কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৩)

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

জিনি লকারবি ।। অনুবাদ : আলম খোরশেদ | 2023-09-01 20:36:23

জিনি লকারবি ১৯৭৩ সালে On Duty in Bangladesh: The Story The Newspapers Didn’t Publish, বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অনন্য অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান মিশনারি, চট্টগ্রামে সেবিকার দায়িত্ব-ব্রত নিয়ে এসেছিলেন আটলান্টিকের ওইপার, সুদূর আমেরিকা থেকে। মিশে গিয়েছিলেন এই দেশের মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত দুঃখ-বেদনা-আশার সাথে। তাদের সঙ্গে একজন বিদেশি হয়েও তিনি একইরকমভাবে চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা।

তখন কী প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি সেখানে? প্রত্যক্ষ করেছিলেন, নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বস্ব-ত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা এক জাতিকে। বইটিতে এসেছে ভুখা-নাঙ্গা, প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার তবুও বাংলা ভাষাকে নিয়ে গর্ব করা ও লকারবির ভাষায়, “কবিস্বভাবের” মানুষগুলোর যাতনার অবসানকল্পে সূর্যের মতো জ্বলে ওঠা এক নেতার নেতৃত্বের কথা—তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন এমন অনেককিছু, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আরো গভীরভাবে জানতে-বুঝতে সাহায্য করে।

গত ১২ মে ২০২০ থেকে অনুবাদক, সমালোচক ও শিল্পসংগঠক আলম খোরশেদের অনুবাদে বইটির বাংলা অনুবাদ, “কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা” বার্তা২৪-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এবং ১৬ মে ২০২০ তারিখে সবশেষ দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয়। বিদ্যমান লকডাউন পরিস্থিতি ও এরইমধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতরের বিশেষ আয়োজন-সংক্রান্ত ব্যস্ততার কারণের জন্য কিছুটা বিরতি নিয়ে ধারাবাহিকটির তৃতীয় কিস্তি আজ (৫ জুন ২০২০) প্রকাশিত হলো। এখন থেকে সপ্তাহে দুদিন, প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার অনূদিত বইটির নতুন কিস্তি প্রকাশ হবে। - বিভাগীয় সম্পাদক


যে-ঈশ্বর সবই দেখেন

[পূর্ব প্রকাশের পর] ১৯৭১-এর গোড়ার মাসগুলোতে আমাদের মিশনের কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের চারটি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে আমরা একে অপরের অবস্থা বিষয়ে জানতে উন্মুখ হয়ে পড়ি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তিনজন বাচ্চা ও আমরা পাঁচজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলাম। আমাদের অবস্থান থেকে পঁয়ষট্টি মাইল দক্ষিণে মালুমঘাটের মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে ঊনিশজন বয়স্ক ও ছাব্বিশটি বাচ্চা ছিল। ধীরগতির দেশি নৌকায় আর ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় আটঘণ্টার দূরত্বে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তে, হেব্রনে আমাদের জঙ্গলবাড়িতে ছিল আরেকটি দম্পতি ও তাদের দুই বাচ্চা। অন্য দিকে, বরিশালের দুর্গম এক শহরে, যেখানে আমাদের প্রাচ্যভাষা ইন্সটিটিউটটি অবস্থিত ছিল, সাতটি বাচ্চা ও আটজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিল। আমাদের সবচেয়ে বেশি চিন্তা ছিল এদের নিয়েই, কেননা তারাই আমাদের সবচেয়ে নবীন কর্মীদল। পরে, তারা যখন তাদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছিল, তখন আমাদের নতুন করে মনে হয়েছিল, ঈশ্বর সবচেয়ে প্রবীণ মিশনারিটির চেয়েও হাজার গুণে ভালো যত্ন নিতে পারেন তাঁর সেবকদের।

“আমরা সমস্যার প্রথম ইঙ্গিত পাই,” উত্তর মিশিগান থেকে আগত পয়লা মেয়াদের মিশনারি ড. জো ডিকুক বলেন, “যখন ফেব্রুয়ারি মাসে ডাক ধর্মঘট শুরু হয়। এতে বরিশালে যারা ছিল তারা কেবল বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নই হয়ে গেল না, আমাদের মিশনপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের পথও গেল বন্ধ হয়ে।

আমরা আমাদের ভাষা শিক্ষকদেরও মধ্যে, বিশেষ করে যারা হিন্দু ছিলেন, তুমুল উৎকণ্ঠা লক্ষ করি। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের দিকে তাঁরা উত্তেজনা ও অস্থিরতার কারণে পড়াতেই পারছিলেন না আর।”

“যেহেতু দেশব্যাপী ডাকধর্মঘট সফল হয়ে গেল, আমাদের মনে হলো এরপর শুরু হবে পরিবহন ধর্মঘট। তাহলে তো আমরা বরিশালেই আটকা পড়ে যাব। মার্চের ৮ তারিখের মিশন ফিল্ড কাউন্সিল মিটিংয়ের জন্য আমরা ৫ তারিখে চিটাগাং যাওয়ার জাহাজের সিটের বুকিংও দিয়ে রেখেছিলাম।”

“তবে মার্চের ১ তারিখেই ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন এবং সারা দেশ জুড়ে ভয়ানক বিক্ষোভ শুরু হয় তার ফলে। ক্ষমতাসীন সরকার শহরে ও বন্দরে নানারকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাঙালিরা দপ্তরের কাজ এবং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে অস্বীকার করার মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানায়।”

“তাতে করে তখনকার মতো স্কুল কর্মকাণ্ডও শেষ হয়ে যায়! ৫ তারিখ সকালে জাহাজ আদৌ ছাড়বে না ভেবে, আমরা বরিশাল পরিত্যাগের অন্য উপায়ের খোঁজখবর নিতে শুরু করি। উত্তরমুখী সড়ক ধরে ঢাকা যাওয়া যায়, কিন্তু পথে চওড়া এক নদী পারাপারের ফেরি পড়বে, কিন্তু যেহেতু সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সেই ফেরি আদৌ ছাড়বে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যে-ট্রেন চলে সেগুলোও চলছে কিনা কে জানে? যে-কোনো অবস্থাতেই হোক ট্রেনস্টেশন পর্যন্ত যেতে হলেও তো আমাদেরকে নৌকা কিংবা স্টিমার ধরতে হবে। তবে এগুলো চালু থাকলেও, পনেরোজনের এত বড় দল ও মালপত্র নিয়ে, আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত একটি দেশের মহাসড়ক ধরে ঢাকার পথে যাত্রা করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। আমরা কোনো ব্যক্তিগত বাহনও পাচ্ছিলাম না, এমনকি দাঁড়টানা কোনো নৌকাও নয়, যেটা আমাদেরকে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে পারে।”

“একটা জাহাজ অবশ্য বরিশাল থেকে ঢাকা যাচ্ছিল মাঝেমধ্যে, আটকেপড়া বিদেশিদের নিয়ে, কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার কোনো উপায় জানা ছিল না আমাদের। আর সেই জাহাজ চড়ে বসা মানে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য সম্মত হওয়া, যেটা চাচ্ছিলাম না আমরা কেউই। দেশের বাইরে গেলে আমাদের অনেকেরই আবার ফেরত আসার ভিসা ছিল না। মার্চের ৫ তারিখে মাত্র আধাঘণ্টার নোটিশে ভাষাশিক্ষার জন্য আসা অন্য ছাত্ররাও সব চলে যায়। (আমরা অবশ্য জানতামই না যে তখন ঐ জাহাজটি ছেড়ে যাচ্ছিল, সেটা পরের দিনই কেবল জানতে পারি আমরা।”)

ড. ও মিসেস ডিকুকের একটা ধারণা হয়েছিল, তাঁদের সব জিনিসপত্র ৫৫ গ্যালনের ড্রামে ভরে, যেনবা তাদেরকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এমনভাবে মুখ আটকে দেবার সময় এসে গেছে। তাঁদের সেই ‘অনুভূতি’টা প্রায় দৈব বলে প্রমাণিত হয়েছিল। বিলস্‌রা একটা ভাষা কোর্স করতে এসেছিলেন; যারা দ্বিতীয় মেয়াদের মিশনারি, ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। তাঁরা কিভাবে বুঝবেন যে, তাঁদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে থাকা অন্যান্য সংকটগুলো থেকে এটা একেবারে আলাদা হবে? কিন্তু, মার্জরি বিল্স্, এক ধরনের ভেতরের তাগিদের বশে, তাঁর পড়ার সময় থেকে কয়েক ঘণ্টা চুরি করে, একটা কাজের কাজ করেন, যেটা করার ইচ্ছা ছিল তাঁর অনেকদিনের। তিনি মিশনের শিশুদের, বন্ধুবান্ধব এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মূল্যবান ছবিগুলো ঝাড়াই বাছাই করে একটা অ্যালবামে সেঁটে, এক সপ্তাহের জন্য ফিল্ড কাউন্সিল মিটিংয়ে যাবার জন্য নেওয়া সুটকেসের একেবারে তলায় রেখে দেন!

তাঁর স্বামী, মেল বিল্স্ ও বব আডল্ফ্, আমাদের ল্যাব প্রযুক্তবিদ, মার্চের ৭ তারিখ থেকেই বন্দরে আঠার মতো লেগে থাকেন কোনো জাহাজ আসে কিনা তা দেখার জন্য। হঠাৎ একদিন তাঁরা দূর থেকে একটা হালকা হুইসেলের শব্দ শুনতে পান। তাঁরা তখন সাইকেলে যত জোরে সম্ভব প্যাডেল মেরে অ্যাপার্টমেন্টে এসে আমাদেরকে তক্ষুণি রওনা দিতে বলেন। তাঁরা ভক্সওয়াগন মিনিবাসে মানুষ ও মালপত্র ভরে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই সবাইকে ডকে পৌঁছে দেন। জো ডিকুক আবারও ঘরে ফিরে গিয়ে গাড়িখানাকে গ্যারাজবন্দী করেন, তারপর একটা রিকশা ধরে তার চালককে বাড়তি পয়সার লোভ দেখিয়ে দুইমাইলের পথটুকু দ্রুত পাড়ি দিয়ে ঠিক সময়েই পৌঁছে যান বন্দরে।

ড. ডিকুক তার গল্প এখান থেকেই শুরু করেন।

“সোমবার সন্ধ্যায় আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছাই নিরাপদেই। জিন গুর্‌গানস সারা সপ্তাহেই বরিশাল থেকে চাটগাঁয় আসা জাহাজের খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিলেন—কিন্তু যেগুলোর আসার কথা সেগুলো কখনোই আসত না। ফলে আমাদের অনির্ধারিত জাহাজটা যখন এসে পৌঁছাল, তখন আমরাই বাড়ি গিয়ে তাঁকে গিয়ে ডেকে আনি। বন্দর থেকে শহরে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়িতে বসে আমরা জানতে পারি, মার্চের ৬ তারিখ, যেদিন আমাদের আসার কথা ছিল, সেদিন সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছে বন্দরে। তাহলে ঈশ্বরই কি জাহাজটি দেরি করিয়েছিলেন আমাদেরকে বাঁচানোর জন্য?”

“ঈশ্বর আমাদের জন্য আরো বিশেষ কিছু করেছিলেন—আমরা যেসব সম্পর্কে সবখানেই প্রচুর পড়ে থাকি এবং দেশে আমাদের বন্ধুরা সবসময় যে-প্রার্থনাগুলো করে যাচ্ছিলেন আমাদের জন্য। আমরা মালুমঘাটে আমাদের হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নিরাপদেই ছিলাম। কিন্তু বরিশালে, সেই তিনটি শূন্য বাসায়, ছিল হাজার হাজার টাকা দামের যন্ত্রপাতি : ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, রেডিয়ো, তৈজসপত্র, গার্হস্থ্য সামগ্রী, এবং কাপড়চোপড়। মে’র শেষ দিকে মিলিটারি পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে বরিশাল ছিল রীতিমতো চোরডাকাতের অভয়ারণ্য। আইনহীনতা ও বিশৃঙ্খলাই ছিল যেন সাধারণ নিয়ম। আমাদের পাশের বাড়িটিকে নাকি ষোলোজন ডাকাতে মিলে একেবারে খালি করে দিয়েছিল প্রখর দিবালোকেই। তারা জানত তিনটি আমেরিকান পরিবার কোনো একটি বাসায় থাকে সেখানে—এবং তারা কোথায় চলেও গেছে! নৈশপ্রহরী হিসাবে যাকে নিয়োগ করা হয়েছিল, যে কিনা সিঁড়িঘরে ঘুমাত, এবং সামান্য এক প্যাঁচার ডাকেই দৌড়ে পালাতে সিদ্ধহস্ত ছিল।”

“মেল বিল্স্ ও আমি জুনের দিকে বরিশালে ফিরি ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে। বাড়িটার দরজা একবার ভাঙা হয়েছিল ঠিকই, একটি ক্যামেরা ও কিছু কাপড়ও খোয়া গেছে, তবে সিংহভাগ জিনিসই অক্ষত ছিল। আমরা বিছানা, চুলা, ফ্রিজ, এবং ড্রামভরা গার্হস্থ্য সামগ্রী বাক্সবন্দী করে পর্বতপ্রমাণ এক বোঝা নিয়ে বন্দরে যাই। প্রতি দশদিনে একটা জাহাজ আসত বরিশালে, তবে আমাদের বলা হয় যে, তারা কেবল সামরিক জিনিসই বহন করে।

ঘাটবাবুর কাছে গেলে আমাদের লটবহর দেখে তিনি বলে ওঠেন ‘এটা অসম্ভব’, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কী ভেবে ধীরস্বরে বলেন, ‘আপনারা তো দেখছি মহা ঝামেলায় আছেন। ঠিক আছে, আমি এগুলোকে চট্টগ্রামে পাঠানোর জন্য যা করা দরকার করব।’ এবং তিনি তা করেছিলেন বৈকি! সবই নিরাপদে চট্টগ্রাম পৌঁছায়। তখনকার পরিস্থিতিতে এটা অলৌকিকের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।

ঈশ্বর আমাদের জন্য সেটা না করলেও পারতেন। কিন্তু সেসব তো ছিল তাঁরই জিনিসপত্র যেগুলোকে তিনি নিরাপদে রাখার যোগ্য ভেবেছিলেন।”

“আরো একদিন ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁর বিশেষ দয়া দেখিয়েছিলেন। আমাদের হাইস্কুলগামী তরুণ দলটি তখন পশ্চিম পাকিস্তানের মারী খ্রিস্টান স্কুল থেকে শীতকালীন ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছিল। নতুন সেমিস্টার শুরু হব হব করছিল তখন, চারজনের জন্য সেটা ছিল আবার একেবারে স্নাতক হবার আগের চূড়ান্ত সেমিস্টার। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অভিভাবকেরা দেশের এই আসন্ন গোলযোগের মুখে চারটি মেয়ে ও তিনটি ছেলেকে সেখানে পাঠাতে দ্বিধা করছিলেন, আবার এই চিন্তাও ছিল তাদের মনে যে, সত্যি যদি গোলমাল শুরুই হয়ে যায় এখানে, তাহলে বাচ্চারা হয়তো স্কুলেই ভালো থাকবে। যে-ছাত্ররা হাসপাতালে থাকত তারা ৯ তারিখে চট্টগ্রাম শহরে আসে ট্রেনে করে ঢাকায় যাবে বলে, তারপর সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। পরিকল্পনা ছিল তারা পূর্ব পাকিস্তানের অপর মিশনারি বাচ্চাদের সঙ্গে একসাথে ভ্রমণ করবে। সত্যি বলতে কী, আমাদের এই কিশোরবয়সী শিক্ষার্থীরা সবসময় ছোট বাচ্চাদের অভিভাবক হিসাবেই তাদের দেখভাল করত, বোর্ডিং স্কুলে যাওয়া আসার সময়টাতে। ১০ তারিখ খুব সকালে তারা ট্রেনস্টেশনে গিয়ে জানল যে, কোনো টিকিটই আর অবশিষ্ট নাই। তাতে তখন একটামাত্র পথই খোলা থাকে : ভোক্স ওয়াগন বাসে করে সড়কপথে সারাদিন লাগিয়ে রাত্রিবেলায় ঢাকায় গিয়ে পৌঁছানো।”

রেভারেন্ড জে ওয়ালশ, যিনি বাচ্চাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার বিমানে জায়গা পাবার বিষয়ে তাঁর হতাশার কথা এভাবে বলেন।

“মার্চের ১১ তারিখ আমরা জানতে পারি যে, পশ্চিম পাকিস্তানগামী প্লেনের টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ির কারণে কর্তৃপক্ষ টিকিট কাউন্টার বন্ধ করে দিয়ে অন্য ব্যবস্থা করেছে। যারা টিকিটের জন্য লাইন ধরেছিল তাদেরকে একটা করে নম্বর দেওয়া হয়েছে। প্রথম নম্বরটি দেওয়া হয়েছিল ৬ তারিখ। ১১ই মার্চ আমাদের স্কুলছাত্রদের দেওয়া হলো ৩৩১৯ থেকে ৩৩২৫ নম্বর!”

“আমাদেরকে ঘনঘন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখতে হচ্ছিল সেই নম্বরগুলো কিভাবে এগুচ্ছে। দিনে দুটো কি তিনটেমাত্র ফ্লাইট ছিল, এবং আমরা জানতাম না আমাদের পালা কখন আসবে। ভারত তাদের আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি প্লেন চলাচল নিষিদ্ধ করে দেওয়ার ফলে বিমানভ্রমণের সময়ও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। পাকিস্তানি বিমানকে তখন ভারতকে এড়িয়ে কলম্বোর মাটি ছুঁয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হচ্ছিল।”

“বিমানবন্দর তখন দেশ থেকে পালানো লোকে লোকারণ্য ছিল। আমি একজনকে দেখতে পাই ছোট একটি বাক্সকে টেনে কাউন্টারের দিকে নিয়ে যেতে—সেটি ছিল সোনায় ভর্তি! (লোকজন তখন তাদের অর্থসম্পত্তি ব্যাংকে রাখার চাইতে নগদে কিংবা সোনার অলঙ্কার করে রাখত।) বণিক ও ব্যবসায়ী যারা আশ্রয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমাচ্ছিল, তারা তাদের সমুদয় সম্পত্তি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিল।”

করাচি থেকে আসা ফ্লাইটগুলোও পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বিমানগুলোর মতোই যাত্রীভর্তি ছিল, তফাত শুধু এই যে, সে-যাত্রীরা নতুন কোনো দেশে আসা অভিভাসী ছিল না। সেই বিমানগুলো আসলে ভরা ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত অস্ত্রধারী পাকিস্তানি সৈন্যে।

নাম্বারগুলো ক্রমে এগুতে থাকে এবং অবশেষে মার্চের ১৪ তারিখে দিনের শেষ ফ্লাইটে করাচি যাওয়ার উদ্দেশে বিমানে ওঠে আমাদের তরুণ ছাত্রেরা। সেখান থেকে তারা মারী হিল্স হয়ে তাদের স্কুলে গিয়ে পৌঁছায়।

তখনও কেউ জানত না যে, এই মিশনারি বাচ্চাগুলো আরো বহুদিন পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা তাদের বাবামা ও বন্ধুদের কাছ থেকে, কিংবা তাদের সম্পর্কে, কিছুই শুনতে পাবে না। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)

এ সম্পর্কিত আরও খবর