বইয়ের দোকানে লক্ষ্য ঠিক করে খুব কমই গিয়েছি আমি। সুযোগ পেলেই বাংলামোটোর হয়ে শাহবাগ বা নিউমার্কেট এরিয়ার গ্রন্থবিতানগুলোতে এত ঢুঁ মারা হয়, প্রত্যেকবার লক্ষ্য ঠিক করে রাখা সম্ভব না আসলে। এই ব্যাপারটার মধ্যে চাপা উত্তেজনা আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছু বই একেকবার হাতে চলে এসেছে, সেসব পাঠান্তে আমি আমার নিরুদ্দেশ ওইসব ভ্রমণকে গোপনে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
এভাবেই কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুরে ছোট্ট বইটার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। শেলফে ঘুমিয়ে ছিল। হাতে তুলে নিতেই যেন সে জেগে উঠল করতলে, আঙুলের ফাঁকে। বিড়বিড় করলাম, ‘অদ্ভুত তো, ছায়া হারিয়ে ফেলা এক লোকের গল্প। নাম ‘ছায়াবিহীন’। ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়া এক জার্মান নভেলা পিটার শ্লেমিল (Peter Schlemihl)। লেখক আডেলবার্ট ফন শামিসো। ইংরেজি অনুবাদ থেকে সেটি বাংলায় নামিয়েছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।
আকারে ছোট হলেও উপন্যাসিকাটির বিষয়বস্তুকে কেন জানি না, খুবই ভারী বলে মনে হলো আমার। কিন্তু ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তির নেশাধরানো আমন্ত্রণ খুব বেশিদিন এড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। এক উইকেন্ডের রাতে বইটা নিয়ে বসে গেলাম।
আমাদের নায়ক পিটার শ্লেমিল জাহাজে চেপে নতুন এক শহরে হাজির হয়েছে যেখানে সে তার ভাগ্যকে বাজিয়ে দেখতে চায়। সম্বল সামান্য একটা ব্যাগ, অল্প কিছু অর্থ। ভাঙাচোরা সস্তার একটা সরাইখানায় সে আশ্রয় নিল।
খুঁজে পেতে যার সন্ধান সে বের করতে চাইল, তিনি শহরটির অন্যতম ধনী ব্যক্তি মিঃ জন। শহর থেকে একটু দূরে এক জমকালো বাড়ি আর পাহাড়ী গোলাপবাগানে লোকটিকে খুঁজে পেল পিটার। মান্যগণ্য পুরুষেরা মিঃ জনকে ধন্য ধন্য করছে। সুন্দরীরা তার সঙ্গ পাবার জন্য আকুল। এসবের মাঝখানে নিজেকে খুবই বেচারা, অসহায় আর অনাহুত মনে হলো তার। কিন্তু মিঃ জন হতাশ করলেন না, যেহেতু তার সম্পদের কোনো কমতি নেই, আশ্বাস দিলেন যে পিটারের ব্যাপারটা দেখবেন তিনি।
আরো পড়ুন ➥ প্রেম ও পুরুষের পৃথিবীতে
এই ধনী লোকদের আসরের মাঝখানেই ধূসর কোট পরা লম্বা এক লোককে ঘুরে বেড়াতে দেখল পিটার শ্লেমিল। ব্যাখ্যার অযোগ্য তার ক্ষমতা, সন্দেহজনক তার আনুগত্য ও বিনয়। যে যা চাইছে, নিজের কোটের পকেট থেকে সে জিনিসটাই নিমেষে তাকে বের করে দিচ্ছে লোকটা। সামান্য একটা কোটের পকেট থেকে এত কিছু কিভাবে বের হচ্ছে, পিটার ভেবে বের করতে পারল না। এক সময় ব্যাপারটা তার সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে ওখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানে কাজ মনে হলো। আর তখনই সেই রহস্যময় লোক আচমকা পথ আঁটকে দাঁড়াল, ব্যাপারটা যেন এরকম, ‘আরে যাচ্ছেন কোথায়? আপনার সঙ্গেই তো আমার আসল কারবার।’
কী এই আসল কারবার?
লোকটি পিটারকে বলল যে তার ছায়াটি বড় চমৎকার, অমূল্য। এমন নিখুঁত ছায়া পৃথিবীতে খুব অল্প মানুষেরই হয়। পিটার যদি ছায়াটি বিক্রি করতে রাজি থাকে, খুব যোগ্য বিনিময় দিতে রাজি আছে সে। এই কথা বলে কোটের পকেট থেকে সে বের করল এমন এক থলি, যা থেকে অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা বের হয়।
দরিদ্র্য পিটার শ্লেমিল হতভম্ব হয়ে গেল এই কাণ্ড দেখে। একটা সামান্য বিনিময়ে ওই অসম্ভব ঐশ্বর্যের খনি? কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগলেও লোকটির প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। বিক্রি করে দিল নিজের ছায়া।
এই ঘটনার পর থেকেই আসলে শুরু হলো তার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত আর অস্তিত্ব সংকটে ধুকে ধুকে কাটাবার পর্ব। শ্লেমিল শব্দটা হিব্রু, এর অর্থ হলো হতভাগ্য। যে লোকের ছায়াই নেই, সে কিভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে?
শুরুতেই বলেছি, এই গল্পের উৎসবিন্দু হচ্ছে ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তি। ফাউস্ত ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু জ্ঞানের অসীম তৃষ্ণা মিটছিল না তার। সুতরাং, শয়তান এসে তাকে দেখা দিল আর দিল বিচিত্র এক প্রস্তাব। ফাউস্ত শয়তানকে নিজের আত্মা বিক্রি করলেন, বিনিময়ে পেলেন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান আর অফুরান ধনসম্পত্তি।
এই এক জার্মান উপকথা গোটা ইউরোপে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে আছে চিরকাল। ক্রিস্টোফার মারলো থেকে গ্যেটে থেকে টোমাস মান, ফাউস্তের ট্র্যাজেডি নানাভাবেই রিক্রিয়েট হয়েছে সাহিত্যে। আরো হয়তো হবে এবং হচ্ছেও।
আরো পড়ুন ➥ সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি
কিন্তু পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে মনে হলো, নিজের আত্মজৈবনিক হতাশাকে ধরে রাখতে শামিসো কি ফাউস্তের চেয়ে জবর কোনো টুলস আর খুঁজে পেতেন? সেই অমোঘ নিয়তির মতো বই পড়তে পড়তে লেখকের ব্যক্তিজীবনে ডুব মারার বিরক্তিকর স্বভাবটা মুহূর্তেই আমাকে আচ্ছন্ন করল। সব লেখকের ক্ষেত্রে এমনটা না হলেও রচনায় লেখকের নিজস্ব যাপনের কিছু কিছু ছায়া তো থেকেই যায়, এমনকি অন্যদের জীবনকে নিজের জীবনের মতো করে গল্প তৈরির ক্ষমতাও থাকে একজন শক্তিমান রচয়িতার।
পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে এই দুটি ব্যাপারই আবিষ্কার করলাম। পিটার একজন বাস্তব মানুষ, আর আডেলবার্ট ফন শামিসোকে মূলত নিজের দুর্ভাগ্যের কাহিনী সে শোনাচ্ছে, এমন কয়েকটা দৃশ্য আছে গল্পটিতে। এমনকি পিটারের স্বপ্নে ফন শামিসোকেও আমি দেখতে পাই, কাচের জানালার ওপাশে শামিসোর টেবিলে একটা বই এবং নিশ্চিতভাবেই বইটা গ্যেটের লেখা ফাউস্ট।
আডেলবার্ট ফন শামিসো এক এরিস্টোক্র্যাট ফরাসি পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব চলছে যখন, ১৭৯০ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে বালক শামিসোকে পাড়ি জমাতে হইয়েছিল জার্মানিতে। ফরাসি হয়েও জার্মানিতে বসবাস আর জার্মানিতে থেকেও তারা যে ফরাসি, এই ব্যাপারটা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারতেন না।
এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৭৯৮ সালে নিজের জন্মভূমি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আশ্রয়দাতা জার্মানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল তাকে। যদিও জার্মানির লোকজন তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছিল, শামিসো ভাবতেন যার দেশ নেই, তার কি কোনো অস্তিত্ব আছে? জাতীয়তাবাদের এক গর্বোদ্ধত যুগে তার সাবকনশাসে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাকে ভয়ানক এক ক্ষত হিসেবেই অনুমান করা যায়। পৃথিবীর সকল মানুষই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক, আর এই দেশ ধারণাটি তাকে পৃথিবী থেকে বড় দূরে সরিয়ে দেয়। তার মনে সংকট তৈরি করে। এমনকি দেশের মাঝে যে ছোট ছোট দেশ, সেসব স্থানে বেঁচে-বর্তে থাকা লোকজনও এ সংকট থেকে মুক্তি পায় না।
পিটার শ্লেমিলের ছায়াহীনতাকে মূলত লেখকের বিপন্ন অস্তিত্বের রূপকই মনে হয় আমার। আমি পড়িও সেটা ধরে নিয়েই। অর্থবিত্তের অভাব না থাকলেও সমাজ যখন দেখে শ্লেমিলের ছায়া নেই, তখনই তাকে আর মেনে নিতে পারে না। তার জীবন হয়ে ওঠে একজন পলাতকের জীবন। দিনের আলো যে ভয় পায়, রাতের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে চায় না। প্রতি মুহূর্তে আত্মপীড়ায় নিজেকে সে রক্তাক্ত করে।
এই দুর্দশার মধ্যেও শ্লেমিল কিন্তু খুঁজতে থাকে সেই ধূসর কোট পরা লোকটিকে। সে এই করুণ জীবন থেকে পরিত্রাণ চায়, অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে লাভ কি যদি তার ছায়াই না থাকে? বহুদিন পার হলে অবশেষে লোকটি আসেও। তবে নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে। নিজের বহু মূল্যবান ছায়াটি পিটার ফেরত পেতে পারে, কিন্তু এবার বিনিময় হিসেবে লোকটি চায় তার আত্মা।
এবার সে কী করবে? ফাউস্টের মতো সেও কি তার আত্মা বিক্রি করে দেবে? যেন চাইলেই ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন লেখক শামিসো, কিন্তু এতদিন যে দেশ তাকে আশ্রয় দিল, তার সঙ্গে করতে হবে বেঈমানী!
বইটির ন্যারেটিভ খুবই সমান্তরাল। একটা মোক্ষম শুরু এবং অভাবনীয় সমাপ্তি আছে। সেই সমাপ্তি উন্মুক্ত। যেন আরো বিচিত্র সব অভিযানে অংশ নেবার জন্য পাঠককে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। লেখক ও বৃক্ষবিদ ফন শামিসো তার কাহিনীতে যে কল্পনা ও উপকথার মিশেল ঘটিয়েছেন, তাকে জাদুবাস্তবতার আদিকাণ্ড হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়।
নিজে সমাজের যেই অংশের প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের সম্পর্কে শামিসোর মনোভাব স্বস্তিকর কিছু ছিল না, তিনি ভাবতেন এরা সবাই মূলত শয়তানের কারবারি, আর সাধারণ মানুষেরাও যে ধনীদের স্তুতি করত তা কেবলমাত্র সম্পদের লোভেই। শহুরে মানুষের এই দুই শ্রেণী কেউ কাউকে বিলং করে না কিন্তু একে অন্যকে ছাড়া টিকতেও পারে না, এ ব্যাপারটিকেও বিদ্রুপের কাঁটায় তিনি হয়তো বিদ্ধ করতে চেয়েছেন।
তবে এভাবে না দেখে, এমনকি যে পাঠক শামিসোকে চেনেন না একদম, কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই পিটার শ্লেমিলকে পড়ে নিতে পারেন।
অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসতে চাওয়া জীবনের এক অপূর্ব গল্প এটি। যেখানে আছে শয়তানের ধোঁকা, ফরচুনেটাসের থলি যার ভিতরে হাত গলিয়ে দিলেই মেলে মুঠো মুঠো সোনার মোহর, আজব পাখির বাসা যা মাথায় দিলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়, সপ্তসিন্ধু জুতো যা পায়ে দিলে অনবরত ঘুরে বেড়ানো যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চোখের পলকেই। আর চূড়ান্তভাবে আছে অশুভের বিরুদ্ধে মানবাত্মার সেই চিরায়ত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে জিতে গেলেই মুক্তি মিলতে পারে, হেরে যায় শয়তান, আত্মার যেই মুক্তির কাছে পৃথিবীর সমস্ত ধন-সম্পদ তুচ্ছ। কিন্তু এই জিতে যাওয়াটা কি সম্ভব?
কতভাবেই না একটা বই লেখা যেতে পারে, আর বিচিত্র পাঠক কতভাবেই না সে বইটি পড়তে পারেন।