“পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু’ চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট” - সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়

সাক্ষাৎকার, শিল্প-সাহিত্য

Tanim Kabir | 2023-09-01 10:35:18

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৪, ২৩ নভেম্বর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শাহরুখ আর আমি’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অনেক অবগাহন’। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে দেশ পত্রিকায় ‘শঙ্খিনী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘প্যান্টি’, ‘রুহ’, ‘যোগিনী’, ‘ঘাট’, ‘সম্মোহন’, ‘ফাঁকি’, ‘কড়িখেলা’, ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘যখন বিকেল’, ‘কালা ঘোড়া’, ‘গুপ্তধন’, ‘মরিয়ম মেয়েরা’, ‘গলনাঙ্ক’, ‘নিভাননী উপত্যকা’ ইত্যাদি উপন্যাস লিখেছেন। প্রায় ৬০-এর ওপর ছোট-বড় গল্প লিখেছেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন এবিপি আনন্দতে। লিখেছেন অসংখ্য ফিচার, ফিল্ম রিভিউ, পোস্ট এডিট, কাভার স্টোরি। প্যান্টি, রুহ, যোগিনী, সম্মোহন ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে Penguin, HarperCollins এবং ইউকে বেইসড পাবলিশিং হাউজ Tilted Axis Press থেকে। যোগিনীর জন্য পেয়েছেন ২০১৭ ইন্টারন্যাশনাল পেন ট্রান্সলেশান এওয়ার্ড। বেশ কিছুকাল লন্ডনে বসবাস করেছেন। এবং ভারত ও বিদেশের অনেক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন। স্বামী আছে। একটি ছেলে আছে। শখ বলতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অধ্যয়ন ও এই মহাবিশ্বে মানুষের উপলব্ধিগুলোকে জানা ও বোঝা।


ইশরাত তানিয়া: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্র নির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন (কন্সট্রাকশান) এবং প্রকাশভঙ্গি এসবের কোনটিকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? নিজস্ব কোনো নির্মাণকৌশল ব্যবহার করেন কি? 
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: নির্মাণ কৌশল বলতে ফর্ম। আলাদা করে ভেবে এগোই না। উপন্যাসটাই দাবি আদায় করে নেয়। যেমন প্যান্টি উপন্যাসটা মাথায় এসেইছিল স্বপ্নের ভেতর। ওইভাবেই উঠে লিখতে শুরু করি। পরে অধ্যায়গুলোর ওই জাক্সট্রাপোজিশান অনেকটা ভেবে করা। মনে হয়েছিল জীবনে তো কোনো কিছুর কনটিনিউটি নেই। ঘটনার কনটিনিইউটি তো থাকে না। অনেকটা কোর্টের ডেট পরার মতো। একটা ডেট পড়ার পর আর একটা ডেট কবে পড়বে কেউ জানে না। আবার রুহ উপন্যাসে প্রটাগনিস্টকে দুটো খুব কন্ট্রাডিকটোরি সত্তায় ভাগ করেছি যেটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। এছাড়া ভাষাটা তো অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। গদ্যের স্টাইলটা ভীষণ ভেবে নিয়ে করি। তবে মডার্ন বাংলা গদ্য নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা আছে। আমি সেভাবেই শব্দকে অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু ধরা যাক আমার গুপ্তধন উপন্যাসটার সময়কাল ৬০-এর দশক। সেখানে ন্যারেটিভটা সেই সময়টাকেই ধরে, ডায়লগও তাই। ফলে পুরোটাই খুব সতর্ক প্রক্ষেপণ। এবং আমার মনে হয় আমার এমন কোনো লেখা নেই যা পাঠক পড়ে বলবে যে লেখক লিখতে হতো তাই লিখেছে। আমি মোটামুটি নিজেকে ধরে রেখেই লিখেছি যা লিখেছি এযাবৎকাল।

ইশরাত তানিয়া: এখন কোনো উপন্যাস লিখছেন? বা নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন? এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: সারাক্ষণ লেখার কথা ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার মধ্যে এই চিন্তার বিজবিজি কোনো পাগলামি নয় তো? এটা এত বেড়ে গেছে যে আজকাল একটু সংশয় হয়। ভাবছি অনেক। লিখছি নগণ্য পরিমাণ। কেন? কারণ কী? জানি না। টায়ার্ড? মনে হয় আমি একটু জীবনটা বাঁচতেও চাই। লেখার জন্য বাঁচতে চাই না। বাঁচলাম লিখলাম দেখলাম ভুলে গেলাম উড়িয়ে দিলাম এরকম হোক। সুচিত্রা ভট্টাচার্য হাত ভেঙে কষ্ট পাচ্ছেন, লিখতে পারছেন না, এক আঙুলে টাইপ করে করে লিখছেন, এত লেখার চাপ। তার মধ্যে বিষম খেয়ে মরে গেলেন। ইস! একটু রেস্ট দরকার ছিল মানুষটার। একটু আরাম দরকার ছিল। কিন্তু পাঠক পাঠক করে সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেন। সেই পাঠক তাঁকে কতটুকু স্মরণ করে? কতটা মিস করে? পাঠক তো কারো নয়। পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট। প্রাণ হাতে করে, মরিয়া হয়ে লেখার প্রয়োজন নেই। একমাত্র টাকার প্রয়োজন থাকলে ওরকম করে লেখা উচিত। আমরা ভাবি পাঠক পাঠক। পাঠক একটা অবিরল স্রোত, একটা চৈতন্যের স্রোত। এই স্রোতের খিদের সঙ্গে লেখক পাল্লা দিতে পারে নাকি? কারণ লেখক ওয়ান ম্যান আর্মি। লেখকের থেকে একা, নিঃসঙ্গ, অসহায় কেউ হয় না। আমাদের মধ্যে, মানুষের সভ্যতার মধ্যে একটা দর্শন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কর্মবীর হতে হবে। যে অনেক কাজ করছে সেই আর কী সঠিক পথে আছে। আমার মনে হয় কাজ কম করা উচিত। উই নিড টু স্লো ডাউন। এটা একটা এমন মানসিক অবস্থা যা মানুষকে আরো তলিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে যে আমাদের রিপু আর প্রবৃত্তিকে আমরা কী করে উন্নত করব। এই যে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, কোথায় এগোনোর কথা বলা হয় আমি বুঝি না। ক্রমশ তো সভ্যতারই প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। পৃথিবীতে মৌমাছি এত কমে গেছে যে এক্সটিঙ্কট হওয়ার মুখে। আর সেটা হলেই মানুষ শেষ। আইনস্টাইন বলে গেছেন কবে, মৌমাছিরা না থাকলে মানুষ ৪ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এখন আমাদের দরকার জঙ্গল, দরকার সরল সাদাসিধে জীবনে ফিরে যাওয়া। এই সব কথাই এখন বলতে হবে। আমার এখন আর এত অহঙ্কার হয় না এই সভ্যতা নিয়ে।
এই সব কারণে আমি অনেক লেখা মনে মনে লিখে ফেলি। অনেক লেখা বাতিল করি। আপাতত এত লেখা মাথায় আছে হয়তো একটা দুটো লিখব তার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমার একটা বাতিক হলো আমি কী লিখছি সেটা কাউকে কখনো বলি না। আমার লেখার কোনো প্লট হয় না। একটা জার্নি হয়। শেষ মুহূর্তে অব্দি আমি জানতে পারি না কী লিখছি।


“সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে আগ্রহী নই”
- রাশিদা সুলতানা


ইশরাত তানিয়া: একজন লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি? কমলকুমার মজুমদার বা সুবিমল মিশ্রের কথা যদি বলি, ওনারা কিন্তু সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেননি। আবার শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতি, সুনীল পৌঁছে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি ।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: যদিও প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, আমার মনে হয় লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটা প্রধান শর্ত রিড্যাবিলিটি। লেখক প্রধানত কমিউনিকেট করার ইচ্ছে থেকেই লিখতে আসেন। নইলে তো মনে মনে কথা বললেও হয়ে যেত। আবার নিজের উপলব্ধিগুলোও কখনো কখনো ফেডেড হয়ে যায়। আমি যে একটা কোনো বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম জীবন সম্পর্কে, সেটা অনেক সময় গুলিয়ে যেতে পারে। তাই সেই অনুভব ও উপলব্ধির শৃঙ্গগুলিকে লিখে রাখতে হয়, আবার কিভাবে আমি সেই উপলব্ধিতে পৌঁছলাম তার জার্নিটাও লিখে রাখতে হয়, নইলে পরে মনে হতে পারে যে আমি এখানে কোথা থেকে এসে উঠলাম? তাই মনে মনে ভেবে ফেলতে পারলেই হয় না, এমনকি মানুষ ডায়রি লেখেও এই জায়গা থেকে। লেখার প্রয়োজন আছে। কোথাও গিয়ে আমার মনে হয় ইতিহাসও সাহিত্যের অঙ্গ। ব্যক্তির ইতিহাস লিখে না রাখলে বৃহৎ ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে না। সেখানেই সাহিত্য ইতিহাসকে জমি দেয়। ফিকশন তাই। লেখার প্রয়োজন তৈরি হয় কারণ এই অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। এটাই প্রত্যাশা একজন লেখকের। সেখানে রিড্যাবিলিটির একটা প্রয়োজন তো থাকেই। কিন্তু কমলকুমারের মতো লেখকরা হলেন লেখকদের লেখক। একজন অভিভাবক যেন। তাঁকে পাঠ করতে হলে এক ধরনের গভীর অভিনিবেশ ও চর্চা দরকার পাঠকের। একটা জেদ থাকতে হয়। সবার জন্য সবকিছু নয়। আবার এরকম হয়েছে, অনেক কালোত্তীর্ণ লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেছে যে তাঁর সময়ে তাঁকে কেউ গ্রহণ করেনি, বুঝতে পারেনি। কাফকা তার জীবিত অবস্থায় কোনোদিন গৃহীত হননি। কিটস্-এর ক্ষেত্রেও এরকম ঘটেছে। সমকাল ঠোঁট উল্টেছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে বুঝতে পারেননি। গুরুত্ব দিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ তার মগ্নচেতনাকে সব সময়ই সাবলিমেট করেছেন ঐশ্বরিক চৈতন্যে। সভ্যতার উন্নতির কথা ভেবে গেছেন। এটা একটা কনশাস প্রচেষ্টা। জীবনানন্দ সেখানে ইতিহাসের অন্ধকারে পর্যটন করেছেন। তিনি মানুষের আরো গভীর অন্তঃপ্রকৃতির কথা লিখেছেন। মানুষের অবচেতনকে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ধরেছেন। জীবনানন্দ এভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু মূল কথাটা একই। লেখকের এই ফুটপ্রিন্ট, এই পার্টিসিপেশান। নিম অন্নপূর্ণা বা সতীত্ব কি রাখব অপর্ণা কিংবা হার্বাট এসব লেখা চিরকাল সিরিয়াস পাঠককে ভাবাবে, পাঠকের মননে নানা ক্রিয়াবিক্রিয়া ঘটাবে। নবারুণ ভট্টাচার্যের নামও এখানে নিতে হয়। আমি এই রাইটার/ অ্যান্টি-রাইটার এর মধ্যে যেতে চাই না। পাঠকের সংখ্যা দিয়ে লেখকের বিচার হয় না।

ইশরাত তানিয়া: রিডার রেসপন্স থিওরি নিয়ে আপনার মত কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: এটা একটা খুব ভালো প্রশ্ন। ইফ দেয়ার ইজ নো রিডার দেয়ার ইজ নো রাইটার। সাহিত্যের প্রতি, একটা ক্রিটিক্যাল লেখার প্রতি পাঠকের অ্যাপ্রোচটা একটা বিরাট বড় ব্যাপার। এটা একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমি একটা পদ রান্না করলাম। অনেকগুলো সিক্রেট ফ্লেভার মেশালাম তাতে। এবার একটা দশজনের গ্রুপ এক সঙ্গে বসে সেই পদটা ভাগাভাগি করে খেলাম। আমরা খেলাম নিঃশব্দে। কোনো মুখভঙ্গি করলাম না। কোনো ভাব প্রকাশ করলাম না। এবং উঠে চলে গেলাম যে যার রাস্তায়। এবার এই যে রান্নাটা তার কী হবে। সেটা রান্না হলো খাওয়া হলো তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। কিন্তু যদি ভাব বিনিময় হতো, আহঃ, বাহ, কী ভালো, এটা কী, ওটা কী, খেতে খেতে এটা ওটা মনে পড়ল ইত্যাদি যদি ওইখানে ঘটত তাহলে এই খাবারটা তার আস্বাদসহ শেষ হয়েও ঝুলে থাকত কোথাও। সেই ঝুলে থাকা একটা অনন্ত সম্ভাবনা। এই অ্যাপ্রোচটা বাদ দিলে খাবার থাকবে, আস্বাদ থাকবে না। অতএব লেখক লেখে, পাঠক পড়ে, এবং তারপর তার রিডিং এক্সপিরিয়েন্স বহুধাবিভক্ত হয়ে এমন বৃহত্তর ডিসকোর্স তৈরি করে যা সাহিত্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এবং অনেক বড় একটা সময়ের ব্যবধানে এই ডিসকোর্স কিন্তু মূল লেখার ভেতর জুড়ে যায়। এর উদাহরণস্বরূপ আমরা মহাকাব্যগুলোর কথা বলতে পারি। এই কারণেই মহাকাব্যগুলো এত হাজার বছর পরও বহমান। জেমস জয়েসের ইউলিসিস পড়ার একটা কমিউনিটি আছে। সেই কমিউনিটিতে মানুষ আসে, এক সঙ্গে ইউলিসিস পড়ে, যে যার মতো করে সেই পাঠে কনট্রিবিউট করে। পরবর্তীতে সেই কনট্রিবিউশন আবার পাঠের অংশ হয়ে যায়। আমি কলকাতায় এরকম স্টাডি সার্কেলে গেছি। আমি বিদেশে বুক ক্লাব দেখেছি। ব্রুকলিনে গত বছর আমার অ্যাবান্ডন উপন্যাসটা একটা বুক ক্লাব এক মাস ধরে পড়েছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কতগুলো বইপড়ার গ্রুপ। তারা এক্সটেনসিভলি লেখক এবং লেখকের রচনা নিয়ে আলোচনা করে। খুব দরকারি। যে কারণে উম্বার্তো ইকো না পড়লে আমি তো আনা কারেনিনাকে এত ভালো করে বুঝতে পারতাম না। স্টাডি সার্কেল ছাড়া আমি তো জয়েসকে বুঝতে পারতাম না। এই প্রসঙ্গে উম্বার্তো ইকোর একটা উক্তি মনে পড়ছে—আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি না যে, তাতে যা লেখা আছে আমরা সেটাই বিশ্বাস করে নেব। আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি যাতে আরেকটা বই পড়ার জন্য আমাদের মনটা আবার অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। অনেকটাই অ্যারিস্টোটল যা বলছেন তারই প্রতিধ্বনি।


“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে”
- নাসরীন জাহান


ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি। লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আসলে অনেক মানুষ একটা ডিনায়েলে বাঁচে। আমার মধ্যেও একটা ডিনায়েল আছে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে গেলাম যে, আসলে আমার যা সাফারিংস সেটা মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। আর পাঁচটা নারী পুরুষ জীবনে যে দুর্ভোগ সহ্য করে ঘটনাচক্রে আমাকেও সেই রকম অনেক কিছু জীবনে সহ্য করতে হয়েছে। আমার বাবার পুত্র সন্তানের প্রতি একটা অনিচ্ছা ছিল। চাইতেন কন্যা সন্তান হোক। আমার বাবাকে মজা করে খবর দেওয়া হয় যে ছেলে হয়েছে। বাবা খুব আশাহত হয়ে বসে ছিলেন চুপ করে। তখন তাড়াতাড়ি বলা হয় যে—না, মেয়ে জন্মেছে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে যান মেয়েকে দেখতে। এই গল্পটা আমাকে ছোট থেকে বলা হতো। এটা শুনে আমার দুঃখ হতো সেই না হওয়া ছেলেটার প্রতি। যে হলে বাবা তাকে দেখতে যেত না! আবার পুরো গল্পটা একটা স্ট্রেংথ তৈরি করে দিয়েছিল আমার মধ্যে আমাদের সকলের অগোচরে। নিজেকে মূল্যবান ভাবার, ওয়ান্টেড ভাবার এরকম একটা ঘটনা থাকলে একদম ছোট্ট থেকে একটা বিশ্বাস আর নিরাপত্তার বোধ তৈরি হয়ে যায় যেটা পরবর্তী সময় নিজেকে নারী হিসেবে পুরুষের তুলনায় কিছু আলাদা ভাবাটা একেবারে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বাতিল হয়ে যায় মন থেকে, চিন্তা থেকে। আমার মামাবাড়ির তরফে এত এত মেয়ে। তাদের খুব কদর ছিল। অনেক বড় অব্দি আমার মামাদের দেখতাম আমার মাসীদের স্নান, খাওয়া, ঘুম, মুখে ক্রিম লাগানো, রাতের দাঁত মাজা, ইসবগুল খাওয়া এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে। “দুপুরে ঘুমোলি না তোরা? খালি গল্প করলি?” এই নিয়ে হয়তো মামা রাগারাগি করলেন। মানে সারাক্ষণ বাড়ির মেয়েদের তোয়াজ করা হতো। যদিও মামারা ছিলেন অতি মধ্যবিত্ত পরিবার। এদিকে আমার বাবার দিকের পরিবার হলো অতি উচ্চবিত্ত, অতিরিক্ত ধনী পরিবার বলতে যা বোঝায় তাই। সেখানেও পরিবারে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। আর মেয়েদের সেই রকম আদর, আবদার। আমরা এতটাই প্যামপারড ছিলাম ভাবা যায় না। এই দুদিকে মেয়েদের এত আস্কারা পেতে দেখে আমার ভেতর পুরুষ বিদ্বেষটা গড়ে ওঠেনি। পরবর্তী জীবনে আই হ্যাড বিন সাব্জেক্টেড টু ভেরিয়াস ইল ট্রিট্মেন্টস বাই মেন। কিন্তু আমি ভাবতে শিখিনি যে এটা তারা করেছে কারণ পুরুষদের মধ্যে এইরকম দোষ থাকে আর তারা পুরুষ। আমি ভেবেছি মানুষ হিসেবে এরা কমপ্যাটিবল নয়, ঠিক নয়, যোগ্য নয়। অ্যান্ড আই মুভড অন ইন মাই লাইফ টু মেক মাই লাইফ বেটার ইন হোয়াটএভার মিন্স, ইউ মাইট সে। কিন্তু এ হলো আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা। প্রফেশনাল জগতে, কাজের জগতে আমাকে পুরুষ দ্বারা হ্যারাসড হতে হয়নি কারণ আই ওয়াজ আ ব্লু আইড গার্ল ইন মাই ওয়ার্ক প্লেস। কেউ আমাকে কখনো বিরক্ত করেনি বা কোনো রকম ডিস্ক্রিমেনেশান বা পলিটিক্স কিছু আমাকে সহ্য করতে হয়নি। আই হ্যাড আ সেইফ করিডোর আর তারপরও যেটুকু এসে পড়েছে সেটা খুব সাট্ল। তার কোনো ইফেক্ট হয় না জীবনের কোথাও। এতসব কিছুর পরও বলব যে, অনেক পুরুষই আত্মসম্মান জিনিসটা বোঝেন না। তাদের আপ ব্রিংগিংয়ের মধ্যে নিজেকে রেস্পেক্ট করা ব্যাপারটা কম। বিশেষত মেয়েদের সামনে প্রায়শই তারা পা থেকে মাথা অব্দি একটা ‘পেনিস’-এ রিডিউসড হয়ে যান। এটা তাদের প্রবলেম। তাদেরই সলভ্ করতে হবে। আমরা মেয়েরা নিজেদের ঘাড়ে এইসব কিছু পরিবর্তনের দায়টা আর নেব না। বা নিজেদের পরিবর্তন করে পুরুষদের অ্যাকোমোডেট করব না। মনে রাখতে হবে যে, আমরা মেয়েরা নিজেদের যত ভাঙছি গড়ছি তা এই পুরুষতন্ত্রের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে করছি। আমাদের জানতে হবে এই চাপটা না থাকলে আমরা কী কী করতাম, কেমনভাবে বাঁচতে চাইতাম। এছাড়া আরো নানা রকম ডিস্ক্রিমিনেশান কর্মক্ষেত্রে আমাদের সহ্য করতে হয়। এগুলো প্রচুর বড় পরিসরে আলোচনা করার বিষয়। এখন তো মধ্যবয়স। অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসেছি। এখন আমি পুরুষদের ভালোওবাসি না, ঘৃণাও করি না। পুরুষ প্রকৃতিটাই অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। ম্যাসকিউলিনিটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে যত দিন যাচ্ছে। আরো হবে। খুব অচিরে এই রিজেকশান অফ ম্যাসকিউলিনিটি নিয়ে বিপুল চর্চা শুরু হবে এটা দেখতে পাবে। পৌরুষ জিনিসটার এলিজি লেখা হলো বলে।

ইশরাত তানিয়া: উপমহাদেশ জুড়ে ইদানীং ধর্মের প্রবল মাতামাতি, কী ভাবছেন? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য কি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তির যোগান দিতে পারে?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি কোনোদিনই কারো শেখানো বুলি আওড়াতে পারিনি, চাইনি। আমার একদম ছোট থেকে নিজস্ব মতামত ছিল। এমন মতামত যা কিনা তুমি বলতে পারো কিছু দেখে, কিছু পড়ে, কিছু শুনে তৈরি হয়নি। একেবারে নিয়ে জন্মেছিলাম বলা যায়। ফলে আমার কথা সবার পছন্দ হয় না। তো, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি এটাই বলব যে, পৃথিবীতে সমস্ত ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে ওঠার মতো সাহিত্য বলো, শাস্ত্র বলো, ডিসকোর্স বলো, কম লেখা হয়নি। যা লেখা হয়েছে তাই মানুষ সারা জীবনে পড়ে উঠতে পারবে না। আর সত্যি কথা বলতে কী, বোধ তৈরি হওয়ার জন্য একজন মানুষকে কোটি কোটি পথ প্রদানকারী বই পড়ার প্রয়োজন হয় না যে, সে সারা জীবন খালি পথ খুঁজেই যাবে, কোনো উদ্ধারই তার হবে না। ব্যাপারটা তা নয়। তাই যা লেখা হয়েছে, যথেষ্ট লেখা হয়েছে, এই সভ্যতা তার থেকে শিখতেই পারে। কিন্তু শিখেছে কি? সাহিত্যের নানান ধারা মানুষের মননকে ঋদ্ধ করেছে কিন্তু জীবনের গতিপথ পাল্টাতে পেরেছে কি? একজন কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না, তার বোধ, চেতনা একদম তৈরি, কিন্তু এখন দাঙ্গা লাগল, তাকে মারতে এলো কেউ, সে উঠে গিয়ে মারল বা মরল, দু ক্ষেত্রেই এই যে ঘৃণ্য জিনিসটা ঘটে গেল এটাকে তো সময় থেকে মুছে দেওয়া যাবে না, সময় তো ঘৃণাটাকে নিয়ে চলবে। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সেখানে মানুষ তার প্রজ্ঞা, তার জ্ঞান, রুচি, শিক্ষা সব একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে জলাঞ্জলি দেবে। দিতে সে বাধ্য কারণ সে আসলে একটা বড় চক্রান্তের ভেতর একটা গিনিপিগ। একটা পরিস্থিতির শিকার। এত ভালো ভালো সব লেখা আছে, যা ঘটনার পর ঘটনা দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এই সব ধর্ম টর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ বোঝে, জানে, কিন্তু এঁটে উঠতে পারে না। আমি তো এরকমও কথা বলেছি যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কী সেটা? আঘাত লাগার একটা প্রমাণ তো থাকে, শরীরে, মনে, কী আঘাত লাগল তার একটা প্রামাণ্যতা তো আছে, থাকবে? কেউ পারবে প্রমাণ করতে? কিন্তু দেখো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত একটা কত্ত বড় বিষয়। এমনকি এমন ছেঁদো একটা দাবিকে আইনও স্বীকার করে, যে হ্যাঁ বাবা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে! যাই হোক, জানি না কী ধাতুতে তৈরি হয়েছিলাম, জীবনে এসব প্রশ্ন জাগলোই না। সাহিত্যের কাজ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সাহিত্য তার কাজ করে যাবে। আবার দেখো সাহিত্যের একটা বিপজ্জনক বিনির্মাণ হচ্ছে। কাউন্টার সাহিত্য লেখা হচ্ছে। সেগুলোও তো ঢুকে আসছে। যেটা ধর্মকে আবার জীবনের মূলে ফিরিয়ে দিতে চাইছে। যে মানুষ কিছু না, ধর্মের জন্যই মানুষ, তাই মানুষ আর কিছু ভাববে না, ধর্মের জন্য বাঁচবে মরবে। মারিও পুজো বলে গেছিলেন, যে পৃথিবীর সর্ব প্রথম মাফিয়া ছিলেন পোপ আলেকজান্ডার। মারিও সারা জীবন মাফিয়াদের নিয়ে পৃথিবীর জনপ্রিয়তম বই লিখে গেছেন। তিনি একথা বলছেন। ধর্ম এইরকমভাবেই কাজ করে মানুষের জীবনে।
এখানে একটা কথা বলতে চাই, এই উপমহাদেশকে ধর্মের গ্রাস থেকে, অন্ধকার থেকে বাঁচাবে মেয়েরা। মেয়েরা জানে ধর্মের সবচেয়ে বড় বলি তারা। তাদের বাঁচতে দেওয়া হবে না। মেয়েরা লড়াই করবে, সাহিত্য অর নো সাহিত্য, মেয়েরা একেবারে নখ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে ধর্মের রাক্ষসকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর