভীর সংহতির পরিচয় আমরা আরও বহুভাবে পাব। বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ ঘোষ ১৯০১ সালে বরোদা থেকে যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছোটভাই বারীনকে কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ১৯০২ সালে বাংলার প্রথম বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অন্যতম প্রেরণা ছিলেন বিবেকানন্দ। অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, হরিকুমার চক্রবর্তী থেকে সুভাষচন্দ্র বসু পর্যন্ত সকলে তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন।
যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’তে অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মূর্তি গড়া হয়েছিল, অভিষেক হয়েছিল বঙ্কিমবাবুর ছাঁচে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল বিবেকানন্দের অগ্নিমন্ত্রে।’
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বামীজীর যে অবস্থান তা তিনি নানা প্রকারে জানান দিয়েছিলেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে মহারাষ্ট্র কেশরী বাল গঙ্গাধর তিলক বেলুড় মঠে এসে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করেন। স্বামীজী তাঁকে বলেন, ‘বাহুবল ছাড়া ব্রিটিশকে ভারত থেকে উৎখাত করা যাবে না এবং তা-ই করতে হবে।’
স্বামী পূর্ণাত্মানন্দের গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারছি, তিনি লিখেছেন, ‘‘স্বামীজী প্রথমবার বিদেশ থেকে আসার পর একদিন স্বামী শুদ্ধানন্দকে (ব্রহ্মচারী সুধীর) বলেন, ‘দ্যাখ, আমি বিদেশে বোমা বানানো শিখে এসেছি। আমি যদি বোমা বানিয়ে দিই, তোরা তো লাটসাহেবের বাড়িতে ফেলে আসতে পারবি? স্বামী শুদ্ধানন্দকে স্বামীজী কথাগুলি রহস্য করে বলেছিলেন কিনা তা অবশ্য জানি না।’’
ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠীর লেখায় প্রকাশ, ‘‘ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় বিপ্লব-প্রচেষ্টার ওপর রাওলাটের সিডিশন কমিটি যে বিখ্যাত রিপোর্ট ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে লিখেছিলেন, আমরা এখন তার উৎস ও আকর জানতে পারছি। বাংলার ক্ষেত্রে এফ. সি ড্যালি জে. সি. নিকসন, জে. ই আর্মস্ট্রং এল. এনবার্ড এবং এইচ. এল সলকল্ডের প্রতিবেদনে বার বার বলা হয়েছে, বিপ্লবীদের আখড়া অনুসন্ধান করে তিনটি বই পাওয়া যাচ্ছে-‘গীতা, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, এবং স্বামী বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’।’’
‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি যা বিপ্লবীদের অবশ্যপাঠ্য এক গ্রন্থ হয়ে উঠেছিল, এই গ্রন্থের কি এমন অমিত তেজোদীপ্ত ভাষ্য, যার জন্য বিপ্লবীদের প্রেরণার মন্ত্র হয়েছিল এটি? যুবসমাজের জেগে উঠার বাণী বহন করা স্বামী বিবেকানন্দের এমন বহু গ্রন্থের কথাই আমরা জানি।
আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দ: বিপ্লব ও নবজাগরণের মহান উদগাতা
‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের কয়েকটি লাইন উল্লেখ করলেই এই অমিত তেজের খানিক টের পাওয়া যাবে বৈকি? স্বামীজী লিখছেন, ‘হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসত্ত্বসুলভ দুর্ব্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এই মাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে? এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্য স্বাধীনতা লাভ করিবে? হে ভারত ভুলিও না-তোমার নারী জাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী; ভুলিও না-তোমার উপাস্য উমানাথ সর্ব্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না-তোমার বিবাহ, তোমার জীবন, ইন্দ্রিয়সুখের-নিজের ব্যক্তিগত সুখের-জন্য নহে, ভুলিও না-তুমি জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলি প্রদত্ত, ভুলিও না-তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না-নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমারই ভাই। হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল-আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই; বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমি ক’টিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল-ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ইশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্দ্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ , আর বল দিন রাত, ‘হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে , আমায় মনুষ্যত্ব দাও, মা, আমার দুর্ব্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।’’
কেবল বিপ্লব প্রচেষ্টাতেই তিনি তাঁর চিন্তা বা দর্শনকে আবদ্ধ রাখেননি। দেশগঠনেওে তিনি সমানভাবে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের তাগিদও তাঁর কণ্ঠে সমানভাবে উচ্চারিত হত। এর পরিচয় আমরা পাব বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে।
আরও পড়ুন: ঢাকা সফরে বিপ্লবীদের যা বলেছিলেন বিবেকানন্দ
আমরা জানতে পারছি, ১৪ জুলাই ১৮৯৩। জাপানের ইয়োকোহামা বন্দর থেকে ‘এম্প্রস অব ইন্ডিয়া’ জাহাজ-এ বিবেকানন্দ যাত্রা করেছেন শিকাগোর পথে কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের উদ্দেশ্যে। তাঁর পাশেই সহযাত্রী ছিলেন জামশেদজি টাটা। স্বামীজী টাটাকে বলেছিলেন, ‘‘জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রি করে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য দস্তুরী পাও মাত্র। এর চেয়ে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে এবং দেশের টাকা দেশেই থাকবে।’’ -টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডমেন্টাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠার মূলেও স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাই কাজ করে সে কথাও এর প্রতিষ্ঠাতাদের কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হয়েছে।
বাংলা ও বাঙালি তথা অখণ্ড ভারত গৌরব, আমাদের নবজাগরণের মহান উদগাতা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের যে পরম্পরা তা আমাদের যুব সমাজের অপরিহার্য পাথেয় হয়ে উঠুক। সমস্যা সঙ্কুল, স্বার্থপরতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত সমাজে নির্বাসিত দেশপ্রেম ও মানবিকতাকে ফের আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে প্রোথিত করতে একজন বিবেকানন্দই পথপ্রদর্শক হোক, এই প্রত্যাশা। (সমাপ্ত)
(১২ জানুয়ারি ২০২৪, ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঢাকায় আয়োজিত ভারতের যুব দিবস ও স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ সেমিনারে প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত)
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও বার্তা২৪.কম’র পরিকল্পনা সম্পাদক