ঢাকা সফরে বিপ্লবীদের যা বলেছিলেন বিবেকানন্দ
(পূর্বপ্রকাশের পর)
স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে সম্বল করে উত্তর প্রজন্মের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হাতে অজস্র বীরপুরুষের আগমন ঘটেছিল। তাদেরই একজন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তারুণ্যের নবউদ্দীপনা ও জাগরণের যে মন্ত্র তিনি বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করে সমগ্র ভারতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন তার ভিত্তিভূমিতে ছিল স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন।
বিবেকানন্দের ব্যবহারিক কর্মাদর্শকে সম্বল করেই এক বত্তৃতায় সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ভারতে আজ আমরা কর্মযোগের দর্শন চাহি। আমাদের বর্তমান যুগের সহিত সামঞ্জস্য করিয়া বাঁচিতে হইবে। আমরা সর্বদ্বাররুদ্ধ কোণে বাস করিতে পারিব না। যাঁহারা আধুনিকতার মোহে অতীত একেবারেই বিসর্জন দিতে চান, আমি তাহাদের দলে নহি। অতীতের ভিত্তির উপরই আমরা দাঁড়াইব। ভারতের যে বিশিষ্ট শিক্ষা-সভ্যতা, তাহাকে তাহার অশেষ ধারার মধ্যে দিয়াই পরিপুষ্ট করিতে হইবে। এক কথায় আমরা অতীত ও বর্তমানের মধ্যে প্রচীন শিক্ষা-সভ্যতা ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিব। সমগ্র জগতে আমরাই সেই মহাসমন্বয়সাধনের সর্বাধিক যোগ্য পাত্র। এই মহাকার্যে ইতিমধ্যেই আমাদের কতিপয় শ্রেষ্ঠ মনীসী ও কর্মী আত্মনিয়োগ করিয়াছেন।’’ (সূত্র: বিবেকানন্দে উদ্ভাসিত সুভাষচন্দ্র -শঙ্করীপ্রসাদ বসু)
সুভাষচন্দ্র-কথিত উক্ত ‘কতিপয়’ এর অগ্রণী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ-যিনি প্রচণ্ড কর্মদর্শনের প্রবক্তা, প্রাচ্যের আধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বস্তু-বিজ্ঞানের সমন্বয়প্রয়াসী, এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন পরিবেশে রজোগুণ বৃদ্ধির পক্ষে জোরালো প্রচারক।
যুবজাগরণে এই দুই মহাজীবনের (বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র) আদর্শিক ঐকতানের উল্লেখ করে নান্দা মুখার্জী তাঁর Vivekanada’s Influence on Subhas’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, `The Spirit of Youth has found most profound and powerful expression in the lives of Swami Vivekananda and Netaji Subhas. They understood the true significance of youth and realizing the tremendous potentialities of Youth-Power both Swamiji and Netaji pinned their hopes in the youths of country. To inspire our youth they practiced what they preached. They spoke more in deeds than in words. That is why their words have acquired added meaning and significance.’’
বহু মহৎপ্রাণ বিপ্লবী ও দেশনেতার প্রেরণা হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ কিভাবে ধরা দিয়েছিলেন তা আমরা দেখব সাধক গবেষক জয়ন্ত চৌধুরীর ভাষ্যে। তিনি তাঁর ‘নেতাজীর চোখে স্বামীজি’ শীর্ষক এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানের দুর্গম পার্বত্য মরু, বিপদ সংকুল সমুদ্রের অতলে ডুবোজাহাজে কিংবা ইম্ফল কোহিমার রণাঙ্গণে অকুতোভয় সুভাষ থেকে নেতাজিতে উত্তরণের প্রেরণা ও চেতনায় ধারণ করেছেন, লালন করেছেন বিশ্ববিবেকের বীর বাণীকে। তাই তো তিনি বলতে পারেন, ‘বিবেকানন্দ সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলেই আমি আত্মহারা হয়ে যাই, …আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বলে গেলেও সেই মহাপুরুষের বিষয় কিছু বলা হবে না, এমনি ছিলেন তিনি মহৎ, এমনি ছিল তাঁর চরিত্র-যেমন মহান তেমনি গভীর। আজ তিনি বেঁচে থাকলে আমি তাঁর চরণেই আশ্রয় নিতাম ‘’
ড. চৌধুরী আরও লিখছেন, ‘সারাজীবন কেন সুভাষ মননে, চেতনে রামকৃষ্ণ-বিবেকান্দময়তা? এর উত্তর খোঁজে পাওয়া যায় পরিণত বয়েসে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ‘ভারতপথিক’র অকপট ভাষণে।
সুভাষচন্দ্র লিখছেন, ‘‘অবশ্য শঙ্করাচার্যের আদর্শকে নিজের জীবনে অনুসরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি-রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনাদর্শই এক্ষেত্রে আমার কাছে অনেক সহজ এবং বাস্তবপন্থী বলে মনে হত।’’
নিমাই ভট্টাচার্যের ‘বিপ্লবী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থেও আমরা ঔপনিবেশিক বিটিশ শাসনের উৎখাতে বিপ্লবীদের প্রেরণা হিসেবে বিবেকনন্দের ভূমিকার উল্লেখ পাব।
শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের পর বিবেকানন্দ মাদ্রাজে পৌছলে তাঁকে যে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়, সেখানকার শেষ সংবর্ধনায় স্বামীজী ‘ভারতের ভবিষ্যত’ নিয়ে দীর্ঘ ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুবশক্তিকে জেগে উঠার আহ্বান জানান।
ঐ ভাষণে বীরেশ্বর বিবেকানন্দ বলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের গরিয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হউন। অন্যান্য অকেজো দেবতা এই কয়েক বৎসর ভুলিলে কোন ক্ষতি নাই। অন্যান্য দেবতারা ঘুমাইতেছেন; তোমার স্বজাতি এই দেবতাই একমাত্র জাগ্রত; কোন অকেজো দেবতার অন্বেষণে তুমি ধাবিত হইতেছ, সেই বিরাট উপাসনা করিতে পারিতেছ না?’’
আমরা যদি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্য করি তবে দেখব বিবেকানন্দের স্বাধীনতার প্রেরণামন্ত্র কিভাবে আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবিত করছে। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবি যার জন্য কবিকে জেলে যেতে হয়েছিল সেই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র কথা উল্লেখ করা যায়। যেখানে কবি বলিষ্ঠ ভাষায় লিখেছেন, ‘আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলায় মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাড়াল/দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কবে সর্বনাশী?’’
মাদ্রাজে সংবর্ধনায় অকপট বিবেকানন্দ বলেন, ‘পরাধীন জাতির কোন ধর্ম থাকতে পারে না, একমাত্র ধর্ম হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জন।’
১৯০১ সালের ১৯ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ ঢাকা সফরে এসে বিপ্লবীদের যে প্রেরণামন্ত্র শুনিয়ে যান তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা সফরে একাধিক আলোচনায় যাঁরা তাঁর প্রত্যেকটি বক্তৃতা শোনেন, তাদের মধ্যে মহাবিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষও ছিলেন। স্বামীজী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, গুয়াহাটি ও কামাখ্যা রওনা হবার দু’একদিন আগে শ্রীশচন্দ্র পাল, আলিমুদ্দিন আহমেদ ও আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হেমচন্দ্র স্বামীজীর সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাতে ‘কিছু ধর্ম-উপদেশ’ প্রার্থনা করেন।
জবাবে স্বামীজী বলেন, ‘‘ধর্ম-উপদেশ। পরাধীন জাতির কোন ধর্ম থাকতে পারে নাকি? এখন একমাত্র ধর্ম হচ্ছে শক্তিশালী হয়ে বিদেশী শোষকদের তাড়ানো। তারপর আমার কাছে আসিস ধর্মের কথা শুনতে। প্রাণচঞ্চল তরুণ বাংলার এখন সর্বাধিক প্রয়োজন শরীর গঠনের ও অকুতোভয় দুঃসাহসিকতার-‘শরীর আদ্যম খলু ধর্মসাধনম্’। শারীরিক সামর্থের স্থান সর্বাগ্রে-এমন কি গীতা পড়ারও আগে স্থান দিতে হবে।’ (ক্রমশ:..)
আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দ: বিপ্লব ও নবজাগরণের মহান উদগাতা
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম