অনুবাদ আলম খোরশেদ
মার্কিন মিশনারি, নার্স ও অনুবাদক জিনি লকারবি ১৯৬৩ সাল থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও সেখানকার দুস্থ ও বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে, আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল নয়মাসকাল ধরে তিনি একেবারে অগ্নিগিরির মাঝখানে বসে, একজন সংবেদনশীল প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে অবলোকন করেন সাধারণ বাঙালিদের সীমাহীন দুর্দশা, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম বীরত্ব ও দেশপ্রেমের দৃশ্য। তাঁর সেইসব অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কিছু ব্যক্তিগত বয়ানও তিনি লিখে রেখেছিলেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, তাঁর বিদ্যোৎসাহী মায়ের অনুপ্রেরণায় এবং প্রত্যক্ষ সম্পাদকীয় সহযোগিতায় তিনি On Duty In Bangladesh: The Story The Newspapers Didn’t Publish নামে এই স্মৃতিকথাটি রচনা করেন, ১৯৭৩ সালে যা যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্য থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে দেশে ও বিদেশের আরো একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থের Joi Bangla At last অধ্যায়ের শেষাংশটুকু এখানে বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো।
বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের আগমন-সংবাদে সয়লাব হয়ে গেল রেডিও। আমাদের মতো আমেরিকানদের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। এখন এমনকি সবচেয়ে অনুগত বন্ধুরাও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। তাদের মতে, স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসাবে খ্যাত আমেরিকা, বাঙালিদের প্রয়োজনের মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেবল বাঙালিদের স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতেই অস্বীকার করেনি, উল্টো তার শত্রুদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিয়েছে, যা তারা বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি। এবং ভারত যখন এই হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে এগিয়ে এলো, তখন আমেরিকা তার বিরুদ্ধে পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিল! আমেরিকা-বিরোধী মনোভাব আর কখনোই এতটা তীব্র ছিল না।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভারতে মার্কিন সাহায্যসংস্থার পরিচালক এবং বর্তমানে প্রিন্সটনের উড্রো উইল্সন স্কুল অভ পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারনেশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ডিন জন পি. লুইস নিউ ইয়র্ক টাইম্স পত্রিকায় লিখেছেন: সাম্প্রতিক পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অথচ সরল এক নৈতিক সংকটের সময় আমরা ভুল শিবিরের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে সক্ষম হয়েছি, এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ক্ষুদ্র একটি সামরিক স্বৈরাচারীর পক্ষাবলম্বন করছি।
ব্রিটেনে রক্ষণশীল পত্রিকা লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ ওয়াশিংটনকে অভিযুক্ত করে লিখেছে: একটি মারাত্মক রকম কূটনৈতিক ব্যর্থতা, যার সমতুল্য কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঘটনার পূর্বাপর বিষয়ে অবগত, পূর্ব পাকিস্তানে বাস করা আমেরিকান নাগরিক হিসাবে আমরা, বাঙালিদের যৌক্তিক দাবির প্রতি আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখি।
ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার সকালে আমরা রেডিওতে শুনি, জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানের বিশেষ দূত ভুট্টো, নিরাপত্তা পরিষদের সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, তাঁর দেশকে কেউ সাহায্য করছে না বলে। ঢাকা যখন ভারতের কব্জায় চলে যাচ্ছে তখন এই ‘ঢিলেমির’ তীব্র নিন্দা করেন তিনি। কয়েকদিন ধরে বিমান ও ভূমি থেকে নিয়মিত আক্রমণের পর সকালটিকে কবরস্থানের মতো শান্ত লাগছিল। শহরে থেকে-যাওয়া অল্প ক’জন বিদেশি ব্যবসায়ীদের একজন আমাদের কুশল জানতে আসেন। তিনি ওই দিনগুলোতে রেড ক্রসের সঙ্গে কাজ করছিলেন বলে, ভারী বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত বন্দর এলাকার লোমহর্ষক উদ্ধারকর্মের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাদের। অনেক জাহাজেই নাকি সরাসরি আঘাত লেগেছিল এবং এমনকি কিছু বিদেশি জাহাজকে ডুবিয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল।
রিড ও আমি যে কোনো উপায়েই হোক রেড ক্রসের কাজে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমরা জেনেছি যে, শহরের একমাত্র পশ্চিমা ধাঁচের হোটেলের ম্যানেজার, এর দরজা খুলে দিয়েছেন রেড ক্রসের জন্য, তাদের যে কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করতে। তিনি কেবল জনসেবাই করছিলেন না, কেননা একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসাবে তিনি জানতেন, শহরের সবচেয়ে বড় দালানটির মাথায় ওড়া রেড ক্রসের বিশাল পতাকাটির পক্ষেই একমাত্র তার এই হোটেলটিকে রক্ষা করা সম্ভব। আমাদেরকে বলা হয়, আমরা পুরো আপৎকালীন সময়টা সেখানে বিনেপয়সায় থাকাখাওয়া করতে পারি। (মাথার ওপর যুদ্ধবিমানদের অনুপস্থিতি জনসাধারণের স্বস্তির কারণ না হয়ে, আরো খারাপ এক যুদ্ধের—চট্টগ্রামের রাস্তায় রক্তাক্ত সম্মুখসমরের ইঙ্গিত দিচ্ছিল বুঝি বা।) আমরা রেড ক্রস কর্তৃপক্ষকে এই সুসংবাদের জন্য ধন্যবাদ দিই, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিই, আমাদের মেয়েরা সম্ভবত ঘরের ওল্টানো আসবাবের তলাতেই বেশি ভালো থাকবে, হোটেলে আশ্রয় নেওয়া আটকেপড়া জাহাজের নাবিক আর বিচিত্র জনতার সান্নিধ্যের চেয়ে।
সেই বিষ্যুদবারের পড়ন্ত বিকালে জনৈক নিকটবর্তী প্রতিবেশি চিৎকার করে আমাদের দুই আঙিনার মধ্যবর্তী দরজাখানি খুলে দিতে বলে। সে গুজব শুনেছে যে, ঢাকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে, যার ফলে এখানে শেষ মরণপণ লড়াই শুরু হতে পারে। তেমনটি হলে তারা যেন তাদের নারী ও শিশুদের এখানে পাঠিয়ে দিতে পারে।
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনার সংবাদটা আমি নিজের কাছেই রাখি, আমি চাইনি একটা গুজবের ওপর ভর করে মেয়েদের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দিতে। রিড আসা মাত্রই আমি তাকে সেই প্রতিবেশির বাড়িতে পাঠিয়ে দিই সে আসলে কতটা জানে দেখার জন্য। তারপর আমরা রেডিওর শরণাপন্ন হই তার কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য। তবে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার আগ পর্যন্ত আমরা সরাসরি কিছুই জানতে পারি না, যখন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন: ঢাকা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী। তাদের এই বিজয়ের মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই।
মেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
খোকা ঈশ্বরের বন্দনায় মেতে ওঠে এবং প্রার্থনার নেতৃত্ব দেয়।
রিড ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সযত্নে লুকানো একটি বাক্স থেকে লাল সবুজ আর সোনালি রঙের বাংলাদেশের পতাকা বার করে আনে। আমরা নিষিদ্ধ বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিই এবং পতাকাটিকে সম্মানজনক এক জায়গায় উত্তোলন করি।
টুকরোটাকরা খবরগুলো সব জোড়া লাগিয়ে আমরা জানতে পারি যে, দুপুর সোয়া বারোটায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই খবরটা চট্টগ্রাম পৌঁছাতে দেরি হয় কেননা সপ্তাহের শুরুর দিকে ভারতীয় বোমারু বিমান শহরের একমাত্র অবশিষ্ট বেতার সঞ্চালন স্থাপনায় আঘাত হানে। তারা যে সেটা ইচ্ছা করে করেছিল তা নয়; আসলে তাদের কাছে খবর ছিল রেলওয়ের কোনো এক বাড়িতে নাকি সৈন্যরা ঘাঁটি গেড়েছে। তারা সময়মতো সরে গিয়েছিল, কিন্তু বিমান আক্রমণে চট্টগ্রামের বাইরে যোগাযোগের সব সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায়।
পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসাররাও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৌলতে যুদ্ধবিরতির কথা জেনে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণার খবরও পায় যে, পূর্ব পাকিস্তান এখনো পাকিস্তানের অংশ হয়েই থাকতে চায়। তিনি এও বলেন যে, যুদ্ধ জারি থাকবে—একটি পরাজয়ে গোটা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয় না।
অনেকেই তাঁর উপদেশ শুনে সারা রাত ধরে সশব্দ যুদ্ধ চালিয়ে গেল। রাত ভোর হলো কান্না, চিৎকার, গুলির শব্দ আর আগুনের আভায়। আমরা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না সেটা যুদ্ধের দামামা নাকি বিজয়ের উল্লাস ছিল, তাই শেষবারের মতো টেবিল আর বসার ঘরের ওল্টানো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিই।
সকাল দশটার মধ্যে গোটা শহর যেন উদ্দাম হয়ে ওঠে। সবাই ততক্ষণে যুদ্ধবিরতির সত্য সংবাদটা জেনে ফেলেছে। শূন্য ও নিষ্প্রাণ রাস্তাগুলো যেন প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে ফের। হঠাৎ করেই সবকটা রাস্তাই যেন লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এতদিন অলস বসে থাকা গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি সব বয়সের লোকভর্তি হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। মেয়েরা মুখের পর্দা সরিয়ে নাচতে শুরু করে পথে নেমে। প্রত্যেকেই জয় বাংলা বলতে বলতে গলা ভেঙে ফেলে।
আর তখনই এলো পরিত্রাতা তথা ভারতীয় বাহিনী। ট্রাকের পর ট্রাক যাচ্ছিল আর রাস্তায় সারবেঁধে দাঁড়ানো বাঙালিরা উল্লাস করছিল, কাঁদছিল আর হাত নাড়ছিল তাদের প্রতি। কোনো সাহসী সৈন্য গাড়ি থেকে নামামাত্রই স্থানীয় লোকজন তাকে ঘিরে ধরছিল, সামান্য একটু ছুঁয়ে দেখতে, কথা বলতে আর ধন্যবাদ দিতে। মানুষের মনোভাবের এই পরিবর্তনটুকু ছিল রীতিমতো নাটকীয়। বাচ্চারা যারা মিলিটারি পোশাকপরা কাউকে দেখলে পালিয়ে বাঁচত তারাই এখন গিয়ে তাদের কোলে উঠছে। নারীদের দেখা হচ্ছিল শ্রদ্ধার চোখে। এটাই মুক্তি, আর বাঙালিরা তার স্বাদ নিচ্ছিল প্রাণভরে।
কবিদের ডাকা ‘সোনার বাংলা’র আকাশে বাতাসে তখন কেবল “জয় বাংলা” ধ্বনি।