মনুষ্যত্বের দাফন-কাফন ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৃতত্ত্ব

বিশেষ রচনা, শিল্প-সাহিত্য

সরওয়ার মোরশেদ | 2023-08-31 20:15:09

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ভারতে রেল যোগাযোগ প্রবর্তনের প্রথম দিকে সুন্দর একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ট্রেনের আকৃতি আর সর্পিল চলন দেখে বিহ্বল স্বদেশিদের তন্ময়তা আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাব কাটাতে তিনি লিখেছিলেন ‘বাষ্পীয়রথে কিভাবে আরোহণ করিতে হইবে’ শীর্ষক রচনাটি।

গত দিন কয়েক ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি করোনায় মৃতদের লাশ নিয়ে সারাদেশে এক ধরনের বিশ্রী অবস্থা বিরাজ করছে। মুর্দার দাফন কাফন নিয়ে একশ্রেণীর মনুষ্যত্বের দ্বিপদীর বর্বর অবস্থান। এই করোনা উপদ্রুত করুণ উপকূলে আচার্যজী থাকলে হয়তো লিখে ফেলতেন ‘করোনায় লোকান্তরিতগণের কিভাবে সৎকার করিতে হইবে’ শিরোনামীয় প্রবন্ধ। আচার্য দেহ রেখেছেন সেই কবে! রসায়নশাস্ত্রীর অনুপস্থিতিজনিত শোককে শক্তিতে পরিণত করে নাহয় অধমই চেষ্টিত হই কষ্টিত জাতিকে পথ দেখানোর!

২.
কদমরূপী করোনা ‘পদ্মবনে মত্তহস্তী’র মতো তামাম জাহান পদপিষ্ট করছে। এই Microbial Marco Polo এখন আণুবীক্ষণিক চেঙ্গিস খাঁনে পরিণত হয়েছে। আর আমরা বাংলার বীর পুঙ্গবরা রূপ নিয়েছি পলাশীর সিরাজের বাহিনীতে—বিনা জঙ্গে সূচাগ্র মেদিনী না, পুরো বুখারা-সমরকন্দ-ইস্পাহান-সিরাজ ইস্তক লন্ডন-প্যারিসও দিয়ে দিতে রাজি আমরা। তাইতো পারিবারিক বন্ধনদর্পী রঙ্গস্নাত বঙ্গসন্তানগণ লাশ ফেলে পালাচ্ছে, মৃতের অমর্যাদা করছে আর অনেক জায়গায় দাফন কাফনে বাধা দিচ্ছে। এমন ঘোর অমানিশার কালেও চাল নিয়ে চালবাজি করা কুম্ভীলককূলকে প্রতিহত না করে আমরা অলোকদৃষ্ট সাহস দেখিয়ে রুখে দিচ্ছি নিরীহ মুর্দার দাফন কাফন!

কাজেই এখন Grave question হলো, মৃতদের সৎকার কে, কিভাবে করবে? সহজ সমাধান হবে একটা Dying industry দাঁড় করিয়ে ফেলা। একখানা Mortician squad গঠন করা। ‘Ashes to ashes’-এ বিশ্বাসী থেকে শুরু করে Green good bye দিতে ইচ্ছুকসহ সবার জন্য এরা গ্যাঞ্জামবিহীন, Tailor-made চিরবিদায়ের আঞ্জাম দেবে। মৃতের পরিবারকে শুধু সেবাটা কড়ি দিয়ে কিনতে হবে, এই যা। লাশ নিয়ে ভাবনা, আর না, আর না!

৩.
চলুন, আমাদের হঠাৎ ব্যক্তি হতে নৈর্ব্যক্তিক লাশে অবনমিত দেহত্যাগকারীদের শব নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে জগৎ সংসার তন্ন তন্ন করে না খুঁজে একটু সাধারণ পর্যটন করে আসি।

হাওয়াই দাফন (Sky burial)


নামেই এই পদ্ধতি স্বব্যাখ্যাত। পৃথিবীর ছাদে অর্থাৎ তিব্বতে আকাশী সৎকার অনুসৃত হয়। লামার অনুসারীরা তাদের শবগুলোকে অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর রেখে আসে যাতে ঈগল, বাজ প্রভৃতি পাখি নরমাংস ভক্ষণ করে জটরানন্দ লাভ করে। তাদের বিশ্বাস, শব দিয়ে উদরপূর্তি করে এসব বিহঙ্গ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে মৃতের আত্মাকে স্বর্গে পৌঁছে দেবে!

জলজ সমাধি (Burial at sea)

অনেক ধীবর বা সমুদ্রতীরবর্তী জনগোষ্ঠী তাদের মৃতদের সমুদ্রেই সমাধিস্থ করে। এ পদ্ধতি আবার মার্কিনীদের হাতে আধুনিকায়িত হয়েছে। ওসামা বিন লাদেনসহ অনেককে স্যামচাচার পালোয়ান পোলাপানরা মাছের পেটে চালান করে দিয়েছে। তাই এটা খাঁটি পেন্টাগন অনুমোদিত পদ্ধতি!

মহাশূন্যে সমাধিস্থকরণ (Space burial)

এটা সবচে আধুনিক, পরিবেশ-বান্ধব আর কিউট একটা পদ্ধতি। এখানে রকেটের মাধ্যমে মৃতদেহকে কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করা হয়। এতে মরহুম একবারে যাকে বলে Body and soul একসাথে নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। ‘পাখি উড়ে যায়, রেখে যায় পালক’ জাতীয় দীর্ঘশ্বাসের উর্ধ্বে এই মহাত্মাগণ। শুনলে ভশ্চার্য হবেন, এ পর্যন্ত সার্ধশত মহাজন Space burial লাভে ধন্য হয়েছেন।

জাপানি উচ্চ প্রযুক্তির সমাধিস্থকরণ

এটা জাপানের Dying industry’র নবতম সংযোজন। জাপানের শব ব্যবস্থাপনা শিল্প ইতোমধ্যে উচ্চ প্রাযুক্তিক সুবিধাসম্পন্ন Alternative Graveyard দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এই ডিজিটাল গোরস্থানে ব্যাংকের লকারে যেভাবে সোনাদানা রাখা হয় সেভাবেই LED বুদ্ধমূর্তির ভিতরে মৃতের ছাই রাখা হয়। অনেক বাহারি ডিজাইনের, বাহারি রঙের মূর্তি বাছাই করার সুযোগ আছে গ্রাহকদের। মনে করেন, আপনার প্রিয় মানুষটির জন্য আপনি গোলাপী রঙের LED মূর্তি পছন্দ করলেন। তাহলে আপনি যখনই আপনার আপনজনের ডিজিটাল গোরস্থানে যাবেন, আপনার ক্লায়েন্ট কার্ডটি পাঞ্চ করে ভিতরে ঢুকলে হাজারো মূর্তির ভেতর থেকে আপনার মৃত প্রিয়জনের বুদ্ধ মূর্তিটি গোলাপী রঙের আভা ছড়িয়ে আপনাকে অভিবাদন জানাবে। এই গোরস্থান এতই হাইটেক যে, এখানে তারা আপনার সুবিধার জন্য হাওয়াই বন্দরের অনেক সুবিধা যেমন Conveyor belt ইত্যাদির ব্যবস্থাও রেখেছেন। তাই, Death is a high-tech trip in Japan's futuristic cemeteries!

দক্ষিণ কোরীয় পদ্ধতি

If Japan comes, can South Korea be far behind? মোটেই না। দক্ষিণ কোরিয়ার Burial Company-গুলো জাপানিদের সাথে রীতিমত টেক্কা দিচ্ছে। তাদের Death Bead Company-র এক CEO ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র ৯০০ ডলারে আপনাকে তসবির দানার মতো গোল্লায় পরিণত করে কাঁচের আধারে পুরে বাড়িতে প্রিয়জনদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। আপনজনদের কাছে ‘আবার আসিবেন’ ফিরে হয়তোবা ইনসান নয়—লাল, নীল হরেক কিসিমের পুঁতির দানার বেশে। আপনার ওয়ারিশগণ কাচবন্দী আপনাকে সকাল, বিকাল দেখবে, অনুভব করবে, অভ্যাগতদের দেখাবে ‘দানাদার’ আপনাকে। আপনি আবার কাচের ঘর থেকে ঢিল ছুঁড়বেন না যেন!

বায়োডিগ্রেডেবল পদ্ধতি

এটা হাড়ে হাড়ে Pro-Green লোকজনের সৎকারের আদর্শ পন্থা। Biodegradable Method-এ পরিবেশ-বান্ধব উপাদান যেমন শক্ত কাগজ, বোর্ড ইত্যাদির তৈরি একটা ভস্মাধারে, যাকে Bios Urn বলা হয়, চাইদের (Big fries) ছাই রাখা হয়। টবের ভিতরে পুষ্টি উপাদান-পুষ্ট মাটির মাঝখানে আগে থেকে গত ব্যক্তির পছন্দের গাছ বা ফুলের বীজ পুঁতে রাখা হয়। পরে সে বীজের উপরে রাখা হয় শরীর-ভস্ম। মৃতের দেহাবশেষ থেকে পুষ্টি নিয়ে অচিরেই জগৎ সংসারে উঁকি মারবে দেহত্যাগীর প্রিয় উদ্ভিদ। মনে করেন, কোনো Big man-এর বেটির মাথায় লাল গেন্ধা ফুল বাইন্ধা দেয়ার মহতেচ্ছা আপনার ছিল, সে আকাঙ্ক্ষা-পাদপে আপনার হয়ে যে কেউ আপনার ভবসাগর পাড়ি দেওয়ার পরও ফুল ফোটাতে পারবে। ইহধাম ত্যাগ করার পরও আপনি মানুষ নয়, হয়তোবা গেন্ধা-গোলাপ হয়ে কোনো কামিনীর কেশপাশ শোভিত করছেন! কী বিপুল, বিশাল সুখ!

ক্রিপোপ্রিজারভেশন

আপনি যদি নেক্টার পান না করেও অমরত্ব লাভের আশা জিইয়ে রাখতে চান, যদি আপনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষা-জারিত আদমী হয়ে থাকেন, তাহলে দেরি হওয়ার আগেই Alcor Life Extension Foundation-এর সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার ট্যাকে পর্যাপ্ত টাকা থাকলে তারা নাই-হওয়া আপনাকে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে রাখবে। ফলে, আপনার দেহে পচন ধরবে না। আপনি হয়ে যাবেন লেনিন-মাওয়ের Comrade in corpse! Cryonics practitioner-রা একিন রাখেন যে, ভবিষ্যতে উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে এই মহাত্মাদের পুনর্জীবিত করা যাবে। Doomsday পর্যন্ত ইন্তেজারের খামোখা কী প্রয়োজন!

৪.
এ লেখার শুরুতে কলোনিয়াল ভারতবাসীর লৌহ ঘোটক (Iron horse) অর্থাৎ রেলগাড়ি দেখে হতবিহবল অবস্থার প্রেক্ষিতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বাষ্পীয় রথে কিভাবে আরোহণ করিতে হইবে’ শীর্ষক লেখাটার উল্লেখ করেছিলাম। আসলে, নুতন যে কোনো কিছুর প্রতি মানুষের ভয়-সান্দ্র সন্দেহ চিরন্তন। যেমন, একই প্রসঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় ব্রিটেনের কিছু কিছু জায়গার অধিবাসীদের প্রতিক্রিয়া স্মর্তব্য। প্রথম ট্রেন চলার পর বেশ কিছু জায়গার ইংরেজগণ এ বলে প্রবল আপত্তি উত্থাপন করেন যে, রেলের হুইসেলের বিকট শব্দে তাদের ঘোড়া-গরু-ছাগল ভয় পাচ্ছে। এমনকি Stockton-Darlington Train Service (1825) উদ্ধোধনের দিন মজমা-মচ্ছব দেখতে আসা বেশকিছু লোকজন ট্রেনের কুউউ-ঝিকঝিক ভীমনাদে ভয়ে রীতিমতো মুর্চ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন!

করোনার নিষ্করুণ আঘাতে আমাদের অবস্থাও অনেকটা তথৈবচ। কিন্তু ট্রেন যেমন এখন মানুষের যাপিত জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, করোনা-চাপিত (Covid-induced) নতুন শব ব্যবস্থাপনাও নিশ্চয়ই এক সময় আমাদের গা এবং গাঁ সওয়া হয়ে যাবে। এই জাগতিক রঙ্গমঞ্চে, শ্রীযুক্ত হেরাক্লিটাস ঠিকই বয়ান করেছেন, পরিবর্তনই একমাত্র স্থায়ী কুশীলব। একই নদীর জলে আপনি কি দুইবার পদসিক্ত করতে পারেন?

এ সম্পর্কিত আরও খবর