আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ভাষার মাস শেষে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো রক্তঝড়া মার্চ। আমাদের পাকি বেড়ি ছিন্ন করে স্বাধীন জাতিতে পরিণত হওয়ার মাস। যদিও শেষ দখলদার বর্বরদের বিদায় করে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে হয়েছে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস ধরে পাক জেনোসাইডের সব রকম ঘৃণা পন্থার শিকার হয়ে। আত্মদান করতে হয়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। তবে সেই ইতিহাস নিয়ে কথা হবে অন্য পরিসরে।
আজ আমাদের আলোচনায় থাকবে ভাষার মাস। বিশেষ করে এই মাসকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠা ভাষার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এই মাসের দুই বিশেষ অনুষঙ্গ একুশে এবং বইমেলা সম্পর্কে কিছু মূল্যায়ন।
বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এর জাত্যাভিমান দোষে দুষ্ট পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী ও তাদের বাঙ্গালী দালালেরা এদেশে এক নব্য উপনিবেশবাদী শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা করে। তুলনামূলক খর্বকায়, তাদের তুলনায় মলিনবরণ, তাদের বিবেচনায় মছলিখোর দুবলা বাঙ্গালী জাতিকে পদানত রাখার প্রচেষ্টায় তারা প্রথম আঘাত হানলো শত সহস্র বছরের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার উপরে। তাদের পরিকল্পনা নেহায়েত কাঁচা ছিল না। ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে বহু জাতিকে নিশ্চিহ্ন বা পদানত করার ইতিহাস সর্বজনবিদিত। মায়া, আজটেক, ইনকা, চাম্পা, আসিরিয়ান, খারেজম, সিন্ধু সভ্যতা আজ কোথায়?
পাক শাসকগোষ্ঠী শতকরা ছাপ্পান্ন শতাংশ জনগণের মাতৃভাষা, সমৃদ্ধ বাংলাকে কোণঠাসা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করল এবং এই বিষয়ে রইল অনমনীয়। পাঁচ বছর দীর্ঘ অনুনয় বিনয়, যুক্তিতর্ক প্রদর্শন, আন্দোলন সংগ্রাম সব বিফলে। ফুঁসে উঠলো বাঙ্গালী জাতি। ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাস্তা পাক পুলিশি জুলুমের মুখে পিছু না হটে বুকের রক্তে রাঙিয়ে দিলো বীর বাঙালী। পিছু হটলো পাক জান্তা সরকার। বাংলা ভাষা পেলো অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। তমদ্দুন মজলিস, সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ সহ অন্যান্য দলের নেতৃত্বে এবং জব্বার, রফিক, সফিউর, বরকত, সালাম প্রমুখ বীরের জীবনের মূল্যে ‘একুশ’ হলো বাঙালীর গৌরবের প্রতীক। পরের বছর থেকেই এই তারিখটি পালিত হতে থাকল ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে। গাফফার চৌধুরীর লেখা ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুর দেয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ গানটি হয়ে উঠল এউ দিনটির প্রতীক। আপামর বাঙালির গান। এরপর থেকে পাক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলন ও প্রতিবাদ প্রেরণা পেয়েছে একুশে থেকেই। এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যোদ্ধা ও আপামর বাঙালি একুশের বিজয় থেকে উৎসাহ ও প্রেরণা নিয়ে এগিয়েছি।
সম্প্রতি একুশে দিনটি পেয়েছে বিশ্বজনীনতা। কানাডার ভ্যাংকুভার প্রবাসী কিছু বাংলাদেশী ও তাদের ভিন্ন ভাষাভাষী সঙ্গীরা মিলে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড (MLLW)’ নামে এক সংগঠনের তরফ থেকে ১৯৯৮-এ জাতিসংঘে প্রস্তাব আনেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরবর্তী কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের শরিক হওয়া ও নেতৃত্ব দেয়া এই প্রচেষ্টাকে ফলবতী করে। ১৯৯৯ এর ইউনেস্কো পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্যারিসে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সকল সদস্যদের রাস্ট্র ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এই দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য পৃথিবীর সকল মানুষের নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণের ও চর্চার অধিকার রয়েছে। প্রতিটি প্রচলিত ও জীবিত ভাষাকে উপযুক্ত ভাবে সন্মান ও সংরক্ষণ করতে হবে। পৃথিবীতে আনুমানিক ৭০০০ ভাষা এখনো জীবিত। পরিচর্যার অভাবে ১৫০০ ভাষা হারিয়ে গেছে। আর একটি ভাষাকেও হারাতে দেয়া হবে না। ভাষার সাথে সাথে হারিয়ে যায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, পৌরাণিক গাঁথা। এক কথায় পৃথিবী বঞ্চিত হয় আংশিক ঐতিহ্য থেকে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের একুশে জাতীয় ভাষা শহীদ দিবস ছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশাল এক গর্বিত ভূমিকার অধিকারী।
এবারে আসা যাক একুশের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ বইমেলা প্রসঙ্গে। একুশে আর বইমেলা বাঙালী মানসে একাকার হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত হয়ে গেছে ভাষার মাস হিসেবে। এই মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ভাষা শহীদ স্মরণ, জাতীর চেতনা শাণিত করা, ইদানিং যোগ হওয়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালা এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য পর্যালোচনা মূলক সভা সেমিনার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হয় ঘটা করেই। একই মাতৃভাষার ভাগীদার হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যার অংশবিশেষ ও পিছিয়ে থাকে না। সারা বিশ্ব ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষি জনগণও এই মাসটিকে বিশেষ মর্যাদা দেন। এতক্ষণ যে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চেয়েছি, সেটা হলো বইমেলা। বাংলাভাষা নিয়ে আপামর বাঙ্গালির আবেগ, ফেব্রুয়ারি ও তার আগে পরে সুবিধামত সময়ে শহরে শহরে বইমেলার আয়োজন এবং বইমেলাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজনের দিক দিয়ে বিশ্বে আমরা অগ্রগণ্য।
যদিও বইমেলার ইতিহাস বহু পুরনো। জানা যায়, প্রায় পাঁচশত বছর আগে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে প্রথম বই মেলার আয়োজন হতে থাকে। তখনও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। প্রচন্ড পরিশ্রম করে হাতে খোদিত বা লিখিত হতো তখনকার প্রকাশিত পুঁথি পুস্তক। জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা তখনও থেমে ছিল না। ছিল পরিশ্রমসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজানুগ্রহ ও ছিল আবশ্যিক। যাহোক, সেই Frankfirter Buchmesse আজও পৃথিবীর বৃহত্তম বই মেলা হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছে।
প্রতি বছর পাঁচ দিনের জন্য এই মেলা হয়। প্রথম তিন দিন প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের অনুষ্ঠান। শেষ দুইদিন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইউরোর সন্মানি গুনে সকল পুস্তকপ্রেমীরই প্রবেশাধিকার থাকে এই সন্মানজনক মেলায়। জানা যায়, প্রায় আট সহস্রাধিক ছাপা, অনলাইন এবং অন্যান্য মাধ্যমের প্রকাশনার সাথে জড়িতরা এই মিলনমেলায় অংশ নেন। প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই চান জীবনে বার বার না হলেও অন্ততঃ একবার ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় হাজির হতে। তবে আমরা আবার ফিরে আসব বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হওয়া বইমেলার ইতিবৃত্ত নিয়ে।
এই বছরে আমাদের সুযোগ হয়েছে দু’দেশের (বাংলাদেশ ও ভারত) চারটি বইমেলায় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যোগ দেয়ার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত পাক জেনোসাইডের একটি স্পর্শকাতর অংশ নারীদের উপর পরিকল্পিত যৌন নির্যাতন ও যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে চর্চা হয়নি বললেই চলে। জেনোসাইডের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদা ও সন্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এই বিষয়কে উপজীব্য করে আমার স্ত্রী অঞ্জনা দত্ত সম্প্রতি একটি বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এই চটজলদি ভ্রমণ। এই চার জায়গায় কি দেখেছি, তা সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাই। আমার কোনও কোনও মন্তব্যে কেউ কেউ কুপিত হতে পারেন, সেজন্য আগেই ক্ষমাপ্রার্থী। কলকাতা ও ঢাকা বইমেলার ব্যাপ্তি কাছাকাছি রকম বলেই আমার মনে হয়েছে। দু’জায়গাতেই আনুমানিক আটশ’র মতো স্টল ছিল।
তবে আনুষাঙ্গিক আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কলকাতায় ছিল অনেক বেশি। দর্শনার্থীদের কলকাতায় হাটতে হয়েছে কম। গোটা দশেক প্রবেশ/নির্গমন পথ ছিল। সেক্ষেত্রে ঢাকায় ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনটি ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে একটি। খাবার স্টলের প্রাচুর্যে ঢাকা ছিল অনেক এগিয়ে। আবার বই বিক্রির দিকে কলকাতা আমার চাক্ষুষ মতে বেশ এগিয়ে ছিল। কলকাতার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন আমার দৃষ্টিতে চমৎকার গোছানো ছিল। অন্যান্য দেশের স্টলও প্রতিবারের মত এবারও দেখেছি। আমার মতন ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষকের মতে বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমাদের বইমেলাকেও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা উচিৎ। সংরক্ষণ বাদ উন্নতিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে না।
এবারে আসি তুল্যমূল্য আর দুটি বইমেলা প্রসঙ্গে। চট্টগ্রাম ও আগরতলা। দুটোতেই শ'দুয়েক করে স্টল ছিল। নান্দনিকতায় এবং সৌকর্যে আগরতলা বইমেলাকে আমি অনেকটাই এগিয়ে রাখব।দুই জায়গায়ই শহরের কেন্দ্র স্থল থকে যাতায়াতের সমস্যা ছিলো। চট্টগ্রামের নতুন ভেনু শিরিষতলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে আগরতলার সমমানের একটি নান্দনিকতাময় বইমেলা উপহার দেয়া খুবই সম্ভব ছিল। ‘মেলায় যাইরে...’ জনতার সংখ্যা দুই জায়গায়ই কাছাকাছি রকমের বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার আগরতলার জনসংখ্যা চট্টগ্রামের এক চতুর্থাংশের বেশি নয়।
এই বইমেলাগুলোকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ লিট ফেস্ট জাতীয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলে তা মুদ্রণশিল্প, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। ভবিষ্যতে এই মেলাসমূহের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বিশেষ করে এই সময়কে কেন্দ্র করেই বাংলা ভাষাভাষী সব জায়গায়ই ছোট বড় অনেক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। শিলচর, গৌহাটি, বর্ধমান, কুচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ধানবাদ সহ অন্য অনেক জায়গায় মেলা ইতোমধ্যেই হয়েছে বা শিগগিরই হতে যাচ্ছে। আমরা আমাদের প্রাণের বইমেলার ও আমাদের মায়ের ভাষার সমৃদ্ধি কামনা করি। বই হোক নিত্যসঙ্গী।
লেখক: প্রাবন্ধিক, পরিব্রাজক