“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে” - নাসরীন জাহান



সাক্ষাৎকার: ইশরাত তানিয়া
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের সাক্ষাৎকার।

নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহানের জন্ম ৫ মার্চ ৫, ১৯৬৪। একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সম্পাদক। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এক দিকে ধ্রুপদী অন্য দিকে আধুনিকতা তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। তাঁর গদ্য বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ ভূমিতে বিশিষ্টতার দাবি জানায়। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাসের জন্য লাভ করেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার। ‘পাগলাটে এক গাছ বুড়ো’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-সাহিত্য সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

প্রকাশিত ১৪টি গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে স্থবির যৌবন, বিচূর্ণ ছায়া, সারারাত বিড়ালের শব্দ, পুরুষ রাজকুমারীসহ অন্যান্য। প্রকাশিত উপন্যাস ২৪টি। উপন্যাসের মধ্যে উড়ুক্কু, সোনালি মুখোশ, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার, নিকুন্তিলা, ক্রুশকাঠে কন্যা, ঈশ্বরের বাম হাত, সেই সাপ জ্যান্ত উল্লেখযোগ্য। নাসরীন জাহান পাক্ষিক পত্রিকা অন্যদিনের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।


ইশরাত তানিয়া: সাহিত্যে আবেগ, নীতিবোধের প্রকাশ আপনার কাছে কেমন মনে হয়? অতি সতর্কতা কিংবা অসচেতনা কি সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ করে?
নাসরীন জাহান: সাহিত্যে আবেগের গুরুত্ব আছে বৈকি, নীতিবোধেরও, কিন্ত এটা লেখক যেন আরোপিতভাবে লেখার ওপর না চাপান। বিষয়, চরিত্র যদি ডিমান্ড করে তখনই এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বোঝা যাবে। অবশ্যই বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে। লেখার শাদা পাতা যদি হয় নদী, লেখক সেখানে দক্ষ সাঁতারু। সাহিত্যে শুরু থেকে একটা পোক্ত ধারণা নিয়েই লেখক বই বের করার প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে বসবে। সেই সাঁতারুর মতোই নদী-কাগজ তাঁকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। কাগজকে যদি নদী ভাবি, আমি দক্ষ সাঁতারুর মতো সেখানে কলমের সাঁতার কাটব। নদীতে ঢেউ এসে মাঝে মাঝে সাঁতারকে আটকে দেয়। তেমনই লেখকের কলমও পরে কী লিখব, এমন ভাবনায় লেখককেও থামিয়ে দেয়। ভেবে লেখক যেভাবে ফের কলম চালায় সাঁতারুও একটু থামার পর ফের ঢেউ উপেক্ষা করে ফের সাঁতারে ছুটতে থাকে। সচেতন, অসচেতনতাকে উপেক্ষা করে কাজ করে স্বতঃস্ফুর্ততা।

ইশরাত তানিয়া: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির আর হাসান আজিজুল হকের পর একটি শূন্যতার কথা বলেন অনেকে। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাই।
নাসরীন জাহান: এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে আগের উত্তরের মিল আছে। কিভাবে বিচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন এই তিনজনকেই বাংলাদেশের ভালো লেখক হিসেবে এক করে পেল, বিস্মিত হচ্ছি। আর আমি নিশ্চিত এখানে দুজন অনেক সিনিয়র লেখকের পরে এক লাফে আশির দশকের শহীদুল জহিরের নাম আসতই না, তিনি যদি মারা না যেতেন। জীবদ্দশায় কতটা অবহেলিত ছিলেন তিনি, আমি কাছ থেকে দেখেছি। আর এটা কার বানানো তালিকা? আরো অনেক ভালো লেখক আছেন, আমি নাম নিচ্ছি না। কারণ শিল্পের ব্যাপারে আমি তুমুল আপোসহীন। দেখা গেল কেউ অনেক প্রাণের মানুষ কিন্তু তার লেখা আমার ভালো লাগে না বলে তার নাম নিলাম না। সাথে সাথে তার সাথে আমার বন্ধুত্বে জীবনের জন্য চিড় ধরে গেল। লেখালেখির প্রথম জীবনে আমি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। যা হোক এ লেখাটা যাঁরা পড়বেন, প্রত্যাশা করি, তাঁরাও ওই তিন লেখককেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের লেখক মেনে ক্ষান্ত হবেন না। আমরাও তো নিশ্চয়ই ঘাস কাটছি না, হা হা। এই প্রথম নিজের কথা বললাম। প্রশ্ন শুনে ক্ষোভ থেকে এটা বললাম।

ইশরাত তানিয়া: নারীবাদ দর্শনটিকে কিভাবে দেখছেন? আপনার গল্পে, উপন্যাসে বোঝা যায় নারীবাদে সামগ্রিকভাবে আস্থা রাখেন। আপনার লেখায় নারীবাদ পরিস্ফূট হয়েছে। এই প্রবণতা আপনার ভেতরে এবং লেখায় কী করে সঞ্চারিত হলো বিশ্লেষণ করে বলবেন কি?
নাসরীন জাহান: আমাদের বেশিরভাগ নারী পুরুষের মধ্যে নারীবাদের ভুল ব্যাখ্যা হয়। কিছু পুরুষের মতো নারী, পুরুষদের গালাগাল করে, ব্রা উড়িয়ে নিজেকে নারীবাদী প্রমাণ করতে চাইতেন।
আমার একটা নিবন্ধের বই আছে ‘নারীর প্রেম ও তার বিচিত্র অনুভব’, ওই বইয়ে এ বিষয়ে আমার বোধ ঢেলে দিয়েছি। বলেছি, নারীবাদ মানে এই নয় যে পুরুষ ইট মারল তো নারী পাটকেল মারবে। জার্মানিতে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলাম, নারীবাদ মানে সন্ধায় কর্মক্লান্ত স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে একগ্লাস পানি। প্রশ্ন এলো, মানে? বললাম, হাসব্যান্ড ওয়াইফ ঘরে ফিরে একজন আরেকজনের দিকে তাকাবে, যার মুখ বেশি ক্লান্ত, তার দিকেই আরেকজন গ্লাস এগিয়ে দেবে। শুধু নারী এ কাজ করবে এ ঠিক না। বিভ্রান্ত সৃষ্টিকামী নারীবাদীদের জন্য প্রচুর নারী তোতলায়, বলে, আমি সেই অর্থে নারীবাদী... তোতলানোর কী আছে? অনেক পুরুষকে আমি প্রশ্ন করেছি, এই পৃথিবীটা পুরুষ শাসিত, এ নিয়ে দ্বিধা আছে? তাঁরা বলেছেন, না। আমি বলেছি এই পৃথিবীতে নারী পুরুষের সমান যোগ্যতা যেখানে, সেখানেও যদি নারীকে শোষিত হতে হয়, তবে তাকে নারীবাদী হতেই হবে। এক্ষেত্রে যেমন শ্রমিকরা শ্রমিকবাদী, নারীরা নারীবাদী। আমি জানালা দিয়ে দেখেছি স্বামী স্ত্রী ইট ভাঙছিল। স্ত্রীর কোলে একটা বাচ্চা। ঘরে গিয়ে রাঁধতে হবে বলে স্ত্রী ইটে তিনবার হাতুড়ি বসালে, স্বামী বসাচ্ছিল এক বার। অথচ স্ত্রীর চাইতে স্বামী মুজুরি পাচ্ছিল ডাবল। এক্ষেত্রে স্ত্রীর অবশ্যই নারীবাদী হওয়া উচিত। আমি বেগম রোকেয়ার নারীবাদকে ব্যাপক সম্মানীয় মনে করি।

ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি, লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
নাসরীন জাহান: অবশ্যই আমাদের পৃথিবী পুরুষ শাসিত এ অমোঘ এক সত্য। লেখক সমাজ এর বাইরের কেউ না। আমাদের লেখার শুরুতে প্রায় সব পত্রিকায় মহিলা আর সাহিত্য আলাদা পাতা ছিল। কিন্তু সেই সাহিত্য পাতার নাম পুরুষ পাতা ছিল না। নারী পাতাকে পুরুষরা বড় অবহেলার চোখে দেখত। সাহিত্য পাতায় মহিলাদের লেখা ছাপা দুর্লভ এক ব্যাপার ছিল। তখন তিনজন শক্তিশালী লেখকের লেখা সাহিত্য পাতায় মাঝে মাঝে ছাপা হতে দেখতাম। তাঁরা হলেন রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন। আমি ব্রত নিয়েছিলাম, বছরে একটা গল্প ছাপা হলেও সাহিত্য পাতায় দেব। মরলেও মহিলা পাতায় লিখব না। এ জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। অবশ্যই আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল তা। কিন্ত সুখের বিষয়, দারুণ পজেটিভলি সময় বদলেছে। এখন নারী পাতায় নারীর সাহিত্য ছাপা হয় না। সেখানে নারী বিষয়ক নানা ফিচার যায়। আর সাহিত্য পাতায় লেখা ভালো হলে সমানভাবেই নারী পুরুষের লেখা যায়।
আবার বিভ্রান্তিতে পড়া নারীবাদীরাও আছেন। তাদের জন্য এমনটা হয়েছে যে, অনেক পুরুষ কোনো মেয়ে নিজেকে নারীবাদী বললে, তার সাথে নিজেকে জড়াতে ভয় পায়।

ইশরাত তানিয়া: এবার একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি। প্রকাশনা শিল্প সাহিত্যচর্চা ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ লেখক-প্রকাশকের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের বিষয়টি খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষন কী বলে? সমাধান সম্ভব?
নাসরীন জাহান: লেখক-প্রকাশকের মূল সংঘাতের জায়গা হলো, একজন লেখক কিছুতেই জানতে পারে না তার ক’ কপি বই বেরোচ্ছে। বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে রসিদ, ডক্যুমেন্ট থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকাশককে বিশ্বাস করা ছাড়া লেখকের আর পথ থাকে না। ক’জন অসহায়ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, কিভাবে পেতে পারি, আপা?
প্রকাশক তো একজন ব্যবসায়ীও। লেখকের সাথে তিনি যদি এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে পারেন, তবে খুব ভালো হয়। লেখকেরা পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে এক কিস্তি, এরপর ছ’মাস পর পর আরেক কিস্তি, যা-ই সম্মানী হোক, যদি পান, বিষয়টা সুন্দর হয়। কিছু প্রকাশনা সেটা করে। অনেক প্রকাশনীতে লেখক ধর্ণার পর ধর্ণা দিয়েও সম্মানী পায় না।

ইশরাত তানিয়া: লিটল ম্যাগাজিন। বলা হয় এটি একটি আন্দোলন। লিটল ম্যাগের লড়াই ও টিকে থাকা প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ভাবনা শোনা যাক।
নাসরীন জাহান: লেখালেখির শুরু ক্লাস টেনে থাকতেই। কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় আমার লেখা ছাপা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে সংবাদ, ইত্তেফাক। এর মধ্যেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে লিটিলম্যাগে যুক্ত পারভেজ হোসেন, সেলিম মোরশেদ, মামুন হুসাইন, শহীদুল আলম, কাজল শাহনেওয়াজ এদের সাথে নারী পুরুষ সমান্তরাল বন্ধুত্বে মিশে যাই। প্রতি সপ্তাহে হয় ওখানে, নয় আমার বাসায় আড্ডা হতো। ওদের মাধ্যমেই বিশ্বসাহিত্য পাঠ। আমি আর শহীদুলই বেশি পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব নিয়ে লিখতাম। সেখানে প্রতি সপ্তাহে কে কী লিখল, তা পাঠ হতো। কিন্তু আমি যেহেতু বড় কাগজে লিখি, ওরা আমাকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে গেল। ওদের সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় কিছুতেই আমার লেখা ছাপাত না। একবার আমার একটা নিরীক্ষামূলক গল্প হুট করে পারভেজ তাঁর সম্পাদিত ‘সংবেদ’ পত্রিকায় ছাপল। গোলমাল শুরু হলো। কট্টর লিটিলম্যাগের গুরুই বলা যায়, সেই সেলিম মোরশেদ আমার পক্ষ নিল। বলল, আমাদের নিরীক্ষামূলক লেখা বড় কাগজ বের করে না বলেই আমরা লিটিলম্যাগ করি। নাসরীনের আপোসহীন লেখা ওরা প্রকাশ করে। আমরা কি লেখা দেখব না লেখক? যা হোক, আমার আদর্শবিরোধীরা অনেকে বিপরীত কাণ্ড করলেও, এক এক করে সেলিম মোরশেদ ছাড়া বাকি সকলেই বড় কাগজে চলে এলো। এখন বড় কাগজের লেখকদের নিয়ে যেসব ম্যাগাজিন বেরোয়, সেগুলোকে তখন লিটিলম্যাগ বলা হতো না।
পশ্চিমবঙ্গেও একই অবস্থা ছিল। আমি বছর বছর সেখানকার লিটিলম্যাগের সাথে যুক্ত ছিলাম বলেই আমার লেখার প্রকাশ্যভক্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের সাথে প্রাণের সম্পর্ক থাকলেও ‘দেশ’ থেকে শুরু করে ওদের কোনো বড় কাগজে লেখা দিইনি।

ইশরাত তানিয়া: ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? তখন থেকেই কি ঘোরের মধ্যে থাকতেন? নাকি চঞ্চলতা আর দুষ্টুমিটাও ভর করত?
নাসরীন জাহান: প্রশ্নটা যেন আমার জন্যই করা। কল্পনার ঘোরে যেমন থাকতাম, দুষ্টমিও করতাম। আমার জন্ম হয়েছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট গ্রামে। আমার আব্বা ওখানে তখন বদলির চাকরি করতেন। আমরা নানা বাড়ির তেপান্তরে রাজকন্যার মতো উড়ে বেড়াতাম। মামারা বিয়ে করেনি, খালার বর শহরে পড়াশোনা করতেন। বাচ্চা বলতে আমরাই। আমি সর্ষে বনে শুয়ে আসমানের মেঘ দেখতাম। দেখতাম তার আশ্চর্য বদল, কখনো হাতি, কখনো অজগর, কখনো মানুষ এমন কত নানা রূপ আমাকে বিমূঢ় করে তুলত। দূরের নীল পাহাড় ছিল আমার প্রধান বিস্ময়। কতবার আমি ওটাকে কাছে পেতে চেয়েছি। যত হাঁটি ততই দূরে চলে যেতে দেখতাম। ব্যথা পা নিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতাম।
এরমধ্যে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের পরিবার ভাগ হয়ে গেল। আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড়ভাই আলোক দূর সম্পর্কের নানার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাউশা নামের গ্রামে। যুদ্ধ তীব্রতর হলে অভাবের কারণে তারা আমাদের বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্ষুধার্ত আমাকে ভাই শালুক এনে দিল। ভয়ে ভয়ে এক গাছতলায় রাত কাটালাম। রাজকন্যা থেকে ঘুঁটেকুড়ানী হলাম। আর্মিরাও এসেছিল, সে বিশাল গল্প। আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসে এসব ব্যাপার এনেছি। এই যুদ্ধ সারাজীবনের জন্য আমার আত্মাটাকে ফুটো করে দিল। শৈশব থেকেই তাই হয়তো সুখের গল্প তেমন লিখি না।
শহরে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। তখন ছেলেদের সাথে আমি আর আমার বান্ধবী রুবী (কথাসাহিত্যিক পারভীন সুলতানা) মাঠে দাবিয়ে খেলতাম। আজানের আগে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুলগাছ চুরি করতাম। ঘরের কাজ সেরে রাজ্জাক কবরীর পোস্টার দেখতে যেতাম। এত গপ্পো আছে! বলে শেষ করা যাবে না।

ইশরাত তানিয়া: শুদ্ধতম অনুভূতির নাম প্রেম। আপনার চেতনায় প্রেমকে কী রূপে দেখেন? ঈশ্বরপ্রেম বলুন কিংবা নারী-নরের প্রেম বলুন, সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে এর প্রভাব কতটুকু? মানে, সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে কি?
নাসরীন জাহান: প্রেম একটা স্বর্গীয় অনুভূতির নাম। নর-নারীর প্রেম আর ঈশ্বর প্রেমের ধরনটা আলাদা। প্রাণ থেকে যখন প্রগাঢ় প্রেম উৎসারিত হয়, তার মধ্যে অলৌকিক এক কামনা দুজনকে রোমাঞ্চকর প্রচ্ছায়ায় ঘিরে রাখে। নরনারীর প্রেমের স্পর্শে নতুন প্রজন্মেরও জন্ম হয়। যদি নর-নারীর প্রেমহীন তাও হয়। যে প্রেমে দুটি আত্মার মিলন ঘটে সেই প্রেমের মধ্যে শরীর এলেও আমি তাকে অশুদ্ধ বলব না। প্রেমময় দুটি দেহে অগ্নির প্রজ্জ্বলন ঘটে। যদি সত্যিকারের প্রেম হয়, তবে সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের প্রেমের পার্থক্য ঘটে না। যদিও সৃষ্টিশীল মানুষের প্রেম অনেক নান্দনিক হয় প্রায় ক্ষেত্রে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রেমও যদি প্রগাঢ় হয়, তখন অলৌকিকভাবে তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ঢুকে যেতে পারে।
ঈশ্বরপ্রেমকে তথাকথিত মৌলবাদীরা যেভাবে দেখে, আমি সেভাবে দেখি না। ঈশ্বরকে মহান এক আর্টিস্ট মনে করি আমি। পুরো পৃথিবীকে পাহাড়, সমুদ্র থেকে শুরু করে গ্রীষ্ম, শীতে অপূর্ব করে নানা রঙে সাজিয়েছন। তারপর আছে সূর্য, চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন রংধনুময় কোটি কোটি রহস্যময় অস্তিত্ব উজাড় করা সৌন্দর্যের রহস্য। শুনেছি, পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বর পাওয়া যায়। চোখ বন্ধ ধ্যানে যেমন তার দেখা মেলে, তেমনই পৃথিবীর সব সুন্দরের মাঝে চোখ খুলেও বিমুগ্ধতার মধ্যে তার স্পর্শের স্বাদ মেলে। বর্ষার তীব্রতায় যেমন তছনছ হয়ে সব ভেসে যায়, এরপরই পলিমাটি এসে সেইসব ভাঙন সব বিন্যস্ত করে দেয়।

ইশরাত তানিয়া: উড়ুক্কুর জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপ্স পুরস্কার পান। এই অর্জনের আগের ও পরের কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি?
নাসরীন জাহান: আমার পাঁচটা গল্পের বইয়ের পর আমি তড়পাতাম, কেন উপন্যাস লিখতে পারি না? একসময় ঠিক করলাম, মার্কেজ, সুবিমলকে টা টা করে আমার শৈশব থেকে জীবন যা দেখেছি, তার সাথে আমার গড গিফটেট ইমাজিনেশনের জলরঙ তেলরঙ মিশিয়ে যা হোক লিখে যাই। আমার বাড়ির কাছের অপার্থিব মেথর পট্টির দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে একের পর এক কত কী দুর্বিষহ জীবন সে লেখায় এসেছে।
বইটি মোটা হয়ে গেল। বন্ধু পারভেজের সাহায্যে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘উড়ুক্কু’ বইটা বেরোলো। দিন যায়, বই বিক্রির নাম নেই। প্রকাশকের মুখে ছায়া। একদিন মেলা থেকে ফিরতে গিয়ে কান্না আটকাতে পারিনি। চোখের জল মুছতে মুছতে সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনে আর বই করব না। লিখতে ইচ্ছে হলে লিখব। পাণ্ডলিপি ফেলে রাখব।
কিভাবে ‘উড়ুক্কু’ ফিলিপসে গেল, কিভাবে কী হলো সেই ইতিহাস থাক। একদিন রিং বেজে উঠল। রিসিভার কানে নিতেই ওরা জানাল, “এই বছর উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য আপনি...” আমার কথা বলছে? রিসিভার হাত থেকে খসে গেল। এরপরের বইমেলায় মনে হলো, এটা যে আগের মেলায় বেরিয়েছে কেউ জানেই না। বিক্রি...বিক্রি... অটোগ্রাফ... অটোগ্রাফ... বিদেশে আমন্ত্রণ... প্রায় এক বছর বিখ্যাত হওয়ার কী সুখ, কী অস্বস্তি বুঝেছি। কিন্তু আজীবন আপোসহীন আমি নিজের কানে শুনিয়েছি, পুরস্কার যদি লেখকের দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়, তবে লেখকের চাইতে সেই পুরস্কার বড়। পুরস্কার প্রেরণা হয়েছে, কিন্ত আমার লেখার ভালো মন্দের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তখন ফিলিপস পুরস্কার এত নিরপেক্ষ ছিল, বলা যায় আমার আগে যাঁরা পেয়েছেন, তাদের তুলনায় আমি পিচ্চিই ছিলাম। কিন্তু এই পুরস্কার দিয়েই আমি জীবনকে আরেকভাবে চিনলাম। যেহেতু মরলেও কোনো দলবাজি করিনি, বড় জায়গা থেকে বড় বড় অফার পেয়েও, ক্রমশ জাগতিক পৃথিবীতে কোনঠাসা হয়ে যেতে থাকলাম। কারণ পৃথিবীতে আমি লিখতে এসেছি।
খুব কমই প্রোগ্রামে যাই। আরেকটা ভয়ঙ্কর নেগেটিভ দিক আছে আমার, আমি মহা মহা অলস। এইজন্যই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান সাহিত্য। এটার ওপর উপুর হয়ে থাকি। মরণপণ চেষ্টা থাকে, এই বইটা যেন আগের বইটার মতো না হয়।

ইশরাত তানিয়া: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতি কি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করে? ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট তেমনটিই বলে।
নাসরীন জাহান: প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবে আমার লেখায় বিশ্বরাজনীতি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলে মনে করি। আমার উড়ুক্কু উপন্যাসের পরতে পরতে মূল চরিত্র নীনার চলা একদিকে, অন্যদিকে উপসাগরীয় যুদ্ধের বর্ণনা পাশাপাশি চলেছে। যুদ্ধ শেষে বুশ ব্যাপক লাভবান হয়েছে, আমার উপন্যাসও শেষ হয়েছে। না, রাজনীতি প্রকট হয়নি।
নীনার জীবনটা ডিটেইলে এগিয়ে গেছে আর যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে পত্রিকার টাইটেল হয়ে হয়ে। এখন বিশ্বায়নের যুগ। আগেই বলেছি পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাঁদের অনেকের লেখার প্রচ্ছন্ন রাজনীতিবোধ আমাকেও প্রভাবিত করেছে। ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে, একটা দেশের যুদ্ধ বাতাসে উড়ে উড়ে আরেক দেশের যুদ্ধের সাথে একীভূত হয়।
আমার কষ্ট, এই বইটার নাম কেউ নেয় না। তুমি নিলে, অনেক ধন্যবাদ। আরেকজন, কর্ণেল তাহেরের ভাই ড. আনোয়ার হোসেন। উনি এত অভিভূত হয়েছিলেন, আমি রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়েছিলাম।
কাফকার উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’-এর কথাই ধরা যাক, যে বই পড়ে মার্কেজ প্রথম উপন্যাস লেখার তাগদা পান। এই উপন্যাসটার মূল চরিত্র গ্রেগর, যে ছেলে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে পোকা হয়ে গেছে। এরপর গ্রেগরের স্ট্রাগল, ধীরে ধীরে তার প্রতি পরিবারের অবহেলা। বহু বহু আগে পড়েছি, কোথাও রাজনীতির ছিটেফোঁটা পাইনি। একসময় শুনি, এই উপন্যাসটা ওদেশের বুর্জোয়া শ্রেণি, পলিটিক্সের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। পরে ফের উপন্যাসটা পড়ে এর রূপকের আড়ালে সত্যটা বুঝতে পারি।
আমার মতে আমার নিজের সবচাইতে জোরাল রাজনৈতিক উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’। রূপকের আড়ালে ঢাকা রূপকথার আদলে লেখা উপন্যাসটি বোদ্ধামহলের অনেক জায়গা থেকে জাদুবস্তবতা ঘেরা পলিটিকাল উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;