“সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে আগ্রহী নই” - রাশিদা সুলতানা



সাক্ষাৎকার: ইশরাত তানিয়া
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক রাশিদা সুলতানার সাক্ষাৎকার।


রাশিদা সুলতানা

রাশিদা সুলতানার জন্ম ১৯৭৩ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবার কর্মসূত্রে আশৈশব তিনি বড় হন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন। পরে ‘জাপান ডেভলপমেন্ট স্কলারশিপে’ জাপানের রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ চারটি : ‘অপনা মাঁসেঁ হরিণা বৈরী’ (২০০৪), ‘আঁধি’ (২০০৭), ‘পরালালনীল’ (২০০৯), এবং ‘পাখসাট’ (২০১২)। কাব্যগ্রন্থ একটি : ‘জীবনযাপন দখিন হাওয়া’ (২০০৮)। উপন্যাস একটি : ‘সাদা বিড়ালেরা’ (২০১৩)। তাঁর নির্বাচিত গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। রাশিদা ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার হিসাবে বাংলাদেশ মেট্রোপলিটান পুলিশে কাজ করেছেন। রাশিদা ২০১০ থেকে জাতিসংঘে চাকরি করছেন। প্রায় ৪ বছর তিনি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে রিজিওনাল প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। রাশিদা বর্তমানে জাতিসংঘের দারফুর শান্তি মিশনে সুদানে কর্মরত।


ইশরাত তানিয়া: লেখালেখির ব্যাপারে জানতে চাই। শুরুটা কিভাবে হলো? কেমন করে লেখক হয়ে ওঠা?
রাশিদা সুলতানা: শৈশব কৈশোরে কখনো ভাবি নাই আমি লেখক হব। ৯৮ সালের দিকে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করতাম কবিতা লিখতে। ছন্দহীন গদ্য কবিতা। আবেগে টইটুম্বুর অথচ কোনো ইঙ্গিত, দ্ব্যর্থবোধকতাহীন কবিতা। কিন্তু গল্প উপন্যাস লিখব বা লিখতে পারব তা কখনোই ভাবি নাই। আত্মবিশ্বাসও কখনো ছিল না। আমার কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন পুরোটাই কেটেছে বইয়ের ভেতর নাক, মুখ, আত্মা সব ডুবিয়ে। সময় পেলেই গল্প উপন্যাস পড়তাম। অথবা সদ্য পড়া গল্প উপন্যাসের চরিত্রদের নিয়ে ভাবনায় ডুবে সময় কাটাতাম। কত দুপুর বিকাল রাত্রি নিজেকে মৈত্রেয়ী দেবী ভেবেছি আর মির্চা এলিয়াদের সাথে অনন্তকাল ধরে গল্প করে গেছি। কিন্তু কখনো এ কথা ভাবার সাহস হয় নাই আমিও কোনোদিন লেখক হব। আমার মনে হতো শুধুমাত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষেরাই গল্প উপন্যাস লিখতে পারে।
হঠাৎ করেই ২০০০ সালের শেষ দিকে আমার প্রথম গল্প লিখি। তখন আমি বিষণ্ণতায় ভুগতাম। সেসময় আমি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে গাজীপুরে চাকরি করি। গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিকেলে লেকের পাড় ধরে হাঁটছি। চরম বিষণ্ণ আমি সন্ধ্যা নেমে এলে রুমে ফিরে আসি। হঠাৎ করেই মাথায় একটা গল্পের আইডিয়া আসে। তখনও আমি গল্প লেখার কৃৎকৌশল ভালোভাবে জানি না। প্রথমপুরুষে আমার প্রথম গল্প ‘প্রত্যাখ্যাতা প্রতিশ্রুতা’ প্রায় একটানে লিখে ফেলি। তারপর তিন চারদিন ধরে সম্পাদনা করি। লেখার পর আমি নিশ্চিত ছিলাম না এটা ভালো গল্প হয়েছে কিনা।
২০০১-এর জানুয়ারিতে গল্পটা দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হয়। গল্পটা ছাপা হবার পর লেখক, সম্পাদক, নানা জনের কাছ থেকে গল্পটার প্রশংসা শুনি। সেসময় দৈনিক প্রথম আলো অফিসে প্রায়ই যেতাম। দিনে দিনে কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবী প্রচুর বন্ধু এবং শুভ্যার্থী তৈরি হয়। প্রথম গল্পের প্রশংসা শুনে আমার মধ্যে আরো গল্প লেখার সাহস এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বছরে তিন চারটা গল্প দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় ছাপা হতো। প্রথম আলোর পাঠকপ্রিয়তার কারণে লেখক, বুদ্ধিজীবী অনেকেই পড়েন এবং তাঁরা অনেকেই আমার লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মূলত লেখক, বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের উৎসাহ এবং পাঠকের প্রশংসার কারণেই লেখালেখিতে আমি সিরিয়াস হয়ে উঠি।
আমার লেখক হয়ে ওঠার শুরুর দিকে যেসব কবি, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবীরা আমাকে অনুপ্রেরণা এবং সমর্থন দিয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন: ব্রাত্য রাইসু, সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সলিমুল্লাহ খান, এবাদুর রহমান, আনিসুল হক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মানস চৌধুরী, সুমন রহমান, মাতিয়ার রাফায়েল এবং সাখাওয়াত টিপু।
আমার গল্পের পাঠকের ভালোবাসাই আমাকে লেখার প্রতি দায়বদ্ধ করেছে।

ইশরাত তানিয়া: লেখার বাহ্যিক ও অন্তর্গত দিক জানতে চাই। টানা লিখে ফেলেন? লেখার মধ্যে বিরতি আসে? দীর্ঘ উপন্যাস লেখার ব্যাপারেও আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: কোনো গল্পের প্লট হঠাৎ করেই আমার মাথায় আসে। যখনই কোনো গল্পের আইডিয়া আমার মনে আসে আমি তৎক্ষণাৎ নোট লিখে রাখি। গল্পটা আমার মাথার মধ্যে থাকে। দিনে দিনে গল্পের প্লট, চরিত্র, কাঠামো সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন টানা লিখে ফেলি। লেখার সময় মূল পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে যাই। সম্পাদনা করি আরো কয়েকদিন। অনেক সময় যেভাবে গল্পটা পরিকল্পনা করি তার থেকে ভিন্ন একটা গল্প হয়ে ওঠে। কোনো কোনো গল্প টানা লিখেছি। কয়েকটা গল্প আবার মাঝখানে বিরতি দিয়ে লিখেছি। আমার গল্প পাখসাট, বিচারকাণ্ড, স্বপ্নমঙ্গল—এই গল্পগুলো মাঝখানে বিরতি দিয়ে লিখেছি। যেহেতু গল্পটা সবসময়ই আমার মাথার মধ্যে থাকছে এবং যখন যা কিছু পরিকল্পনা করছি গল্পটা নিয়ে সব লিখে রাখছি, ফলে লেখার মাঝখানে বিরতি হলেও লেখার ছন্দ, গতি ফিরে পেতে বেগ পেতে হয় না।
আমার পক্ষে উপন্যাস টানা লেখা সম্ভব হয় না। বিরতি দিয়েই লিখতে হয়। ফুলটাইম চাকরি, ঘরের কাজ, পরিবারের দায়িত্ব এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস সময় বের করা সম্ভব হয় না। কিন্তু উপন্যাসটা সবসময় আমার মাথার মধ্যে থাকে। কাহিনী, চরিত্র, প্লট সবই আমার মাথার মধ্যে থাকে। উপন্যাসের শুরুর দিকে যেভাবে লেখার পরিকল্পনা করি সেভাবে শেষ হয় না। লেখার সময় অনেক পরিবর্তন হয়। লেখার সময় নতুন আরো গল্প, ইমেজ এবং চরিত্র আসে।
সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসটা লেখার সময় একটা মেয়ে বারবার জাপানে তার ফ্ল্যাটে ব্যালকনিতে ফিরে যেতে চাইবে। বিদেশের একটা ব্যালকনি যেখানে তার কোনো অধিকার এবং মালিকানা নাই তার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ—এটাই প্রাথমিক আইডিয়া ছিল। শুরুতে সন্দিহান ছিলাম এমন অবিশ্বাস্য একটা গল্প বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলতে পারব কিনা। উপন্যাসটি লেখা শুরু করার পর কোজু, অংকুজ এইসব চরিত্ররা আর বিভিন্ন ইমেজ আমার কাছে স্পষ্ট হয়।
কোজু, অংকুজকে তৈরি করেছি নীতুর মতোই নিঃসঙ্গ। তাদের ব্যক্তিত্ব এমনভাবে তৈরি না হলে একাকীত্ব, হাহাকার কোনোভাবেই ফুটে উঠত না। আমার মনে রাখতে হয় গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা রক্তমাংসের মানুষের মতোই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। পাঠকেরা তাদের ব্যক্তিত্ব, অন্তর্গত সংঘাতের অংশীদার হয়ে ওঠে।

ইশরাত তানিয়া: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্রনির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন এবং প্রকাশভঙ্গি—কোনটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
রাশিদা সুলতানা: গল্প উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই এই সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়-কাঠামো-চরিত্রনির্মাণ-ভাষা-প্রকাশভঙ্গি এসবের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। এদের উপযুক্ত মেলবন্ধনে একটা সফল গল্প উপন্যাস লেখা হয়।

ইশরাত তানিয়া: চরিত্ররা কি আপনার আশপাশ থেকে আসে নাকি অন্য কোনো উৎস আছে?
রাশিদা সুলতানা: চরিত্ররা তৈরি হয় কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে। নিজের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, বন্ধু-সহকর্মীদের অভিজ্ঞতা, সংবাদপত্রে পড়া কোনো খবর থেকে আবার কখনো পুরোপুরি কল্পনা থেকে চরিত্র তৈরি হয়। গল্প বা উপন্যাসের কাঠামোতে একশভাগ মিশে যায় এমন চরিত্র তৈরি করতে হয়।

ইশরাত তানিয়া: সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসিকায় জাপানী যুবক কোজুর মতো বাংলাদেশি এক মেয়ে নীতুর ব্যালকনি-আকুলতা একই সুরে বাঁধা পড়েছে। তাদের মনোজগতের আবহাওয়া এবং প্রতিকূল বাস্তবতা মিলিয়ে উপন্যাসটিকে বিশ্বজাগতিক বলা যায়। কেমন করে এই উপন্যাস লিখলেন?
রাশিদা সুলতানা: ২০০৪ সালে আমি জাপানে যাই মাস্টার্স করতে। আড়াই বছর ওখানে থাকি। জীবনে প্রথম পরিবার-সামাজিকতা-কোলাহলের বাইরে থাকি। নিজের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাই। বাংলাদেশে ফেরার পর হঠাৎই এক মনে হলো একটা গল্প লিখি—একটা মেয়ে বারবার জাপানে তার প্রিয় ব্যালকনিতে ফিরে যাবার জন্য তীব্র টান অনুভব করছে। বিদেশে এমন একটা ফ্ল্যাট এবং ব্যালকনির জন্য তার আকর্ষণ যেখানে তার কোনো মালিকানা বা অধিকার নেই। অথচ ওই ব্যালকনির জন্য তার বুকভর্তি ভালোবাসা;—এধরনের একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম কবিতার মতো দ্ব্যর্থবোধক এবং ইঙ্গিতময়।
এর আগে আমি হুয়ান রুলফোর গল্প পড়েছি। তাঁর উপন্যাস পেদ্রো পারামো পড়েছি। বোর্হেসের গল্প পড়েছি। শুরুতে আমি ভেবেছি কবিতা এবং গল্পের ফিউশনে মেটাফর ব্যবহার করে ভিন্ন ধরনের একটা গল্প লিখব। প্রায় পাঁচ হাজার শব্দের গল্প লিখেও ফেলি। আমার দুজন বন্ধুকে টেলিফোনে গল্পটার কথা বলি। তারা গল্পের কাহিনী শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ঢাকার বাইরে থাকেন এমন একজন প্রিয় কথাসাহিত্যিক বন্ধু এবং বড়ভাইকে টেলিফোনে গল্পটার কথা বলি এবং কিছু অংশ পড়ে শোনাই। তিনি আমাকে বলেন, পাঁচ হাজার শব্দে গল্পটা শেষ করবেন না। একে আপনি আরো বড় গল্প, উপন্যাসিকা বা উপন্যাস হিসাবে লেখেন, দারুণ ব্যাপার হবে। আমারও তখন মনে হয় আরো লিখতে পারি। এটা দারুণ একটা উপন্যাস হবে। সেসময় আমার অবসরের পুরোটা সময়ই এই কাহিনী নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। দিনে দিনেই নানা ইমেজ এবং চরিত্ররা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুরুর দিকে আমি সন্দিহান ছিলাম এমন অবিশ্বাস্য একটা গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে লিখতে পারব কিনা এবং আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল লেখাশেষে আমার যদি মনঃপুত না হয় এটা আমি কোথাও ছাপতে দিব না বা ছুড়ে ফেলে দিব।
উপন্যাসটা লিখতে নানা ইমেজ, ম্যাজিক রিয়ালিজম, মেঘের ভিতর থেকে বিড়াল এসে প্রোটাগনিস্টের ব্যালকনিতে হানা দেয়—এরকম অবাস্তবতাকে বাস্তবতা আলিঙ্গন করে নেয়। এসব আসে লেখার অনিবার্য অস্তিত্ব হিসাবেই। ইমেজ ব্যবহারের কারণে জাপানের প্রকৃতি, দশতলা এক্সেলশিয়র নামের দালান, ব্যালকনি, তার ঠিক নিচে জঙ্গলে ছাওয়া সবুজ জলের পুকুর—এরা প্রায় সবাই উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে। এইসব ইমেজ তৈরি করা আমার জন্য সহজ ছিল। কারণ বাস্তবে এদের মাঝেই আমার নৈঃশব্দ্যের দিনরাত্রি আমি কাটিয়েছি।

ইশরাত তানিয়া: ভিকারুননিসা নুন কলেজ, জাপানে রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দারফুরে কাজ করার প্রসঙ্গ সাদা বিড়ালেরায় এসেছে। একে কি আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলবেন?
রাশিদা সুলতানা: ‘সাদা বিড়ালেরা’য় রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আছে, দারফুরে আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করার প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু তারপরেও এটা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস না। জাপানে আমি দশতলা বিল্ডিংয়ের যে এপার্টমেন্টে থাকতাম ওই বিল্ডিংয়ের নাম ছিল ‘এক্সেলশিয়র শিগা’। আমি যে স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকতাম সেটিও ৪১২ নাম্বার রুম ছিল। আর আমার ব্যালকনির ঠিক নিচেই ছিল সাদা বিড়ালেরার মতো সবুজ জলের একটা পুকুর। চারপাশে জঙ্গলে ছাওয়া। অদূরে একটা লেক। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে দূরে সেতা শহরের ক্ষুদে ঘরবাড়ি দেখা যেত আর দিগন্তরেখায় দেখতে পেতাম সাদা মেঘ, কুয়াশার মুকুট পরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল পাহাড়। তাছাড়া সাদা বিড়ালেরার প্রোটাগনিস্ট নীতুর মতো আমিও একজন ডিভোর্সি নারী।
নৈঃশব্দ্যের যে সৌন্দর্য ও ভয়াবহতার বর্ণনা এ উপন্যাসে আছে তাও আমি খুব ভালোভাবে চিনি। এত সাদৃশ্য থাকার পরও একে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলা যাবে না। এই উপন্যাসে নীতুর অভিজ্ঞতার সাথে আমার বহু অভিজ্ঞতার মিল আছে যেমন অমিলও প্রচুর আছে। আমি কখনোই পরিবার, বন্ধুত্ব সবকিছু ছেড়ে যাবার মানুষ না। আমি বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান-আপনজনদের সাথে জড়িয়ে, লেপ্টে থাকা একজন মানুষ। উপন্যাসটি আমার অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনা মিশিয়ে লিখেছি।

ইশরাত তানিয়া: নিরীক্ষামূলক লেখাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
রাশিদা সুলতানা: নিরীক্ষা আমার প্রিয়। হারুকি মুরাকামি নিরীক্ষামূলক উপন্যাস লিখে সাহিত্য দুনিয়াতে তোলপাড় তুলেছেন। সালমান রুশদি, বোর্হেস, কাফকা, অক্টাভিও পাজ, মার্কেস—আমার প্রিয় বহু লেখকই আঙ্গিক, ভাষা এবং প্রকরণ নিয়ে নিরীক্ষামূলক সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। পরবর্তীকালে ভাষা এবং প্রকরণ নিয়ে আরো লেখকেরা সফল নিরীক্ষা করেছেন।

ইশরাত তানিয়া: নারীবাদ কি দর্শন হিসাবে আপনাকে প্রভাবিত করে? আপনার লেখায় কি নারীবাদ সরাসরি এসেছে?
রাশিদা সুলতানা: অবশ্যই করে। আমি নারীবাদী। নারীবাদ একটি সচেতন রাজনৈতিক অবস্থান। নারীবাদ চায় নারীর স্বাধীন ইচ্ছার জয় হোক। বহু ধরনের নারীবাদ আছে। একজন হিজাবি নারীও একশভাগ নারীবাদী হতে পারেন। একজন নারীবাদী শ্রেণী বৈষম্যসহ সবধরনের বৈষম্যের অবসান চান বলে আমি মনে করি। গল্প উপন্যাস লেখার সময় বৈষম্যের, বৈপরীত্যের জায়গাগুলো আমি তুলে ধরি। প্রচলিত অর্থে যে নারীবাদকে আমরা চিনি সেই অর্থে আমার চরিত্ররা নারীবাদী না। সাহিত্যিক হচ্ছেন ঈশ্বরের মতো। তিনি ফেরেশতা, দানব, খুনী, ধর্ষক—সবার চরিত্র একই পরিমাণ দরদ দিয়ে লিখবেন। আমার গল্প উপন্যাস একজন নারী লেখকের গল্প এবং উপন্যাস। আমার স্বতঃস্ফূর্ত নারীত্ব দিয়ে আমি লিখি। কিন্তু নারীবাদের পাটাতনে বসে নয়।

ইশরাত তানিয়া: বোর্হেসের ওপর কাফকার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। আপনার লেখায় কারো প্রভাব আছে কি?
রাশিদা সুলতানা: আমার লেখায় আমার প্রিয় লেখকদের প্রভাব তো আছেই। আমি মনে করি সব সফল লেখকরাই তাদের প্রিয় লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত। আমি কোনো প্রতিষ্ঠানে সাহিত্যের কোনো কোর্স করিনি বা ডিগ্রি নিইনি। প্রিয় লেখকদের গল্প উপন্যাস পড়েই আমি লিখতে শিখেছি। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যেসব প্রিয় লেখকদের লেখা পড়েছি সবাই আমাকে প্রভাবিত করেছেন। মার্কেস, বোর্হেস, কাফকা, মুরাকামি, সালমান, শহীদুল জহির, জগদীশ গুপ্ত, হার্টা মুলার, অরুন্ধতী রায়, অক্টাভিও পাজ—উনাদের কাছ থেকে কৃৎকৌশল, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যবহার, অবিশ্বাস্য গল্প সত্যের মতো করে বলতে পারা—বহু কিছু শিখেছি।

ইশরাত তানিয়া: একজন লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি? কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শহীদুল জহিরের কথা যদি বলি, তাঁরা সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। হয়তো চানওনি। আবার শরৎচন্দ্র, সুনীল, হুমায়ূন পৌঁছে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
রাশিদা সুলতানা: আমার মনে হয় না পাঠকপ্রিয় হবার জন্য কোনো শক্তিশালী লেখক লিখে থাকেন। লেখকের দায়বদ্ধতা শিল্পের কাছে। আমার কাছে বিবেচ্য আমি নিজে আমার লেখা গল্প বা উপন্যাসটি নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা। নিজের শিল্প-সাহিত্যবোধ অনুযায়ী একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস লেখা—এটাই সুলেখকের একমাত্র বিবেচ্য। কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শহীদুল জহিরেরা কালোত্তীর্ণ লেখক। বাংলা ভাষার প্রায় সব লেখকদেরই তাঁরা প্রিয় লেখক। অন্যদিকে প্রচুর পাঠকপ্রিয়তা পেলেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ বোদ্ধা পাঠক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কবি, কথাসাহিত্যিকদের প্রিয় লেখক নন। আবার সুলেখক হবার পরও জাপানী ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক।

ইশরাত তানিয়া: এখন কি উপন্যাস লিখছেন? নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?
রাশিদা সুলতানা: আমি এখন একটা উপন্যাস লিখছি। প্রথম ড্রাফট লেখা শেষ করেছি।

ইশরাত তানিয়া: সেই লেখাটি কি লিখতে পেরেছেন যা লেখার জন্য দীর্ঘদিনের অপেক্ষা?
রাশিদা সুলতানা: আমার বেশ কিছু গল্প এবং সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসটি লেখার সময় মনে হয়েছিল সেটিই আমার আরাধ্য লেখা। একমাত্র ওই লেখাগুলো আর্টফর্মে লিখতে পারা আমার তখনকার স্বপ্ন ছিল। পাখসাঁট, বিধুহীন, পরালালনীল, দাম্পত্য, বিচারকাণ্ড এবং আরো গল্প আর উপন্যাস লেখার সময়ই মনে হয়েছে এই লেখাটি হতে যাচ্ছে আমার দীর্ঘদিনের অপেক্ষার লেখা। বর্তমানে যে উপন্যাসটি লিখছি তা নিয়েও আমার যত্ন, অপেক্ষা আর নিবেদনের শেষ নাই। আমি যেই আবেগ, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখি পাঠকের হয়তো তেমন মনে হবে না। তাঁদের মনে হতে পারে এসব একেবারেই সাদামাটা লেখা।

ইশরাত তানিয়া: সাহিত্য যদি হয় একটা শিল্পমাধ্যম, একজন লেখককে কখন সফল বলা যায়?
রাশিদা সুলতানা: সাহিত্য যখন শিল্পোত্তীর্ণ হয় তখনই কবি-লেখক সফল হন। আর গল্প, কবিতা, উপন্যাসে লেখকের চিন্তা, ইঙ্গিত, অনুভূতি লেখকের নিজের এবং পাঠকের শিল্পবোধকে আন্দোলিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

ইশরাত তানিয়া: শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যম, ধরুন চিত্রকলা বা সঙ্গীত এসব কি আপনার লেখাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে?
রাশিদা সুলতানা: চিত্রকলা আমাকে প্রভাবিত করে। পিকাসোর ডিকন্সট্রাকশন, সালভাদর দালির কল্পকাহিনী, মার্ক শাগার্ল আর ভ্যানগগের রঙের ব্যবহার, ইমেজ এসব আমাকে প্রভাবিত এবং প্ররোচিত করে।


“পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু’ চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট”
- সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়


ইশরাত তানিয়া: সাহিত্যে আবেগ, নীতিবোধের প্রকাশ আপনার কাছে কেমন মনে হয়? অতিসচেতনতা বা অসচেতনতা কি সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ করে?
রাশিদা সুলতানা: সাহিত্যে আবেগের প্রকাশ তো থাকবেই। কিন্তু তা পরিমিত এবং শিল্পিত হতে হবে। সমাজে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা এবং দায়িত্ব আছে। বাবা, মা, স্কুলশিক্ষক, ধর্মযাজক নীতিবোধের শিক্ষা দিবেন। কিন্তু সাহিত্যের নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা নাই। সাহিত্যের কাজ প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা। যুগ যুগ ধরে শিল্পী, সাহিত্যিকেরা তা করে আসছেন এবং সমাজকে বদলেছেন।
অসচেতনতা সাহিত্যের শিল্পগুণ অবশ্যই ক্ষুণ্ণ করে কিন্তু অতিসতর্কতায় সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হবার কোনো কারণ নাই। সাহিত্যিকের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ, সতর্ক সম্পাদনা কোনো গল্প-উপন্যাসকে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

ইশরাত তানিয়া: উত্তর-আধুনিক গল্পগুলো কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন?
রাশিদা সুলতানা: সামাজিক বাস্তবতার পাটাতনে লেখা বহু গল্প বা উপন্যাস আমার যেমন প্রিয়, তেমনি উত্তর-আধুনিক গল্প উপন্যাসও আমার প্রিয়। গড অব স্মল থিংস—এই উত্তরাধুনিক উপন্যাসটি আমার অতিপ্রিয় উপন্যাস। এ উপন্যাসটি কাটাকুটি করে আমি বহুবার পড়েছি উপন্যাস লেখা শিখতে।

ইশরাত তানিয়া: সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কারা? তাঁদের কোন দিকগুলো টানে?
রাশিদা সুলতানা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার অতিপ্রিয় লেখক। আমার স্কুলজীবন কেটেছে তাঁর সব গল্প পড়ে। ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, মহাশ্বেতা দেবী, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, মঈনুল আহসান সাবের, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ইচক দুয়েন্দে, কাজল শাহনেওয়াজ—তাঁরা সবাই আমার প্রিয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়, প্রথম আলো উপন্যাসদুটি ভালো লেগেছে। অমিয়ভূষণ মজুমদার পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পড়া হয়নি। নাসরিন জাহানের উড়ুক্কু, শাহীন আখতারের উপন্যাস সখী রঙ্গমালা, শাহাদুজ্জামানের গল্প সংকলন পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আর হুমায়ূন আহমেদ, সুমন রহমান, শিবব্রত বর্মণ এবং সাগুফতা শারমীন তানিয়ার বেশ কিছু গল্প ভালো লেগেছে। মাহবুব মোর্শেদের কয়েকটা গল্পও ভালো লেগেছে।
অমিয়ভূষণ মজুমদারসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখকের বহু লেখা আমার পড়া হয়নি। আমার দুর্ভাগ্য! যাদের লেখা উল্লেখ করেছি তাঁরা সবাই বাঙালির যন্ত্রণা এবং অভীপ্সাকে, তাঁদের সময়টাকে আর্টের ফর্মে তুলে ধরেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

ইশরাত তানিয়া: বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার মধ্যে বাংলা সাহিত্যের তুলনা করলে আপনার দৃষ্টিতে সম্ভাবনার কোন পাল্লাটি কোন দিকে হেলে পড়ছে? এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সুর, গানের মধ্যে বড় হওয়া সব মানুষের মধ্যেই যে কোনো মহৎ কিছু করার সম্ভাবনা আছে। সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে ও দেখতে আগ্রহী নই। বাংলা ভাষার সাহিত্যের সকল রূপ আর সম্ভাবনার অবাধ অংশগ্রহণ ও প্রকাশ আমি দেখতে চাই।

ইশরাত তানিয়া: ইলিয়াস, জহির আর হাসান আজিজুলের পর একটি শূন্যতার কথা বলেন অনেকে। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: আমি কোনো শূন্যতা দেখতে পাই না। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ অসামান্য এক উপন্যাস। ইচক দুয়েন্দের লালঘর উপন্যাসিকা, তাঁর গল্প সংকলন, কাজল শাহনেওয়াজ, শাহাদুজ্জামান, সুমন রহমান, সাগুফতা শারমীন তানিয়াসহ অনেকেই ভালো লিখছেন।

ইশরাত তানিয়া: বাংলা সাহিত্যের বাইরে কোন লেখকের লেখায় আকৃষ্ট হন?
রাশিদা সুলতানা: বাংলা সাহিত্যের বাইরে বহু লেখকের লেখায় আকৃষ্ট হই। যেমন তলস্তয়, আন্তন চেখভ, মোপাসা, ফ্রানৎস কাফকা, মার্কেস, বোর্হেস, হুয়ান রুলফো, অক্টাভিও পাজ, মারিয়া ভার্গাস য়োসা, সালমান রুশদী, অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা, হার্টা মুলার, গুন্টার গ্রাস, সিঙ্গার, ইতালো কালভিনো, হারুকি মুরাকামি, জিয়া হায়দার খান, সাদাত হাসান মান্টো, ভৈকম মুহাম্মদ বশীর—এঁরা সবাই আমার বহু দিনরাত্রি আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

ইশরাত তানিয়া: একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটা চ্যালেঞ্জিং? সমস্যাগুলোর সমাধানই বা কী?
রাশিদা সুলতানা: লেখক সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই অংশ। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী এবং পুরুষতান্ত্রিক দানব লেখক আমি কম দেখিনি। শিল্প-সাহিত্যচর্চা তাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং চর্চা একবিন্দু কমায়নি। নারী লেখকের মধ্যেও পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবাহী বহুজনকে দেখেছি। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন নারীর লেখক হতে যাওয়ার জন্য মোটেও কোনো চ্যালেঞ্জ না। নিজের ভিতর লেখক হওয়ার টান থাকলে নারী-পুরুষ যে কেউ লেখক হয়ে উঠতে পারে। পুরুষতান্ত্রিকতা কেন, পৃথিবীর কোনো প্রতিরোধ-প্রতিবন্ধকতাই তার লেখালেখি থামাতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক গালাগাল হজম করা নারী লেখক আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং শানিত হয়ে ওঠে।

ইশরাত তানিয়া: এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি। প্রকাশনা শিল্প—সাহিত্যচর্চা ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ লেখক-প্রকাশকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয় খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ কী বলে?
রাশিদা সুলতানা: বাংলাদেশের প্রকাশকদের বেশিরভাগের মধ্যেই পেশাদার মনোভাবের অভাব আছে। লেখকদের ঠকানোর মানসিকতা এদের অনেকের মধ্যেই আছে। প্রকাশকদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর না। এরা কেউ কেউ সরকার দলের অনুগত লেখক, আমলা, ক্ষমতাধরদের বাড়তি সুবিধা দেয়। অন্যদিকে ক্ষমতাহীন লেখকদের নানা ধরনের ভোগান্তির মুখোমুখি করে। দু চারজন পেশাদার ভালো প্রকাশক আছেন। এর বাইরে বেশিরভাগ প্রকাশক লেখকের সাথে নানা ধরনের প্রতারণা করে থাকেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আমি দেখি না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ও জানা নেই।

ইশরাত তানিয়া: লিটলম্যাগাজিন একটি আন্দোলনের নাম। লিটলম্যাগের লড়াই ও টিকে থাকা প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ভাবনা শোনা যাক।
রাশিদা সুলতানা: বাংলা সাহিত্যে লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের ইতিবাচক অবদান আছে। আশির দশকের লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের হাত ধরে বেড়ে ওঠা কবি লেখকরা বাংলা কবিতা, গল্প-উপন্যাসকে ভিন্ন ধারায় এবং উচ্চতায় নিয়ে গেছে। লিটলম্যাগ আন্দোলনে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দর্শন শুধুমাত্র বড় দৈনিকে লেখা ছাপাব না-তে সীমাবদ্ধ ছিল না। জীবন যাপনে তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিল। যেসব কবি লেখকরা শুরুর দিকে লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে পরবর্তীতে এ আন্দোলন ছেড়ে গেছেন, তাঁদের কেউ কেউও বাংলা কবিতা, গল্পকে সুষমামণ্ডিত করেছেন। আমি নিজে কখনোই লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম না। দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে একসময় নিয়মিত আমার লেখা ছাপা হতো। কিন্তু আমার বন্ধু, গুরুস্থানীয় অনেকেই এককালে লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন যাঁদের মূল্যবান মতামত, পরামর্শ আমার লেখক হয়ে বেড়ে ওঠায় সাহায্য করেছে।

ইশরাত তানিয়া: ছোটবেলাটা কেমন ছিল? এখন সে ব্যাপারে শোনা যাক।
রাশিদা সুলতানা: ছোটবেলায় আমি খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। অনেক সাহসী আর অঘটনঘটনপটিয়সীও ছিলাম। মা বাবাকে হাজারটা প্রশ্ন করে ক্লান্ত করে ফেলতাম। সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মা অত প্রশ্রয় দিত না। বাবার কাছে বেশি প্রশ্রয় পেতাম। আমার শৈশবে বাবা একবার গ্রামের বাড়ি যাবার সময় আমি গোঁ ধরি বাবার সাথে যাব। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনে যাবার সময় পুরোটা পথ বাবাকে আমি হাজারটা প্রশ্ন করি। এই গ্রামের নাম কী, ওই গ্রামের নাম কী, অনেক দূরের গ্রামের নাম কী, ওই বাজারের নাম কী, এই ক্ষেতে কিসের চাষ হয়, ওই পাখির নাম কী? পুরোটা পথ আমার বাবা ধৈর্য ধরে আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন। যেহেতু বাবার কাছে প্রশ্রয় পেতাম—আমার যাবতীয় জ্ঞানতৃষ্ণা উপচে পড়ত বাবাকে কাছে পেলে। আমার বাবাও ক্লান্তিহীন আমার সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যেতেন। আমার অন্তহীন প্রশ্নে কখনো বিরক্ত হতেন না। যেহেতু আমি সাহসী ছিলাম স্পষ্টভাবে যে কাউকে যে কোনো কথা রাখঢাক ছাড়া বলতে পারতাম। বাবা, মা, চাচা সবার কাছে খুব স্পষ্টভাবে যে কোনো কিছু চাইতে পারতাম। এত সাহস আমার বড় বোন এবং ছোট বোনদের ছিল না। যাই হোক আমার দুঃসাহসের কারণে রাখঢাক ছাড়া যে কোনো কথা বলে ফেলার কারণে আমার মা চাইত না আমি দুপুরে বা বিকালে পড়শিদের বাসায় যাই। আম্মা আমাকে নিয়ে সবসময় শংকায় থাকতেন কখন কোথায় গিয়ে কী বলি, কী ধরি, কী ভাঙি।
শৈশবে আমার মধুর স্মৃতি হচ্ছে বাবার কাছ থেকে গল্প শোনা। বাবা অফিস থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে আমাকে গল্প শোনাতেন। রূপকথার গল্প বা ঠাকুরমার ঝুলির গল্প না, বাবা গ্যালিভার-লিলিপুটদের কাহিনী বলতেন। কাসাবিয়াংকার কাহিনী বলতেন—আমার চেনা পৃথিবীর বাইরের নানা গল্প। এত আকর্ষণীয়ভাবে এইসব অচেনা পৃথিবীর গল্প বলতেন—আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বাবা বুঝতে পারতেন আমার এডভেঞ্চার ভালো লাগে। এডভেঞ্চারের জায়গাগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতেন। গ্যালিভার-লিলিপুটদের কাহিনীতে আমি এমনভাবে হারিয়ে যেতাম, আমার বাবাকে বারবার অনুরোধ করতাম এই একই গল্প বলে শোনাতে। প্রতিদিন একই রকম আকর্ষণীয়ভাবে বাবা আমাকে গল্প শোনাত।
মা অবসর পেলে ঠাকুরমার ঝুলি এবং নানা দেশের রূপকথার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত। এভাবে গল্প বলে বলে আমার বাবা-মা আমাকে বাসায় আটকে রাখতে চেষ্টা করত। আমার অন্য ভাই বোনেরা শৈশবে বাবা মায়ের বাধ্যগত ছিল যা আমি ছিলাম না। যখন নিজে পড়তে শিখেছি সেসময় শিশু, কিশোর পত্রিকা, বেগম, রোববার, বিচিত্রা এসব ম্যাগাজিন-পত্রিকা হকার দিয়ে যেত। আমার মা বই পড়ত। আমাদের জন্য আসত শিশু আর কিশোর পত্রিকা, বাবা রাশান অনুবাদ বই, আর পত্রিকা আসত। শিশু, কিশোর পত্রিকার ঈদসংখ্যা, উপন্যাস আর রূপকথার কাহিনী দিয়ে বইপড়া শুরু। জন্মদিনের ক্যামেরা, নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, লালঘোড়া আমি উপন্যাসগুলো পড়ার পর এই চরিত্রদের নিয়ে, তাদের দুঃখ, তাদের এডভেঞ্চার দিনরাত্রি আমার ভাবনাজুড়ে থাকত। হাইস্কুলে ওঠার পর পাঠ্যক্রমের বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি করে গল্প-উপন্যাস পড়তাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সব ছোটগল্প হাইস্কুলে পড়াকালীন পড়া হয়ে গেছে। আমি গল্প-উপন্যাসের কাহিনীতে চরিত্রদের নিয়ে আচ্ছন্ন থাকতাম।


“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে”
- নাসরীন জাহান


আমাদের সময় ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। ফলে বইপড়া, টিভি কার্টুন, সিরিয়াল দেখা ছাড়া বিনোদনও আর ছিল না। ক্লাস সেভেন এইটের পর থেকে বাইরে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা বা পাড়ার ছেলেদের সাথে মেলামেশায় বাধা ছিল। অবাধ্য প্রকৃতির ছিলাম বলে আর স্কুলে রেজাল্ট খারাপ হতো বলে আমার মা আমাকে তাঁর চোখের ওপর রাখতে চাইত। বইয়ের গল্প-কাহিনীর ভিতরে আমি বাঁচতাম। দারুণ আনন্দ নিয়ে বাঁচতাম ওইসব গল্প-উপন্যাসের চরিত্র হয়ে বইয়ের চরিত্রদের কাহিনীকে কল্পনায় আরো এগিয়ে নিয়ে যেতাম। কোনো কোনো গল্প-উপন্যাসের কাহিনী দীর্ঘদিন, এমনকি বছরের পর বছর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সেসময় আমি একবারের জন্যেও স্বপ্ন দেখি নাই আমি লেখক হব। রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সেবার কিশোর ক্লাসিক, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা পড়ি। রোববার, বিচিত্রার ঈদসংখ্যার সুবাদে শওকত আলি, রাহাত খান, সৈয়দ শামসুল হক পড়ি। রাশান উপন্যাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা পড়ি, আন্তন চেখভের গল্প পড়ি। অলেকজান্ডার বেলায়েভের ইকথিয়ান্তরকে নিয়ে কত ভাবনা ডালপালা মেলত সেসময়। শুক্রবারে বাবা বিটিভির মুভি অব দ্য উইকের সিনেমাগুলো দেখত। বাবার সাথেসাথে আমরা ভাই বোনেরাও মুভি অব দ্য উইকের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমার প্রিয় কার্টুন ছবি থান্ডার ক্যাটস, স্মারফস, হেইডির জন্য অপেক্ষা করতাম। থান্ডার ক্যাটস নিয়ে এমন উন্মাদনা ছিল স্কুলে পড়ার সময় রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখেছি আমি থান্ডার ক্যাটস দলের হয়ে চিতারার মতো যুদ্ধ করছি। থান্ডার ক্যাটসের চিতারা, এক্স ফাইলস সিরিয়ালের ডোনা স্কালি আমার জেনারেশনের মেয়েদের যোদ্ধা হয়ে ওঠার, নারীর ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছে বা যাদের তেমন স্বপ্ন ছিল তাদের স্বপ্নকে পোক্ত করেছে। আমার মা আশৈশব স্বপ্ন দেখাত আমরা মাস্টার্স, পিএইচডি করব। এমনকি বিভিন্ন নোবেল বিজয়ীদের সংবাদ, সাক্ষাৎকার পড়ার জন্য বলত আমাদের মধ্যে স্বপ্ন বুনে দেয়ার জন্য। আরেকটা ব্যাপার যা আমাকে আজকের আমি হয়ে ওঠাতে ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে আমার বাবা-মা, নানী-দাদী সবাই পরোপকারী মানুষ ছিলেন। নানা-দাদাকে পাইনি, বাবা-মা, নানী-দাদী বহু অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছেন।

ইশরাত তানিয়া: বাবা-মা, ভাই-বোন মানে আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। লেখার জন্য পারিবারিক এবং পরবর্তীতে সাংসারিক জীবন কি অনুকূলে ছিল?
রাশিদা সুলতানা: আমরা পাঁচ ভাই-বোন। চার বোন আর আমাদের একটিমাত্র ভাই। আমরা ভাই বোনেরা একই ধরনের বই পড়ে, একই ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি। বাবা-মা সবসময় চাইতেন আমরা উচ্চতর পড়াশোনা করি। এর আগে বলেছি আমার মা প্রতি বছর কারা নোবেল পুরস্কার পেলেন সে সংবাদটাও আমাদের পড়তে দিতেন। ব্যাপারটা যে আমরা যে নোবেলজয়ী হয়ে উঠব সেজন্য না। বাবা-মা দুজনেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন আমরা যেন সৎ, ভালো মানুষ আর প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠি। আর বড় স্বপ্ন দেখি। আমার এই ৪৭ বছর বয়সেও যখন আমি জাতিসংঘে চাকরি করছি, ফুলটাইম লেখালেখি করি, আমার মা প্রায় নিয়মিত অনুরোধ করেন আমি যেন পার্টটাইম পিএইচডি ছাত্রী হিসেবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কারণ আমার বর্তমান চাকরি না ছেড়ে আমি ফুলটাইম পিএইচডি ছাত্রী হতে পারব না। কিন্তু আমার যেহেতু আরো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে পিএইচডি শুরু করার সাহস আমার হয় না। কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির আমাকে স্নেহ করতেন। জাপান থেকে স্কলারশিপে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফেরার পর তাঁকে বলেছিলাম, “স্যার পিএইচডিতে ভর্তি হব ভাবছি।” তিনি বলেছিলেন, “তুমি ভালো গল্প লিখো। পিএইচডিতে ভর্তি হলে তোমার লেখালেখির জন্য সময় পাবা না বেশ কয়েক বছর।”
আমার সাহিত্যচর্চায় আমার পরিবার সবসময় উৎসাহ দিয়েছে। কয়েকটা গল্পের বিষয়, কাহিনী নিয়ে বাবা-মা দুয়েকবার তাঁদের অস্বস্তির কথা বলেছেন। তখন সবচে বেশি সমর্থন পেয়েছি আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে। সে আমার বাবা-মাকে বুঝিয়েছে, “তোমাদের মেয়ে এমন শক্তিশালী গল্পকার, তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করো না।” আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে সতের বছর বিবাহিত জীবন কাটানোর পর আমাদের ডিভোর্স হয়। তিনি আমার লেখালেখিতে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন। আর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি আমার দুই সন্তানের কাছ থেকে।

ইশরাত তানিয়া: শুদ্ধতম অনুভূতির নাম প্রেম। আপনার চেতনায় প্রেমকে কী রূপে দেখেন? ঈশ্বরপ্রেম বলুন কিংবা নর-নারীর প্রেম বলুন। সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে এর প্রভাব কতটুকু? মানে সৃষ্টিশীলতাকে ট্রিগার করে কি?
রাশিদা সুলতানা: প্রেমের মধ্যে ইথারায়িত হয়ে থাকার চেয়ে মধুর অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে? একটা মানুষের শক্তিমত্তা, অনুপ্রেরণা আর যাবতীয় অর্জনের উৎস হতে পারে প্রেম। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রকৃতি প্রেম—সবই শিল্প-সাহিত্যে অন্তহীন প্রেরণা যোগায়। নিকষ আঁধার পৃথিবীর ওপর থোকা থোকা নক্ষত্র। হঠাৎ টুপটুপ করে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে। আর তার ধুন্দুমার আলোর নাচন— প্রেম এমনই।

ইশরাত তানিয়া: প্রাসঙ্গিকভাবে যে প্রশ্নটি চলে আসছে—প্রেমে পড়েছেন? প্রেমের প্রথম প্রকাশ জানতে চাইছি। কেমন ছিল সে অনুভূতি?
রাশিদা সুলতানা: হ্যাঁ, পড়েছি। আমার প্রেম প্রাকৃতিক কাণ্ডের মতো কিছু একটা। ঝড়-ঝাপটা টাইপের। প্রেমের প্রথম প্রকাশও ঝড়ের মতোই ছিল। ওরকম প্রেমের উত্তেজনায় প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দের তুলনা হয় না। প্রতিদিনই একেবারে নতুন, নতুন মনে হয়েছে আমার প্রেম। আর এইসব জাদুর রঙ রোজ রোজ আমাকে সজীব করে তুলেছে।

ইশরাত তানিয়া: ‘দেশ’ ধারণাটিকে অন্তর্গতবোধে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন।
রাশিদা সুলতানা: ‘দেশ’ ধারণাটিকে ভৌগোলিক সীমারেখায় আমি দেখি না। বাংলাদেশের বাইরে যেখানে বাংলাদেশি আছে সেখানেই একেক টুকরা বাংলাদেশ আছে, আর আমার এই ‘দেশ’ ধারণায় আমার স্বপ্ন, শৈশবস্মৃতি, বাবা, মা, সন্তান, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, এই আমি হয়ে ওঠা, স্বপ্নভঙ্গ, দানবীয় পুরুষতন্ত্র, মানুষের শঠতা, পাশবিক নিষ্ঠুরতাসহ বহু কিছু অন্তর্ভুক্ত। আমার আনন্দ-যন্ত্রণা-অভীপ্সা থেকে আমার ‘দেশ’ ধারণাকে আলাদা করার উপায় নাই।

ইশরাত তানিয়া: উপমহাদেশের একটি বড় সমস্যা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নানা সঙ্কট। কিভাবে দেখেন বিষয়টি? আপনার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘রাহুর আরোহী’ গল্পে প্রসঙ্গটি এসেছে।
রাশিদা সুলতানা: এই উপমহাদেশে ধর্মের নামে, জাতীয়তার নামে ঘৃণা ছড়ানো হয়। ভিন্ন ধর্মের, গোত্রের, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্যাতন-নির্মূল করার তত্ত্বকে মহৎ হিসাবে প্রচার করা হয়। উপমহাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নেমে আসা নির্যাতন, বৈষম্য, তাঁদের অসহায়ত্ব আমাকে ব্যথিত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরাও ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতো বছরের পর বছর ধরে ঘৃণার চাষাবাদ করেছেন, করে আসছেন। আমার ‘রাহুর আরোহী’ গল্পে ১৯৭১-এ রাজাকারেরা হিন্দু কিশোর বিশ্বকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ওই গল্পটিতে হিন্দু-মুসলমান সবার প্রতি পাকিস্তানিদের এবং রাজাকারদের নিষ্ঠুরতার বয়ান আছে।

ইশরাত তানিয়া: অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চেতনা শিল্পের সুষমায় ঠাঁই পায়। যে কোনো (দর্শনজাত মার্কসিস্ট, অ্যান্টিমার্কসিস্ট) উপন্যাস হলে সমস্যা আছে কি?
রাশিদা সুলতানা: অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা, মানিক বন্দোপাধ্যায়সহ বহু সফল ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে, দর্শনজাত বহু গুরুত্বপূর্ণ গল্প-উপন্যাসে রাজনৈতিক চেতনা আছে। রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ গল্প-উপন্যাসকে শিল্প করে তুলতে পারে শক্তিমান লেখকরাই। সবাই পারে না।

ইশরাত তানিয়া: জাতিসংঘ শান্তিমিশনে সেক্টর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করেছেন। দারফুরে বা পূর্ব তিমুরে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: দারফুর এবং পূর্ব তিমুরে কাজের অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু সব প্রতিকূলতাই আমার সক্ষমতাকে একেক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে। পূর্ব তিমুরে সংঘাত এবং যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনে সহায়তা, নির্বাচনকালীন সংঘাত প্রতিরোধ, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, কারা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, সক্ষমতা তৈরি করা, রাজনৈতিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন এবং বিভিন্ন সংঘাত প্রতিরোধ করেছে জাতিসংঘ শান্তি মিশনটি।
আমি এবং আমাদের মিশন সাপোর্ট ডিভিশান টিম মিশনে কর্মরত পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পুলিশ, মিলিটারি, আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা এবং পূর্ব তিমুরের সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক এবং লজিস্টিক সার্ভিস এবং সাপোর্ট দিয়েছি। দারফুরেও একই ধরনের কাজ করেছি। মিশনের কেন্দ্রীয় সেক্টরের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে শান্তি মিশনে কর্মরত সবার, আইডিপি ক্যাম্পের অসহায় মানুষদের, সুদান সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে প্রশাসনিক এবং লজিস্টিকস সংক্রান্ত সার্ভিস এবং সাপোর্ট দিয়েছি। দারফুরে পানির অভাবে আইডিপি ক্যাম্পের লাখ লাখ মানুষ সীমাহীন কষ্ট করেছে, দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে গিয়ে বহু নারী ধর্ষিত হয়েছে। আমরা নলকূপ বসিয়ে তাদের পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
দারফুরে সব ধরনের সংঘাত, নির্যাতন বন্ধের জন্য এই মিশন কাজ করে যাচ্ছে। লাখ লাখ ঘরহারা লোকের, আইডিপি ক্যাম্পে থাকা মানুষের নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট থেকেছি। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ রোধে পুলিশ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চরম বিপন্ন মানুষেরা যেন বিভিন্ন দাতা সংস্থার সব ধরনের সাহায্য পায়—অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের এই মহৎ যজ্ঞের আমি অংশীদার এই ভাবনা আমাকে আত্মসন্তুষ্টি দেয়। নানা দেশের নানা মানুষ, সংস্কৃতি আর বন্ধুত্বের উদযাপন—দারুণ অভিজ্ঞতা।
পূর্ব তিমুরে কাজ করার সময় কিউবার একদল ডাক্তার এবং পর্তুগিজ একদল স্কুল শিক্ষকদের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। এঁরা পূর্ব তিমুর সরকারের সাথে কাজ করত। তাঁদের সাথে উপচে পড়া উৎসব-আনন্দে মেতেছি দিনের পর দিন। কিউবানদের, পর্তুগিজদের এবং আরো নানাদেশি বন্ধু-সহকর্মীদের উচ্ছল আনন্দ, নৃত্য দেখে কখনো মনে হয়েছে এঁরা বোধহয় পাখির গানে বা কলকাকলিতেও দলবেঁধে সবাই নেচে ওঠে। সামান্য উপলক্ষেই উৎসব-উদযাপনে মেতে ওঠে। দারফুর আর পূর্ব তিমুরে সব ধরনের মানুষের বন্ধুত্বে, উষ্ণতায় আপ্লুত হয়েছি। পূর্ব তিমুরে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে সমুদ্রে সাঁতার কেটেছি। স্নরকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিং করেছি। জলের তলের অসীম সৌন্দর্য মন-প্রাণ-আত্মা খুলে দিয়ে উপভোগ করেছি। সমুদ্রে চন্দ্রাস্ত, সূর্যাস্ত দেখেছি, ভোররাতে কমলা চাঁদ টুক করে সমুদ্রে ডুবে যেতে দেখেছি। এসব অভিজ্ঞতা আমার উপন্যাসে রসদ যুগিয়েছে।

ইশরাত তানিয়া: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতি কি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করে? দারফুর বা পূর্ব তিমুরের সঙ্কট কি আপনার লেখায় এসেছে?
রাশিদা সুলতানা: পূর্ব তিমুর বা দারফুরের সঙ্কট আমার লেখায় আসে নাই। তবে এইসব সংকটের নানারূপ প্রভাব আমার অভিজ্ঞতায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই সংকটের সাথে আমার লেখালেখির সাংঘর্ষিক কিছু নাই। বরং আমার রাজনৈতিক চেতনাকে শানিত করেছে।

ইশরাত তানিয়া: ইলেকট্রিক মিডিয়া আর স্যোশাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের ফলে সাহিত্য চেতনা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে? আপনি কি একমত?
রাশিদা সুলতানা: হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে তাই মনে হয়। পৃথিবীর বহু দেশে স্কুল কলেজে পাঠ্যক্রমে সাহিত্য এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যে সাহিত্যপ্রেমীর সংখ্যা কমে না। বাংলাদেশে এর একেবারে বিপরীত চিত্র। শিক্ষক-ছাত্র-নীতিনির্ধারক সবারই সাহিত্যে বিরাগ।

ইশরাত তানিয়া: সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য কি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি যোগান দিতে পারে?
রাশিদা সুলতানা: যে কোনো সংকটে সাহিত্য ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগান দিতে পারে। সাহিত্যের ক্ষমতা অসীম।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;