করোনার প্রকোপ বৈশ্বিক মহামারি হয়ে ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে। অনেকের মতে আমাকেও বেছে নিতে হয়েছে সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের চেয়ে কঠিন হোম কোয়ারেন্টাইনের নিঃসঙ্গ জীবন।
বারণ করার পরও একমাত্র কন্যা দরজায় কড়া নাড়েনা আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো পাশের রুম থেকে ফোনে জিগ্যেস করে, 'বাপি, তুমি কি খাবার খেয়েছো, সব টুকু খাবার শেষ করেছো?' কখনো বলে, 'আমার মন খারাপ লাগছে তোমার জন্য।'
তাড়াতাড়ি মুখের মাস্ক ভালো করে পড়ে দরজা খুলে পাশের রুমে তাকাই। দেখি, মেয়ের দৃষ্টি যেন আমার দরজায় অপলক চেয়ে আছে। আমি সর্বদাই আছি কোয়ারেন্টাইনে বন্দি। কিন্তু যখনি দরজা খুলে তাকাই, দেখি মেয়ে আমার চেয়ে আছে।
বেদনা ও দূরত্ব লুকিয়ে ইচ্ছে করে সশব্দে হেসে উঠি, পারিনা। কোনক্রমে কখনো কখনো মাস্কটা খুলে দূর থেকেই মুখাবয় খানিকটা ওকে দেখিয়ে তাড়াতাড়ি আবার মাস্ক পড়ে বলি, 'এই যে দেখ আমি ভালো আছি।'
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক যোগাযোগের সুবাদে কোভিড-১৯ মহামারির পূর্বাভাস উপলব্ধি করেছিলাম ফেব্রুয়ারির শেষের দিকেই। মার্চের শুরুতেই কোভিড-১৯ সম্পর্কে সচেতনতা নিয়ে বন্ধু মহল, প্রিয়জনদের সাথে কথা বলেছি। অবাক হয়েছি, দায়িত্বশীলদের কথাবার্তায়। তখনো অনেকেই সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।
মার্চের মাঝামাঝি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেই। যথাসাধ্য সাহায্য করে ওদেরকে পিতামাতা পরিবারের পাশে থাকার পরামর্শ দেই। এক পর্যায়ে কোভিড-১৯ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা তথা সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে ধারণা প্রদান ও বিনামূল্যে স্যানিটাইজেশন সামগ্রী বিতরণের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসিক স্থল ঢাকার কড়াইদ বস্তি, মহাখালী, ও মিরপুরের ছিন্নমূল মানুষের মাঝে নিজের প্রতিষ্ঠান জিওর্দানো বাংলাদেশ'র কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করি। আমাদের কার্যক্রমের সংবাদ বার্তা২৪.কম প্রকাশ করেছে এবং আমাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে উজ্জীবিত করেছেন বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় সম্পাদক, অনলাইন সাংবাদিকতার জনক আলমগীর হোসেন ভাই।
যার অনুপ্রেরণায় আমাদের কার্যক্রম আরো জোরদার হয়। ঢাকার বাইরে আমার নিজের জেলা কিশোরগঞ্জের নিভৃত পল্লী অষ্টবর্গ গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের প্রশিক্ষিত করে সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ও বিনামূল্যে মানুষের মাঝে স্যানিটাইজেশন সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রাখি আমরা। তখনো কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে দেশের তেমন কোন প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে সক্রিয় হননি। তবে এ কথা শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করছি যে, আমাদের এ সকল কর্মকাণ্ডে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আলমগীর হোসেন অতুলনীয় অনুপ্রেরণা ছিল সাহস স্বরূপ। তাছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-সাংবাদিক অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ ও দূরদর্শী বন্ধু সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার উৎসাহও আমাদের সঙ্গে ছিল।
এরই মাঝে করোনাকাল দীর্ঘায়িত হয়েছে সাত মাস। আমার ক্ষুদ্র জীবনের আরো কতটা সময় আতঙ্কে কাটবে জানিনা। আমি নিজেও বাস্তব কারণে হোম কোয়ারেন্টাইনে নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করছি। এদিকে তিলে তিলে গড়া প্রিয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নুয়ে পড়ছে ক্রমশ। স্পেস ভাড়া, মেইনটেনেন্স বিল, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতন ও অন্যান্য খরচাদি কমেনি, কমেছে শুধুই আয়। কমেছে বললেও ভুল হবে। অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ও প্রদত্ত ৪% সুদের লোনের টাকাই এখন একমাত্র সম্বল।
কোভিড-১৯ এই মহামারিতে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে কত মানুষ যে সম্বলহীন অন্তঃসার পর্যায়ে নেমে গেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। যতই দিন যাবে সামাজিক ও আর্থিক নিঃস্বকরণে নির্মম চিত্র ভেসে আসতে থাকবে।
বিচক্ষণ ব্যাবসায়ী বন্ধুদের অনেকেই শ্রমিক ছাটাই কিংবা তাদের বেতন কমিয়ে অর্থনীতির লাগাম টেনেছেন। তাদের ব্যাবসা বিদ্যা বি.বি.এ., ও এম. বি.এ. এক্ষেত্রে সার্থক। কিন্ত আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে দার্শনিক কান্টের নীতিশাস্ত্র পড়েছি, দেকার্ত ও সক্রেটিস পড়েছি। মানবিকতা তাই আমার ব্যবসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি কখনো।
আমার স্ত্রী সরকারি কলেজ শিক্ষক। অবসরের আর কয়েক বছর বাকি তার। ক্লাস রুম ছাড়া তিনি পয়সার বিনিময়ে একজনকেও কখনো প্রাইভেট পড়ান নি। অতি নৈতিকতার বিপদ তিনি টের পেয়েছিলেন যখন ডিসি সাহেবের মেয়েকে না পড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো তাকে। তিনি বিনয়ের সাথে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন যে, ছাত্রীকে তিনি ক্লাসের শেষে শ্রেণি কক্ষেই বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানোর আহ্বান করেছিলেন। তিন মাস পর পরীক্ষার ফল বেরোলো। বাসায় এসে পৌঁছুলো খুলনার সুস্বাদু আমের বিশাল এক ঝুড়ি। প্রেরক ডিসি মহোদয় খুলনা।
বুঝতে অসুবিধা হয়নি ছাত্রীর বাবা ডিসি সাহেব খুলনায় বদলি হয়েছেন। কাঁচা আম পাকতে শুরু করে যেদিন পচন ধরছে। সে দিনই ডিসি সাহেবের ফোন সম্ভবত তিনি ধরেই নিয়েছিলেন অধ্যাপক লাইজু আক্তার তার আম বর্জন করবেন। ডিসি সাহেব এবার অতি বিনয়ী, তার মেয়েকে পড়ানোর বিনিময়ে অর্থ না নিলেও স্বীয় ছাত্রীর কৃতকার্যতার আনন্দে খুলনার এ সুস্বাদু রঙিন আম তাকে খেতেই হবে।
সাত মাস যাবৎ কাজের বুয়া মাসের শেষে গেটে এসে পাঁচ তলা থেকে তুলে দেয়া বেতন নিয়ে যান। বাসায় সকলে মিলে নিজেদের কাজ নিজেরাই করি। কিন্তু আমার গুণবতী পত্নীকে পরাস্ত করার সাধ্য কার? আমাদের ঘুম থেকে উঠার আগেই তিনি সব কাজ সেরে ফেলেন। এখন তিনিও ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ওজন কমেছে। শুধু তাই নয়, থালা বাসন মেজে তার নখ ক্ষয় হয়ে ইনফেকশন হয়েছে। তবুও কোভিড-১৯ সংক্রমণ ভয়ে বাসায় বাইরের লোক আনতে রাজি নন।
ড্রাইভার সাহেবও তো ভীষণ খুশি। বাসায় বসে থেকে বেতন। এই সাত মাসে দু একজন আত্মীয় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে তাদের বাসায় পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। আামার শর্ত একটাই ছিলো। তিনি তার বাসায় থাকবেন বৌ, বাচ্চাকে সময় দেবেন আর জরুরি প্রয়োজন হলে মাস্ক ব্যবহার করবেন। আমাদের ও নিজের জন্য তিনি নিজে নিরাপদ থাকবেন। বিধিবাম তিনি কথা রাখেন নি। বিস্তর অবসর সময় কাটিয়েছেন রাস্তায় সিগারেটের দোকান আর চায়ের আড্ডায়।
সাত মাসে বড়জোর পাঁচ দিন জরুরি কাজে বাসা থেকে বের হয়ে তার গাড়ি ব্যবহার করেছি। সর্বশেষ ১৬ সেপ্টেম্বর আমার সার্জিকেল মাস্ক পড়া ছিলো, তবুও ভাবলাম বাসা থেকে বেড়িয়েছি দীর্ঘদিন পর, ড্রাইভার আমার নিরাপদ কি না পরীক্ষা করে নেই। তাকে কোভিড-১৯ টেস্ট করালাম। ১৮ তারিখ রিপোর্ট পজেটিভ। চিকিৎসক আমাকে উপদেশ দিলেন, জনস্বার্থে কমপক্ষে ১৪ দিন, পরিবার নিয়ে কোয়ারেন্টাইন করুন। এদিকে কর্তৃপক্ষ বলছেন কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ওয়েভ আসছে সামনে।
ভাবছি কতদিন আর এ আতঙ্ক, আমাদের এই কোয়ারেন্টাইন জীবন!
লেখক সমাজসেবী, ব্যবসায়ী।